এখনো কি শিশুদের হাম হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু আছে?
১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ১ বছরের নিচে সকল শিশুদের হামের (measles or rubeola) টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। হামের টিকা দেওয়া থাকলে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা অনেকটা কমে যায় তবুও উন্নত দেশগুলোতে যে হারে হামের সংক্রমণ কমে গিয়েছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কিন্তু হাম এখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি বরং সারা বিশ্বজুড়ে এখনও হাম বেশ বড় একটি হুমকি বলা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, সারা বিশ্বজুড়ে ৩০ মিলিয়নের বেশী মানুষ প্রতি বছর হামে আক্রান্ত হয়। ২০০৬ সালে, দুই লাখ ৪২ হাজার মানুষ হামে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় যার অধিকাংশই ছিল শিশু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের জুলাই মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, হামের প্রকোপে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। যদিও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে বর্তমানে দেশের ৮২ শতাংশ শিশুকে টিকাদান কর্মসূচীর আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে, তবুও দেশের বিভিন্ন যায়গায় কয়েক বছর পর পরই হাম মহামারি রূপ ধারণ করে। তাই হামের মতো প্রাণঘাতী রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেই হবে।
শিশুর হাম কিভাবে হয়?
হাম একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাস আক্রান্ত কারো হাঁচি ও কাশি থেকে জীবাণুমিশ্রিত ছোট ছোট জলকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে যা অন্তত ২ ঘন্টা সক্রিয় থাকে। এখন এই সময়ের মধ্যে এর সংস্পর্শে এসে কেউ নিঃশ্বাস নিলে, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে জীবানু শরীরে প্রবেশ করে।
আপনার শিশুকে যদি হামের টিকা না দিয়ে থাকেন, এবং তার পূর্বে কখনো হাম না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এই ভাইরাসে আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এলে আপনার শিশুর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০%। ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সেটা অসুখে রূপ নিতে ৬ থেকে ২১ দিন (সাধারণত ১৪ দিন) পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে হামের ফুসকুড়ি উঠার ৫ দিন আগে থেকে ৪ দিন পর পর্যন্ত সে সংক্রামক হিসেবে কাজ করে। এই সময়ের মধ্যে সুস্থ কেউ তার সংস্পর্শে আসলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
হামের উপসর্গগুলো কি কি?
শিশুর হাম হলে, প্রথমে বেশ জ্বর দিয়ে শুরু হবে, নাক দিয়ে পানি পড়বে, কাশি থাকবে, চোখ লাল হয়ে ফুলে যাবে, কালশিটে দাগ দেখা যাবে।
দু একদিনের মধ্যেই গালের ভিতরে শ্লেষ্মা ঝিল্লীতে সাদা সাদা দাগ (Koplik’s spots) পড়ে। জ্বর হওয়ার কয়েক দিন পর, শিশুর মুখে ও ঘাড়ে লালচে ফুসকুড়ি দেখা দেয় যা ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। র্যাশগুলো প্রথমে লাল ছোপ ছোপ থাকলে পরে ছোট দানাদার হয়ে দেখা দেয়।
ফুসকুড়ি দেখা যাওয়ার পর, জ্বরও ধীরে ধীরে বেশ বাড়তে থাকে। কখনো কখনো সেটা ৪০.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস/১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে। র্যাশে চুলকানিও হতে পারে।
হাম হওয়ার কদিনের মধ্যেই আপনার শিশু বেশ রুগ্ন এবং শরীরের ব্যাথায় বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়বে। কাশিটাও তাকে বেশ যন্ত্রণা দেবে। সর্বোপরি, শিশু করুণ অবস্থায় পড়ে যাবে। ফুসকুড়িগুলো প্রায় ৫ দিনের মতো স্থায়ী থাকে এবং পরে ত্বকের সাথে মিশে খয়েরি রঙ ধারণ করে নিঃশ্বেষ হয়ে যায় এবং ত্বক তখন বেশ শুকনো এবং খসখসে হয়ে যায়।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কিভাবে পরিমাপ করবেন ? ]
হাম হলে শিশু বড়সড় কি কি জটিলতায় পড়তে পারে?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু বড় কোন জটিলতা ছাড়াই হাম থেকে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে। ২০% থেকে ৩০% কেসের ক্ষেত্রে,শিশু কিছু জটিলতায় পড়তে পারে, যেমন – ডায়রিয়া কিংবা কানের ইনফেকশন ইত্যাদি।
হাম হলে শিশু আরো কিছু জটিলতায় পড়তে পারে, যেমন নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, encephalitis (মস্তিষ্কে প্রদাহ) প্রভৃতি। এছাড়া মস্তিষ্কের জটিল কোন সমস্যাও দেখা দিতে পারে, তবে সেটা সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। শিশুরই হোক বা বড়দের, ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে এই রোগ ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
হামে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা কেমন হবে?
আপনি যদি সন্দেহ করেন যে হয়তো আপনার শিশুর হাম হয়েছে, সাথে সাথে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চলে যান। যখন কোন ডাক্তারের কাছে হামের রোগী আসে, ডাক্তার অবশ্যই সরকারি নথিপত্রে তা টুকে রাখার ব্যাবস্থা করেন। তাই হাম নিয়ে সন্দেহ থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
ডাক্তার যদি নিশ্চিত করে যে আপনার শিশুর হাম হয়েছে, তারপর আসলে আপনার খুব বেশী কিছু একটা করার সুযোগ নেই। শিশুকে যথাসম্ভব আরাম দেওয়ার চেষ্টা করুন। যখন তার শরীর ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছে, এমন সময়ে তাকে অন্যান্য শিশুদের থেকে দূরে দূরে রাখুন। জ্বরের মধ্যে ডিহাইড্রেশন থেকে মুক্ত থাকতে সে যথেষ্ট বিশ্রাম ও পানি পাচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিত হোন।
জ্বর ও ব্যাথা থেকে মুক্তি দিতে আপনার শিশুকে ইনফ্যান্ট প্যারাসিটামল (যদি তার বয়স এক মাসের বেশী হয়ে থাকে) কিংবা ইবোপ্রোফেন (যদি তার বয়স তিন মাসের বেশী হয়) খাওয়াতে পারেন। তবে অবশ্যই সঠিক ডোজটা ডাক্তারই ঠিক করে দেবেন। কখনোই শিশুকে এসপিরিন দেবেন না কারণ এটা ‘Reye’s syndrome’ নামক প্রানঘাতী মারাত্মক রোগের দিকে আপনার শিশুকে নিয়ে যেতে পারে।
কাশির ঔষধ আসলে কাজ করে, এমন কোন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না, বরং ছয় বছরের নিচের শিশুদের জন্যে কাশির ঔষধ ক্ষতিকর হতে পারে। তার পরিবর্তে, বড় গামলায় গরম পানি এনে শিশুর রুমে রেখে দিন, এতে করে রুমের আদ্রতা বাড়বে, এটা বরং আপনার শিশুকে কাশি থেকে আরাম দিতে পারে।
একটু বড় শিশুর ক্ষেত্রে এক টেবিল চামচ লেবুর জুস এবং দুই চা চামচ মধু এক গ্লাস গরম পানিতে মিশিয়ে খাইয়ে দিলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। তবে এক বছরের নিচের শিশুদের কোনভাবেই মধু খাওয়ানো যাবে না।
হামে আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। আর একটু পরপর ভেজা তোয়ালে বা গামছা বা নরম কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। হাম হলে রোগীকে পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে হয়। এ সময় বাসা থেকে বের না হওয়াই ভালো।
হাম নিরাময়ে এন্টিবায়োটিক কোন কাজ করে না, তবে অন্যান্য কোন সমস্যা হলে যেমন কানের ইনফেকশন- সেক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক লাগতে পারে।
শিশু হাম আক্রান্ত ব্যাক্তির সংস্পর্শে এসে থাকলে, তাকে যাতে রোগ সংক্রমিত না করে, তার প্রতিরোধমূলক কোন ব্যাবস্থা কি আমি নিতে পারি?
আপনার শিশুকে যদি এখনো এমএমআর ভ্যাকসিন দেওয়া না হয় এবং সে কোনভাবে ভাইরাস সংক্রমিত ব্যাক্তির সংস্পর্শে আসে, সেক্ষেত্রে তার মধ্যে যাতে হাম সংক্রমিত না হতে পারে, সেজন্যে শিশুর বয়সের উপর নির্ভর করে আপনার করণীয়গুলো ঠিক করতে হবে।
আপনার শিশুর বয়স যদি ছয় মাসের কম হয়ে থাকে এবং আপনি যদি হামের টিকা দ্বারা সুরক্ষিত থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার শরীরের যে এন্টিবডি গর্ভাবস্থায় শিশুর শরীরেও গিয়েছে, সেগুলো দিয়েই সে সুরক্ষিত থাকবে।
ছয় মাস বয়সের পর, আপনার শরীর থেকে পাওয়া এন্টিবডিগুলো খুব একটা শক্তিশালী থাকে না, তাই ৬ থেকে ৯ মাস বয়সী শিশু যদি হাম সংক্রমিত কারো সংস্পর্শে এসে পড়ে, সেক্ষেত্রে তাকে হাম প্রতিরোধের জন্যে ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন দেওয়া হয়। শিশুর হাম সংক্রমিত ব্যাক্তির সংস্পর্শে আসার সাত দিনের মধ্যে এই ইনজেকশন দিতে হয়।
আপনার শিশুর বয়স যদি ৯ থেকে ১২ মাস হয়, সেক্ষেত্রে তাকে এমএমআর ভ্যাকসিন দেওয়া যায়। যদি সম্ভব হয়, হাম সংক্রমিত কারো সংস্পর্শে আসার ৭২ ঘন্টার মধ্যে এই ভ্যাকসিন দিলে ভাল কাজ করে। এর পর ১২ মাসের সময়, সাধারণ নিয়ম মাফিক বুস্টার হিসেবে দ্বিতীয়বার শিশুকে এমএমআর ভ্যাকসিন দিতে হয়।
কিভাবে হাম প্রতিরোধে ব্যাবস্থা নিতে পারি?
টিকা। শিশুর বয়স ১২ মাস হলে, তাকে নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই এমএমআর (MMR) ভ্যাকসিন দিতে হবে। এর মাধ্যমে শিশুকে হাম-রুবেলা থেকে ৯০%-৯৫% পর্যন্ত সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। শিশুর বয়স ১৮ মাস হলে, তাকে সেকেন্ড ডোজ (বুস্টার) দিতে হবে যা শিশুকে ৯৯% পর্যন্ত সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হবে। এই কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সকল দেশসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে দুই ডোজের এমএমআর ভ্যাকসিন দিতে বলা হয়ে থাকে।
অনেক অভিভাবক শিশুদের হামের টিকার ক্ষেত্রে এক ডোজ দেওয়ান। দুই ডোজ দেওয়ান না। আবার টিকার কোনো গলদ বা দেওয়ার সময় পদ্ধতিগত ভুলের কারণেও এই টিকা কার্যকারিতা হারাতে পারে।
টিকা দেওয়ার পদ্ধতিতে ভুল থাকলে কিংবা সরকারি অনুমোদনহীন কোনো হাসপাতাল থেকে টিকা দিলেও এর কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে। তবে টিকা দেওয়ার পরও হাম হয়ে গেলে এ নিয়ে খুব চিন্তিত হবেন না। এর চিকিৎসা বা জটিলতা সাধারণ হামের মতোই।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর টিকা । প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ ]
হামের ভ্যাকসিন কি জীবন্ত ভ্যাকসিন?
এমএমআর(MMR) ভ্যাকসিনকে live-attenuated ভ্যাকসিন বলা হয়। এটা এক ধরণের জীবন্ত ভাইরাস যাকে বেশ কিছুটা দুর্বল করে শরীরে প্রবেশ করানো হয় যাতে তা শরীরের কোন ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু এর উপস্থিতিতে শরীর এর প্রতিরোধী ইমিউন ব্যাবস্থা গড়ে তোলে। যখন শরীর কোন আসল হামের জীবানুর মুখোমুখি হয়, তা থেকে এটা শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। হাম-রুবেলা থেকে সুরক্ষিত থাকতে এই ভ্যাকসিনই সর্বোত্তম ও একমাত্র প্রতিরোধক।
সবার জন্য শুভকামনা।