সিবলিং রাইভালরি বা সহোদরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কিভাবে সামলাবেন?

Spread the love

মানুষ সবচেয়ে বেশি সময় পার করে নিজের বাড়িতে তার আপনজনদের সাথে। পারস্পরিক ভালো বোঝাপড়া সেখানে বিদ্যমান থাকলেও মাঝে মাঝে কিছু না কিছু মনোমালিন্য ঘটেই যায়। যেখানে যথেষ্ট পরিপক্ক হওয়া সত্ত্বেও বড়রা এই ধরণের সমস্যাগুলো এড়াতে পারছেন না,সেখানে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সবসময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে এমনটা আশা করাটা কঠিনই বটে৷ সহোদরদের এই ঝগড়া, বিবাদ, দ্বন্দ্বের ইংরেজি টার্ম হলো সিবলিং রাইভালরি” (Sibling Rivalry)।

সিবলিং-এর সংজ্ঞা

যারা একই মাতা-পিতার সন্তান তাদেরকে ইংরেজিতে সিবিলিং বলা হয়। একই মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ভাই-ভাই, বোন-বোন বা ভাই-বোন; সবাই সিবলিং এর আওতায় পড়ে। শুধু তা-ই নয়, সৎ ভাই বা বোন কিংবা দত্তক নেওয়া ভাই-বোনকেও সিবিলিং বলা হয়।

বিজ্ঞাপণ

সিবলিং রাইভালরি বা  সহোদরদের মাঝে দ্বন্দ্ব বলতে কি বোঝায়?

ভাইবোনদের মধ্যেকার ঝগড়া, বিভেদ, দূরত্ব ও রেষারেষি এগুলোই সিবলিং রাইভালরির অন্তর্গত। এইসব বিষয় সবসময় যে দৃশ্যমান হবে তা কিন্তু নয়,  হয়তো দেখতে খুবই স্বাভাবিক লাগলেও তাদের মধ্যে ভয়ংকর ঈর্ষা বিদ্যমান থাকতে পারে৷ ধীরে ধীরে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব কলহে রূপ নেয়৷ দীর্ঘদিন যাবত চলতে থাকা সমস্যা প্রভাব ফেলে তাদের ব্যাক্তি ও সামাজিক জীবনে৷

সিবিলিং রাইভালরির কিছু উদাহরণ

  • ধরা যাক, আচমকা আপনার ৩ বছর বয়সী ছেলেটা তার ২ মাস বয়সী ছোট ভাইয়ের বুকের ওপর বসে পড়ল! আপনি অবাক হয়ে বড় ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি বাবুর ওপর ওভাবে বসলে কেন?” সে বলল, “বাবুকে আমার পছন্দ না। আমি চাই না ও এখানে থাকুক!”
  • আপনার দুই মেয়ে একসাথে সুন্দর করে খেলছে। একজনের বয়স ৪ বছর, আরেকজনের বয়স ৬ বছর। কয়েক মিনিট পরে দেখা গেল, তারা চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। কার পুতুলটা বেশি সুন্দর, এটা নিয়ে তর্ক করছে তারা। একে অন্যের পুতুলের সৌন্দর্য নষ্ট করার জন্য পুতুল ধরে টানাটানি করছে! আপনি হট্টগোল শুনে ওদের কাছে যেতে যেতে দেখলেন, ওরা এখন একে অন্যের সাথে আর খেলতেই রাজি না! রাগ করে দুইজন দুই মেরুতে চলে যেতে চাইছে!
  • ধরা যাক, আপনার তিনটি সন্তানের বয়স যথাক্রমে ৫, ৭, ১১ বছর। ১১ বছর বয়সী মেয়ে, ৭ ও ৫ বছর বয়সী দুটি ছেলে সন্তান। রাতের খাবার খাওয়া শেষে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে, টিভিতে কোন অনুষ্ঠান দেখা হবে এটা নিয়ে তাদের মাঝে ঝগড়া লেগে গেছে। তিনজন কোনভাবেই একমত হতে পারছে না। একেকজন একেক অনুষ্ঠান দেখতে চাচ্ছে। রিমোট নিয়ে কাড়াকাড়ি হচ্ছে, রিমোটের দখল পাওয়ার জন্য একে অন্যকে ধমক দিচ্ছে, সুযোগ পেলে গায়েও হাত তুলছে!

বাবা-মায়ের দৃষ্টিতে ঝগড়া করার জন্য এগুলো খুব ছোট বা হাস্যকর কারণ হলেও শিশুদের কাছে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা কখনো হারতে চায় না। অধিকাংশ শিশুরই হার মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকে না। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে বিজয়ী হিসেবে দেখতে চায়, তাই নিজের ভাই-বোনদের সাথেও তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।

আরো যেসব উপায়ে ভাইবোনদের মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ পায় তা হল: 

  • গালিগালাজ
  • দোষারোপ করা 
  • অযথা খোঁচাখুঁচি করা 
  • মিথ্যা কথা বলা 
  • মারামারি
  • অন্যের জিনিস ভেংগে ফেলা, লুকিয়ে রাখা ইত্যাদি
  • তর্ক করা
  • অন্যের দিকে জিনিস ছুঁড়ে মারা
  • কিছু শেয়ার করতে না চাওয়া।

সিবিলিং রাইভালরির কারণ ও যেসব বিষয় এটিকে প্রভাবিত করে

পরিবারে একাধিক বাচ্চা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই তারা একে অন্যের সাথে মারামারি, ঝগড়া, তর্ক, হাতাহাতি ইত্যাদি করে বসে। কিন্তু বাচ্চারা তো নিষ্পাপ। তারা কেন এরকম কর্মকাণ্ড করে? কেন তারা নিজের ভাই বা বোনের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চাদের এধরনের কাজ করার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।

সন্তানদের জন্মের ক্রমান্বয় ও সিবলিং রাইভালরি

সিবলিং রাইভালরির ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে জন্মক্রমের কথা। প্রত্যেকটি বাচ্চার জন্মক্রম তার নিজের উপর এবং ভাইবোনের সম্পর্কের উপর বেশ প্রভাব ফেলে। শুধু বাচ্চার জন্মক্রম নয়, বাবা মায়ের জন্মক্রমও এতে পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে জন্মক্রম অনুযায়ী শিশুরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার উপর ভিত্তি করে বেশিরভাগ শিশু একই ধরণের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যেমন-

প্রথম সন্তান

বাবা-মায়ের প্রথম সন্তানের সাথে সাধারণত পরিবারের সবচেয়ে কর্তৃত্বশীল ব্যক্তি (যেমন: বাবা), সবচেয়ে কর্মঠ ব্যক্তির মিল পাওয়া যায়। সে তাকে অনুকরণ করতে চায়। প্রথম সন্তান বা বড় সন্তান সাধারণত কাজ ভালবাসে, লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেটা পূরণ করতে চায়, নিখুঁতভাবে সব সম্পন্ন করতে চায়। বিশ্বস্ত, দায়িত্ববান, সুশৃঙ্খল, সিরিয়াস ইত্যাদি গুণাবলী তার মাঝে দেখা যেতে পারে।

দ্বিতীয় সন্তান

দ্বিতীয় সন্তান বা মেজো সন্তান সাধারণত পরিবারের আবেগপ্রবণ ব্যক্তিকে (যেমন: মা) অনুকরণ করার চেষ্টা করে এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। মেজো সন্তান ভাল মানের কাজ করতে আগ্রহী হয় এবং মানুষের আবেগের দিকে যত্নশীল থাকে। সে সাধারণত মধ্যস্থকারী হিসেবে কাজ করে, যথাসম্ভব ঝামেলা, ঝগড়া ইত্যাদি এড়িয়ে যেতে চায়। তবে সে স্বভাবে স্বাধীনচেতা হয়, নিজের পরিবার, বন্ধু, গ্রুপ, গোষ্ঠীর প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত থাকে। আবেগের বাড়াবাড়ির কারণে কোনো কোনো মেজো সন্তান বাউুন্ডলে স্বভাবেরও হয়ে থাকে।

তৃতীয় সন্তান

পরিবারে জন্ম নেওয়া তৃতীয় সন্তানটি দেখতে পায় পরিবারে ইতিমধ্যে অনেক মানুষ রয়েছে। সে তাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় ভাগ করে নেয়। যেমন : বাবা-মা (১ জোড়া), অগ্রজ দুই ভাই বা দুই বোন বা এক ভাই-এক বোন (১ জোড়া)। পরিবারের তৃতীয় সন্তান সবার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে পারদর্শী হয়। সে রসিক হয় এবং নিজের রসবোধকে সমস্যা সমাধানের কাজে লাগায়।

ছোট সন্তান

পরিবারের ছোট সন্তান পরিবারকে মাতিয়ে রাখে। পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যদের আবেগ, অনুভূতির ভিন্নতা ও বৈচিত্রতা অনুযায়ী সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তবে পরিবারের ছোট সন্তান সুযোগ সন্ধানী হয়ে থাকে, নিজের কাজের দায় এড়িয়ে যায়, শো-অফ করতে পছন্দ করে। নিজের রসবোধকে ব্যবহার করে নিজের চাওয়া আদায় করে নেয়। পরিবারের ছোট সন্তান সাধারণত দেখতে তুলনামূলক ভাল হয়, একটু ইঁচড়ে পাকা এবং আকর্ষণীয় হয়ে থাকে।

প্রত্যেকটি জন্মক্রম অনুযায়ী সন্তানেরা কিছু সুবিধা এবং অসুবিধার মুখোমুখি হয়।এমনকি বাবা মায়েরও এতে বেশ প্রভাব রয়েছে৷ বাবা যদি তার ফ্যামিলির বড় সন্তান হয়ে থাকেন, তবে নিজের বড় সন্তানের প্রতি তার আলাদা টান থাকতে পারে। কারণ তার মনে হয় পরিবারের বড় সন্তানদেরই সব ঝামেলা পোহাতে হয়।

আবার মা যদি তার ফ্যামিলির ছোট সন্তান হয়ে থাকেন তবে তার নিজের ছোট সন্তানের প্রতি তার টান থাকতে পারে কারণ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তার মনে হতে পারে ছোটরা সবসময় বঞ্চিত।

এভাবেই জন্মক্রম পরিবারের একেক বাচ্চার প্রতি বাবা মায়ের একেক ধরণের আচরণ তৈরি করে যা সরাসরি প্রভাব ফেলে সন্তানদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কে।

আবার নতুন সন্তানের আগমনে জন্মক্রমে যে পরিবর্তন আসে তাও যথেষ্ট প্রভাব ফেলে সন্তানদের মানসিকতায়।  ঘরের ছোট সন্তান হঠাৎ টের পায় যে, নতুন ভাই/ বোন জন্মের পর সে আগের মত ছোট শিশুর সুবিধাগুলো পাচ্ছেনা পরিবার থেকে। এটিও সিবলিংদের মাঝে সম্পর্ককে বেশ প্রভাবিত করে।

[ আরও পড়ুনঃ সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের পক্ষপাতমূলক আচরণের প্রভাব | প্যারেন্টাল ফেভারিটিসম ]

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তান জন্মের ক্রমান্বয় বা সিরিয়াল বিবেচনা করে তাদের সাথে সেই মোতাবেক কৌশল অবলম্বন করলে, বেশ ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। বিষয়টা নিরেট বিজ্ঞান নয় বা শতভাগ প্রমাণিত নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কার্যকরী।

একজন সন্তান কখনোই তার জন্মক্রম নিজের ইচ্ছায় পাল্টাতে পারেনা।  তবে তাদের মাঝে সুপ্ত ইচ্ছাটা থাকে যে যদি সে বড়জনের মত হতে পারত।  আবার বড় সন্তান এই ইচ্ছা লালন করে,  যদি সে পরিবারের সবচেয়ে আদরের ছোট সন্তান হতে পারত। 

আপনার সন্তানদের জন্মক্রমের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাদের চাহিদা বুঝতে এটি যথেষ্ট সাহায্য করবে৷ তারা যখন নিজদের জন্মক্রম নিয়ে অসন্তুষ্ট ভাব প্রকাশ করবে, তখন বুঝিয়ে বলাটা বাবা মায়ের পক্ষে সহজ হবে৷ সেই সাথে খানিকটা কৌশলী ভূমিকা পালন করলে তাদের মন মানসিকতা বিচার করে নিয়ন্ত্রণ করাটা সহজ হবে।

এছাড়াও আরও যেসব বিষয় সিবলিং রাইভালরিকে প্রভাবিত করতে পারে সেসব হলো-

জীবনে বড় কোনো পরিবর্তন আসা

আপনি কি পরিবার নিয়ে বাসা বদল করছেন? কিংবা আপনার স্ত্রী সন্তান-সম্ভবা? কিংবা অনাকাঙ্খিত কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ডিভোর্স হতে যাচ্ছে? এই বিষয়গুলো একজন প্রাপ্তবয়স্ককে যেমন মানসিক পীড়া দেয় তেমনি পরিবারের ছোট ছোট বাচ্চাদেরও কচি মানসপটে চাপ সৃষ্টি করে।

এই মানসিক চাপ, উদ্বেগ, রাগের কারণে বাচ্চারা তাদের হাতের কাছে থাকা দুর্বল মানুষটির ওপর আক্রমণ করে বসে। সাধারণত সেই দুর্বল মানুষটি হয় তারই ছোট ভাই বা বোন।

বয়স ও পরিপক্বতা

১ থেকে ৪ বছর বাচ্চাকে তারচেয়েও ছোট ভাই-বোনকে মার দিতে দেখেছেন নিশ্চয়ই? এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। সাধারণ সিবিলিংদের মাঝে বয়সের পার্থক্য কম থাকলে বা খুব বেশি থাকলে এবং দুটি সন্তানের বয়স যদি ৪ বছরের কম হয়ে তবে তাদের মাঝে ভয়াবহ পরিমাণে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। ৮-১০ বছর বয়সী শিশুটিও দেখা যায় তার ছোট্ট ভাই বা বোনকে সবার অলক্ষ্যে সুযোগ বুঝে আঘাত করে বসে।

ঈর্ষা ও নিরাপত্তাহীনতা

ধরা যাক, আপনার ৩ বছর বয়সী মেয়েটা একটি চমৎকার ছবি এঁকেছে। আপনি ছবিটি দেখে অনেক প্রশংসা করলেন। কিন্তু দেখা গেল, আপনার ৬ বছর বয়সী বড় মেয়েটি বিষয়টা মোটেও পছন্দ করলো না। সে ছোট বোনকে ঈর্ষাবোধ করতে শুরু করলো। ভাবলো, আপনি তাকে ফেলে ছোট মেয়েকে বেশি আদর করতে শুরু করেছেন, বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে সিদ্ধান্ত নিল, সে ছোট বোনের ছবিটা ছিঁড়ে ফেলবে! শুরু হয়ে গেল দ্বন্দ্ব!

নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও প্রতিযোগিতা

বাচ্চারা স্বভাবগতভাবেই নিজেদেরকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। অন্য বাচ্চাদের থেকে তো বটেই, নিজের ভাই বা বোনদের চেয়েও নিজেকে আলাদা বা বেশি দক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। এই স্বভাবের জন্যই তাদের মাঝে প্রতিযোগিতামূলক আচরণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

খেলার সময় কে সবচেয়ে বড় টাওয়ার তৈরি করতে পারে, কে খেলনা গাড়ি সবচেয়ে বেশি গতিতে ছোটাতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে তারা সহোদরদের সাথে সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আর প্রতিযোগিতা থেকেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব!

বাবা-মাকে অনুকরণ করা

যদি আপনার বাচ্চারা প্রায়ই দেখে তাদের বাবা-মা উঁচু গলায় কথা বলছে, ঝগড়া করছে, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করছে; তাহলে তারাও সেই পন্থা অবলম্বন করবে। বাচ্চারা অত্যন্ত অনুকরণ প্রিয় হয়। তারা যা দেখে, সেটাই করতে চায়। কোনো সমস্যায় পড়লে, বাচ্চা তার ভাই-বোনদের সাথে ঠিক সেই আচরণ করবে যেমনটা নিজের বাবা-মাকে করতে দেখে।

[ আরও পড়ুনঃ বাবা-মায়ের ঝগড়ার কারণে সন্তানের মানসিক ক্ষতি ]

পারিবারিক বৈচিত্রময়তা

যখন কোনো পরিবারে প্রতিবন্ধী বা স্পেশাল চাইল্ড ভূমিষ্ঠ হয়, তখন সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়। কারণ বাবা-মায়েরা স্পেশাল চাইল্ড কেন্দ্রিক অগ্রীম কোনো পরিকল্পনাই করেন না। ফলে বাবা-মা সেই স্পেশাল চাইল্ডকে বেশি যত্ন করতে শুরু করেন, সেই বাচ্চার চাহিদা, সুবিধা, অসুবিধার প্রতি বেশি মনোযোগ দেন।

বাবা-মাকে সেই বাচ্চাকে বেশি যত্ন নিতে দেখে পরিবারে থাকা অন্য বাচ্চাটি স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে অবহেলিত মনে করতে পারে। ফলশ্রুতিতে সে বাবা-মায়ের ‍দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, তাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্য নিজের ভাই বা বোনকে মারধোর করতে পারে, তাদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে পারে। 

প্রশংসা ও সমালোচনা

পরিবারে যখন এক বাচ্চাকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রশংসা করা হয় এবং অন্য বাচ্চাটিকে সমালোচনামূলক কথা শোনানো হয়, তখন সেটা বাচ্চাদের মনে বিষয়টা বিরূপ প্রভাব ফেলে। যে বাচ্চাটি প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের সমালোচনা শোনে, সে সুযোগ পেলেই নিজের প্রশংসা প্রাপ্ত ভাই বা বোনের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে, তাকে আঘাত করতে পারে।

[ আরও পড়ুনঃ শিশুকে প্রশংসা করার সময় যে শব্দগুলোর ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে ]

কোন বয়স থেকে সাধারণত সিবলিং রাইভালরি শুরু হয়

মূলত পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই দ্বন্দ্বটা শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের প্রতি বাবা-মা অনেক বেশি মনোযোগ দেন, যত্ন নেন, সময় দেন, আদর করেন। এসব দেখে বড় সন্তানটির মাঝে ধীরে ধীরে হিংসা জন্মাতে থাকে। সে নিজেকে অবহেলিত এবং গুরুত্বহীন ভাবতে শুরু করে। আর এসবের জন্য দায়ী করতে থাকে নিজের ছোট ভাই বা বোনকে!

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৮ মাস বয়স থেকেই শিশুদের মাঝে সিবলিং রাইভালরি দেখা দিতে পারে। ১০ থেকে ১৫ বছর; এই বয়সে সিবিলিংদের দ্বন্দ্বটা তুঙ্গে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে তারা বড় হতে থাকে, একপর্যায়ে মানসিকভাবে পরিপক্ব হয়ে যায়। তখন আর সেভাবে দ্বন্দ্ব থাকে না। বরং সিবিলিংদের প্রতি ভালবাসা, মায়া, টান ইত্যাদি অনুভূতি সমূহ মজবুত হয়।

শিশুর বিকাশে সিবলিং রাইভালরির প্রভাব

সিবিলিংদের মাঝে খুনসুটি, মারামারি হয়েই থাকে। এগুলোর বাজে প্রভাব যেমন আছে, ভাল প্রভাবও আছে। নিয়ন্ত্রণহীন দ্বন্দ্ব, মারামারি, ঝগড়া ধীরে ধীরে একটি শিশুকে যেমন উচ্ছৃঙ্খল করে দিতে পারে, তেমনি লাগাতার ভাই/বোনের কাছ থেকে মার খেতে খেতে একটি শিশু মানসিক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এই প্রভাবগুলো তাদেরকে বাকি জীবন জুড়ে বয়ে বেড়াতে হতে পারে।

নতুন বন্ধু তৈরীর প্রক্রিয়া এমন একটি সামাজিক দক্ষতা যা সবার থাকেনা।  যেসব পরিবারে ভাইবোনদের মাঝে হিংসাত্মক মনোভাব রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই দক্ষতাটি সেভাবে গড়ে ওঠেনা। উতাহ স্টেট ইউনিভার্সিটি বলছে যে,  ভাইবোনদের মধ্যেকার দ্বন্দ নিজেকে প্রকাশের একটি অসভ্য উপায়, এটি ইংগিত করে যে সামাজিক দক্ষতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে সেখানে। সামাজিক দক্ষতা না থাকলে আপনার সন্তানেরা প্রায় একঘরে ধরণের হয়ে যেতে পারে।

আবার বাবা মায়ের ক্ষেত্রে স্ট্রেসের একটি অন্যতম কারণ হল তাদের সন্তানদের ক্রমাগত দ্বন্দ। দুইটির বেশি বাচ্চা থাকলে তাদের পক্ষে সব সন্তানের প্রতি সুবিচার করাটা সম্ভব হয়না। উপরন্তু উনারা যদি চাকরিজীবী হয়ে থাকেন তাহলে বাচ্চাদের সময় দেয়াটাও কঠিন হয়ে যায়। এতে পরিবারে স্ট্রেস ও হতাশা বাড়তে থাকে ক্রমাগত।  চাহিদা ও পাওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক তৈরী হয়ে যায়। বাবা মায়ের মানসিক চাপের প্রভাব পড়ে সন্তানদের উপর।  পারিবারিক পরিবেশ হয়ে ওঠে খিটখিটে এবং উত্তপ্ত। সব কিছু মিলিয়ে সন্তানদের বিকাশ বেশ বাঁধাগ্রস্থ হয়।

অন্যদিকে সিবিলিংদের সাথে দ্বন্দ্বের কিছু ভাল দিক রয়েছে। যেমন:

  • শিশুরা নিজের শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে এবং সেদিকে নজর দেওয়ার সুযোগ পায়।
  • ঝামেলা সামলানোর সক্ষমতা অর্জন করে এবং প্রত্যেককে আলাদাভাবে বিবেচনা করে মূল্যায়ন করতে শেখে।
  • নিজের অধিকার আদায়ের জন্য দাঁড়াতে শেখে।
  • বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য সমঝোতা ও আপোস করতে শেখে।

সহোদরদের দ্বন্দ্বে বাবা-মায়ের করণীয়

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবা-মায়ের উচিত যথাসম্ভব সিবিলিংদের ঝগড়া থেকে নিজেকে দূরে রাখা। অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বন্দ্বটা কোনো মারাত্মক রূপ ধারণ করছে বাবা-মায়ের উচিত বাচ্চাদেরকে নিজেদের মতো করে বোঝাপড়া করার সুযোগ দেওয়া। সিবিলিংদের সাথে ঝগড়া করেও শিশুরা অনেক কিছু শিখতে পারে। বাবা-মা যদি ঝগড়া বা দ্বন্দ্ব শুরু হতে না হতেই সেটা থামিয়ে দেন, তাহলে শিশুরা সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।

এটা খুবই সত্যি যে আপনি দিনে ২৪ ঘন্টা  আপনার শিশুদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবেন না। এমনটা হলে তারা আপনাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করবে৷ প্রশ্নটা হল কখন আপনি আপনার সন্তানদের কলহ মিটমাটে অগ্রসর হবেন?ঠিক কোন মূহুর্তে আপনি বলতে পারবেন যে, ” এবার থামো “?

বিজ্ঞাপণ

এইক্ষেত্রে পিতামাতার জন্য খুব সুন্দর একটি গাইডলাইন রয়েছে৷  একে বলা হয়, Green light to red light guideline “.

ট্রাফিক সিগনালের মতই এই গাইডলাইন আপনাকে বলে দিবে কখন আপনি সামনে অগ্রসর হবেন, কখন শুধুমাত্র পর্যবেক্ষন করবেন।

সবুজ বাতি

সামান্য কলহ চলছে, হালকা বাকবিতন্ডার মধ্যেই সীমাবদ্ধ সন্তানেরা৷ এক্ষেত্রে আপনার কর্তব্য হল সেখানে নাক না গলানো।

হলুদ বাতি

চিৎকার চেচামেচি বাড়ছে, একে অপরকে খারাপ ভাষায় সম্বোধন করছে৷ গায়ে হাল্কা ধাক্কাধাক্কি,  আশু সংঘর্ষের পূর্বাভাস টের পাচ্ছেন আপনি।

আপনার দায়িত্ব: তাদের ক্রোধের জায়গাটা বুঝার চেষ্টা করুন তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন। নির্দিষ্ট খেলনা নিয়ে কলহ বাধলে সেটি সরিয়ে ফেলুন। টিভির রিমোটের দখল নিয়ে ঝগড়া হলে,  টেলিভিশন অফ করে দিন।

কমলা বাতি

বিপদজনক অবস্থা, খেলাচ্ছলে মারামারি চলছে।

আপনার কর্তব্য : বোঝার চেষ্টা করুন তারা কি খেলছে নাকি সত্যি ঝামেলা চলছে?  তাদেরকে থামিয়ে দিন সেখানেই, বুঝিয়ে বলুন। ঝগড়া থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দুইজনকে আলাদা রুমে পাঠিয়ে দিন। 

লাল বাতি

ভয়ংকর অবস্থা, আঘাত পাল্টা আঘাতে জখম বা কাটাছেড়া হয়ে গেছে বা হতে যাচ্ছে৷ 

আপনার কর্তব্য: জোর করে তাদেরকে আলাদা করে দিন।  আহত সন্তানের দিকে মনযোগ দিন প্রথমে৷ এরকম যাতে আর না হয় তার ব্যাবস্থা করুন। প্রয়োজনে এই আচরণের ফল ভোগ করতে দিন।

আশা করা যায় গাইডলাইনগুলো আপনার সন্তানদের কলহের মূহুর্তে আপনার করণীয় নির্ধারণ করতে আপনাকে সাহায্য করবে৷ 

এবার আসা যাক কলহপরবর্তী অবস্থা, যেখানে আপনাকে একজন নিরপেক্ষ বিচারক, স্নেহশীল ও ধৈর্যশীল অভিভাবক,  সর্বোপরী কৌশলী এক ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হবে৷ যদি এ সময় আপনি পক্ষপাতিত্ব করেন, তবে তা ভাইবোনের মধ্যেকার দ্বন্দ আরো উসকে দেবে৷ এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার বঞ্চিত শিশুর মনে হীনমন্যতা ও প্রতিশোধের চিন্তা কাজ করবে৷ ওদিকে সুবিধাপ্রাপ্ত সন্তানের মনে এই আশা জাগিয়ে তুলবে যে আমি একই ভুল বার বার করতে পারি। 

তাদের উভয়পক্ষের কথা মনযোগ দিয়ে শুনতে আপনাকে যথেষ্ট ধৈর্য্যশীল হতে হবে। এই সময়ে নিশ্চিত হতে হবে তাদের ক্রোধ যথেষ্ট পরিমাণে প্রশমিত৷  তাদের দৃষ্টিভংগীর পূর্ণ বিশ্লেষণ ব্যাতিরেকে আপনি সিদ্ধান্ত দিতে যাবেন না। 

কৌশলী হতে হবে এজন্য যে, আপনার ফয়সালা এমনভাবে হতে হবে যা তাদের উভয়পক্ষকে সন্তুষ্ট করে৷  তাদের সাথে আলাদা আলাদাভাবে কথা বলতে হবে৷  তাদের কলহ থেকে বের হওয়ার পূর্ণ উপায়টাও শিখিয়ে দিতে হবে। দেখা যাবে সময়ের সাথে সাথে তারা একসময় নিজেরাই নিজেদের কলহ শান্তিপূর্ণ  উপায়ে মিটমাট করতে সক্ষম হয়ে উঠবে । 

মেজাজ ঠান্ডা করে তাদের উভয়পক্ষের কথা শুনুন। প্রত্যেককে সমান সময় দিন। ছোট সন্তানের মুখে দ্বন্দ্বের কাহিনি শুনেই তা বিশ্বাস করে ফেলবেন না, বড় সন্তানের মুখ থেকেও ঘটনাটা শুনুন।

শিশুদের মাঝে হয়ে যাওয়া ঝগড়া নিয়ে পরবর্তীতে দীর্ঘসময় ব্যাপী আলোচনা করবেন না। আপনার সেই আলোচনা শুনে শিশুরা ভাববে তারা “ঝগড়া কেন্দ্রিক মনোযোগ” পাচ্ছে! যেটা তাদেরকে পরবর্তীতে বরং ঝগড়া করতে আরো উৎসাহিত করতে পারে!

যে সব কথা বলা থেকে একেবারে বিরত থাকবেন: 

  • ঝগড়া বন্ধ করো, এগুলো আমার সহ্য হচ্ছেনা। 
  • তোমাদের ছোটখাট সমস্যা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করবে না 
  • কে দোষ করেছে সেটা আমার বিষয় না, দুইজনেই শাস্তি পাবে। 
  • ঝগড়ার সমাধান না করে ভয় দেখিয়ে সেটাকে থামানোর চেষ্টা করবেন না। “ঝগড়া বন্ধ না করলে তোমাদের বাবা/মাকে কিন্তু বলে দেব!” এধরনের কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন।
  • “কে আগে মারামারি শুরু করেছে?” এধরনের কথাও বলবেন না। কারণ উত্তর যা-ই আসুক না কেন, সেটা আপনারই সন্তান হবে! তাই কে আগে ঝগড়া শুরু করেছে, এটা জেনে কোনো উপকার হবে না। তারচেয়ে বরং সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করুন।

মনে রাখবেন, বাচ্চাদের ছোট বলে এড়িয়ে যাবেন না৷ তাদের প্রতিটি ঘটনা ভবিষ্যতের মন মানসিকতা তৈরীতে ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে তাদের আবেগ ও চাহিদাকে সুনিপুনভাবে যোগ্য ঠিকানায় পৌছানোর দায়িত্ব আপনার।  তবেই আপনার পরিবারে সুখ শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। 

কিভাবে সহোদরদের মধ্যে বা পুরো পরিবারে সম্প্রীতি বজায় রাখবেন

পারিবারিক পরিবেশ, আবহ যদি কোলাহলময় ও দ্বন্দ্বপূর্ণ হয়ে থাকে তবে ভাইবোনদের মধ্যেকার সম্পর্কেও তা ফুটে উঠে। সমস্যা যেরকমই হোক, কিছু বিষয়ের চর্চা পরিবারে জারী রাখলে তা খুব সহজেই কাটিয়ে উঠা যায়। সেগুলো নিয়েই আলোচনা করব এখন। 

সন্তানদের সময় দিন 

আপনি আপনার সন্তানদের সম্পর্ককে সুন্দর করতে শিশুকে সবচেয়ে দামী যে জিনিসটি উপহার দিতে পারেন সেটা হল সময়। তাদের আলাদাভাবে কিছুটা সময় দিন। দিনে কমপক্ষে ১০ মিনিট তাদের কথা, অভিযোগগুলো মনযোগ দিয়ে শুনুন।  মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করুন। এই সময়ে তাদের ইতিবাচক চিন্তায় প্রভাবিত করতে পারেন কৌশলে। যেমন ধরুন বলা হল,  নিজের ভাই/ বোনের ১০ টি ভাল দিক তুলে ধরতে৷ কেন সে বাকিদের চাইতে ভাল তা তুলে ধরতে। এভাবে মাঝে মাঝে তাদের এগুলো স্মরণ করিয়ে দিলে ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কে আন্তরিকতা ও সম্মানবোধ তৈরী হবে । 

ঝগড়া করলেই শিশুদেরকে ঘৃণা করবেন না বা তাদেরকে অবহেলা করবেন না। তাদেরকে বোঝাবেন, যা-ই হোক না কেন বাবা-মা তাদের পাশে আছে, তাদেরকে ভালবাসে।

সব শিশু এক নয়। প্রত্যকের চাহিদা এবং পছন্দ ভিন্ন, যা অভিভাবক হিসাবে জানা আপনার কর্তব্য। সপ্তাহে একদিন হলেও, সন্তানদের প্রত্যকেকে আলাদা সময় দিন, যেখানে সে নিজের গোপন কথা বলতে পারবে ও আপনার পূর্ন মনোযোগ পাবে।

[ আরও পড়ুনঃ বাচ্চার সাথে সুন্দর সময় কাটানোর ১০ টি টিপস ]

তুলনা এড়িয়ে চলুন

কখনোই আপনার একটি সন্তানকে তার ভাই বোনের সাথে তুলনা দিয়ে হেয় করার মত ভুল করবেন না।  এতে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতা তৈরী হয়৷  ভালো কাজে প্রতিযোগী মনোভাব তাদেরকে উৎসাহিত করলেও প্রতিদ্বন্দ্বীতা হিংসাত্মক চিন্তায় প্ররোচিত করে। এক্ষেত্রে তারা নিজেকে সামনে এগিয়ে নেয়ার বদলে আরেকজনকে পিছনে ফেলা বা ক্ষতির চিন্তা করতে থাকে। 

ভাইবোনদের মধ্যেকার ভিন্নতাকে উৎসাহিত করুন।  তাদের সাফল্য যত ক্ষুদ্রই হোক ,  তা সেলিব্রেট করুন।  ব্যার্থতায় তাদের পাশে বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে দিন। 

শিশুদেরকে তাদের জন্মের ক্রমায়ন্বয় বিবেচনা করে মূল্যায়ন করুন। পরিবারে থাকা সব শিশুর স্বভাব এক হবে না। এটা মাথায় রাখুন।

গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করুন 

অনেক বাবা মা যথেষ্ট ইতিবাচক হওয়া সত্ত্বেও সমস্যাগুলোর সমাধান হয়না। এক্ষেত্রে বাচ্চাদের ঝগড়ার সময়টা খেয়াল রাখুন। ঘুম থেকে উঠার পর কি এমনটা হয়? নাকি দুপুরে? নাকি সন্ধ্যায় খেলাধূলা থেকে ফিরে এসে? এক্ষেত্রে কারণটা হতে পারে ক্ষুধা বা ক্লান্তির কারণে মানসিক স্ট্রেস।  সে অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিন।

তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সমতা ও সুবিচারের মাধ্যমে সমাধান করুন৷ অনেক সময় অভিভাবকরা বড় সন্তানের উপর দোষ চাপিয়ে ছোটটাকে ছাড় দেন৷ অথবা এমনটা বলেন যে, তুমিও ওর মত বয়সে এই কাজ করেছ। অথচ এইসব কথাবার্তা সন্তানের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং পরিণামে ঝামেলা আরো বাড়তে থাকে।    

নিয়মিত পারিবারিক মিটিং

পারিবারিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করার মাধ্যমে ভাইবোনদের মধ্যে ভালবাসার অটুট বন্ধন তৈরী হয়৷ এক্ষেত্রে নিয়মিত পারিবারিক মিটিংগুলো বেশ ভূমিকা রাখে৷  রাতে সবাই একসাথে বসে সারাদিনের ভালো ও মজার মূহুর্ত নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। বয়স অনুযায়ী কার কি প্রাপ্য,  কি করণীয় তা বুঝিয়ে বলা যেতে পারে।  ছোটদের সাধারণত ধারণা থাকে যে সে ছোট বলেই তাকে বঞ্চিত ও অবহেলা করা হচ্ছে।  এ ধরণের নিয়মিত মিটিং এর ফলে ভুল ধারণাগুলো কেটে যাবে। 

অনেকসময় পারিবারিক মিটিংগুলোতে দেখা যায়,  বড়রাই কেবল কথা বলে যাচ্ছেন।  তাতে বিষয়টা অনেকটা ক্লাসের মত হয়ে যায়। অথচ এখানে ছোটদের কথাকেও গুরুত্ব দিতে হবে৷  সবাইকে কথা বলার জন্য সমান ভাবে সময় ও সুযোগ দিতে হবে৷ কেউ যেন নিজেকে পারিবারিক আলোচনায় অবাঞ্চিত না ভাবে। 

যমজ বাচ্চা ও তাদের দ্বন্দ্ব

বয়সে ছোট বা বড় ভাই-বোনদেরকে নিয়ে আলাপ করা হলেও যমজ বাচ্চাদেরকে নিয়ে কোনো আলাপ করা হয়নি। বিষয়টা অনেক বাবা-মায়ের কল্পনাতেও থাকে না। নিজেদেরকে যমজ সন্তানের বাবা-মা হিসেবে কল্পনা করা অভিভাবকদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তাই হঠাৎ করে যমজ সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে অনেক বাবা-মা একই সাথে দুটো বাচ্চা নিয়ে রীতিমতো হিমসিম খান।

অন্য সিবিলিংদের মতো যমজ বাচ্চারাও একের অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে, দ্বন্দ্বে জড়ায়। অবশ্য যমজ হওয়ায় ওরা একে অন্যের ওপর বেশ নির্ভরশীলও হয়ে থাকে। অন্য সিবিলিংদের তুলনায় যমজ সিবিলিংরা একে অন্যের সাথে দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব থেমে যায় না।

সাধারণত যমজ বাচ্চাদেরকে এক ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুটো বাচ্চার পছন্দ-অপছন্দ ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু অভিভাবকগণ দু’জনকে একই রঙের, একই ডিজাইনের পোশাক কিনে দেন, দু’জনকে একই রকম দেখতে খেলনা কিনে দেন ইত্যাদি। এটা ঠিক নয়। কোন বাচ্চা কী পছন্দ করে, অভিভাবকদের সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। প্রত্যেকটি শিশুর নিজস্ব রুচি, পছন্দ, ব্যক্তিত্বকে মেলে ধরা সুযোগ করে দেওয়া উচিত।

যদি পরিবারে যমজ বাচ্চাদের সাথে আরো এক বা একাধিক ছোট বা বড় সন্তান থাকে তাহলে তাদের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। বাবা-মা স্বাভাবিকভাবেই যমজ বাচ্চাদেরকে নিয়ে এত বেশি উৎফুল্ল ও মনোযোগী হয়ে ওঠেন যে, পরিবারের অন্য সন্তান বা সন্তানেরা ঈর্ষাবোধ করে। বাবা-মায়ের উচিত সবার প্রতি লক্ষ্য রাখা। কেউ যেন নিজেকে একা ভাবতে না পারে, নিজেকে অবহেলিত ভাবতে না পারে; সেটা খেয়াল রাখা। নইলে তাদের অলক্ষ্যে সিবিলিংদের মাঝে ধীরে ধীরে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। যা মোটেও কাম্য নয়।

শেষ কথা

বাচ্চারা ঝগড়া করবেই। এটা আপনি যত চেষ্টাই করুন না কেন, একেবারে বন্ধ করতে পারবেন না। বাচ্চারা ঝগড়া করছে, মারামারি করছে বলে নিজেকেও দোষারোপ করবেন না। বাচ্চাদের মাঝে ঝগড়া হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে আপনাকে লক্ষ্য রাখতে হবে, সেই ঝগড়া যেন সহনীয় মাত্রাকে অতিক্রম না করে। মাত্রাতিরিক্ত গণ্ডগোল বাসার এবং পরিবারের শান্তি নষ্ট করে। 

বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণহীন ঝগড়ার পেছনে পারিবারিক কারণ থাকতে পারে। বিভিন্ন সমস্যা, দ্বন্দ্ব, ইস্যু ইত্যাদি পরিবারের বড়রা কীভাবে সমাধান করে, প্রথমে সেদিকে নজর দিতে হবে। তারপর অভিভাবকদের কাজ হবে ছোট ছোট কৌশল অবলম্বন করে বাচ্চাদেরকে মিলেমিশে বাঁচতে, খেলতে সহায়তা করা।

তবে হ্যাঁ, কোনোভাবেই যদি বাচ্চাদের ঝগড়া নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সেক্ষেত্রে শিশু-রোগ বিশেষজ্ঞ কিংবা ফ্যামিলি থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।  

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment