শিশুর বেড়ে ওঠা । চতুর্থ মাস
তিন মাস থেকে চার মাসে পদার্পণ করার সময় ধীরে ধীরে আপনার বাবু চারপাশের বিভিন্ন জিনিসের দিকে আরো বেশী কৌতূহলী হবে, রঙিন এবং সচল জিনিসপত্রের প্রতি আকৃষ্ট হবে। এসময় তাকে নিরাপদ বিভিন্ন সফট-টয় , শব্দ যুক্ত খেলনা যেমন র্যাটল বা ঝুনঝুনি জাতীয় খেলনা দেবেন।
মোবাইল এবং অন্যান্য ডিভাইসের রঙিন ছবি এবং মিউসিকের প্রতি শিশু আকৃষ্ট হবে, তবে, এসব ডিভাইস থেকে বাচ্চাদের যথাসম্ভব দূরে রাখতে হবে তাদের সঠিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য। মনে রাখবেন, এসব ডিভাইসের র্যাডিয়েশান মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
চার মাসে পদার্পণের পর আপনার শিশুর শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি অনেকাংশেই গঠিত হয়ে যায়। এসময় সে বিভিন্ন রঙের পার্থক্য করতে শেখে।
চার মাস বয়সে বাচ্চার খাবার
এসময় থেকে আপনার বাবুর খাবারের চাহিদা বেড়ে যাবার কথা। আস্তে আস্তে ওজন ও আগের চেয়ে বাড়ার কথা। এসময় প্রতিবার খাবার সময় পরিমানে বেশী খাবে, তবে একবার খাবার সময় থেকে পরের বার খাবার সময়ের মধ্যবর্তী গ্যাপ বাড়তে থাকবে। কারণ তার পাকস্থলী এসময় থেকে কিছুটা বড় ও পরিপক্ব হবার দিকে অগ্রসর হয়।
চার থেকে ছয় মাসে পর্যন্ত আস্তে আস্তে তার পাকস্থলী সলিড খাবারের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে, এক এক বাচ্চার ডেভেলপমেন্ট এক এক রকম , তাই অন্ততপক্ষে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ মাসের আগে সলিড/ সেমি সলিড শুরু না করাটাই শ্রেয়। ছয় মাস থেকে সেমি সলিড/ সলিড শুরু করার জন্যই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া হয়। এর আগ পর্যন্ত মায়ের দুধ এবং ক্ষেত্র বিশেষে বয়সানুজায়ি ফর্মুলা দুধ বাচ্চার খাদ্য ও পানীয়ের চাহিদা মেটায়।
চার মাস বয়সে বাচ্চার শারীরিক পরিবর্তন
তিন থেকে চার মাসের যেকোনো পর্যায়ে বাচ্চা আপনাকে অবাক করে দিয়ে উপুড় হতে এবং গড়িয়ে যেতে শুরু করবে। যেহেতু শিশু হুট করেই গড়াতে এবং উল্টাতে শুরু করে, তাই আপনাকে দু-তিন মাস হওয়ার সময় থেকেই খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন উঁচু কোন জায়গা বা বিছানায় বাচ্চাকে অরক্ষিত রাখা না হয়। সবচে’ ভালো হয়, দিনের বেলা যখন আপনাকে এদিক ওদিক যেতে হয় বিভিন্ন কাজে, সেসময় মেঝেতে পরিস্কার তোশক কিংবা ম্যাট বিছিয়ে বাবুকে রাখলে।
বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধির জন্য বাচ্চা্র জন্য যথেষ্ট বুকের দুধ নিশ্চিত করুন। দিনে এক-দুইবার এই বয়সী বাচ্চার জন্য উপযোগী ব্যায়াম ও মুভমেন্ট করান। যেমন বাচ্চার হাত- পা একটু টানটান করে পেটের উপর আনুন, লক্ষ্য করুন, সে নিজে থেকে তার হাত পা আগের জায়গায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে কিনা, কিংবা পারছে কিনা।
চার থেকে পাঁচ মাসের দিকে বাচ্চার ঘাড় বেশ অনেকটা গঠিত হয়। এসময় তাকে হাতে নিয়ে দাড় করানোর ভঙ্গি করলে নিচের দিকে পা ছুঁড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। এসময় তার ঘুমের সময় বাড়বে , সুখবর হোল, রাতে কয়েক ঘণ্টা টানা ঘুম দেয়াও শুরু হয়ে যেতে পারে।
শিশুর দাঁত উঠছে?
প্রায় ৬ মাস বয়সে বেশির ভাগ শিশুর প্রথম দাঁত ওঠে৷ তবে শিশুদের ৩ মাস এবং ১ বছর সময়ের মধ্যে যে কোনো সময় দাঁত গজাতে পারে৷ সাধারণত, সামনের দিকে, নিচের পাটিতে প্রথম দাঁত দেখা যায়৷
যদি আপনার শিশুর দাঁত গজায় তাহলে এই লক্ষণগুলি দেখতে পাবেন:
- মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যায় এবং মুখ ও গাল লাল হয়ে ওঠে
- মুখ দিয়ে সমানে লালা ঝরে
- যেদিকে দাঁত উঠছে ও সেদিকের মাড়ি ও কান ঘষার চেষ্টা করে
- যন্ত্রণায় রাতে ঘুম ভেঙে যায়
আপনার শিশুর দাঁত ওঠার পর থেকেই ওর দাঁত মাজা শুরু করে দেওয়া ভাল৷ নরম টুথব্রাশ ও যদি টুথপেস্ট থাকে, ব্যবহার করুন৷ আপনার শিশুর দাঁত ও মাড়ি দুইয়ের উপরিভাগ পরিষ্কার করে দেওয়ার চেষ্টা করুন৷
কিছু শিশুর দাঁত ওঠার সময় খেতে কষ্ট হয়৷ বুকের দুধ খাওয়ার সময় চুষতে গিয়ে ফোলা মাড়িতে আরো রক্ত এসে পড়ে৷ এই সময় মাড়ি খুব স্পর্শকাতর থাকে৷ তাই ও হয়ত আপনার বুকের দুধ খেতে চাইবে না৷ স্পষ্টত, দাঁত ওঠার সময় শিশুরা বিরক্ত বোধ করে ও অস্থির হয়ে পড়ে৷ ওকে আদর করে শান্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করুন৷
আপনার শিশুর দাঁত ওঠার সমস্যার নিরাময়ের জন্য মধু ব্যবহার করবেন না৷ বরং ওকে চিবানোর জন্য পরিষ্কার, নরম কিছু দিন৷ ঐসব জিনিস এত ছোট হওয়া উচিত নয় যে গিলে ফেলা যায় বা এত নরম হওয়া উচিত নয় যে টুকরো হয়ে যায়৷ এমন জিনিস তার গলায় আটকে যেতে পারে৷
শিশুর প্রথম বুলি!
জন্মের মুহূর্ত থেকেই আপনার শিশু কথা বলতে শিখছে৷ ওর কান্নাই ওর প্রথম কথার ভঙ্গী৷ খিদে পেলে, অস্বস্তিবোধ করলে, বা ক্লান্ত হলে ও কেঁদে জানায়৷ বড় হওয়ার সাথে সাথে আপনার শিশু আপনার ও তার আশেপাশের লোকদের কথাবার্তা শুনে আপনাদের নকল করার চেষ্টা করে৷ ও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়!
এসময় বাচ্চা আপনার মুখের বিভিন্ন ভাব-ভঙ্গি খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা শুরু করবে এবং সবচে মজার ব্যাপার সে তার মতো করেই আপনার কথার প্রতিউত্তর দেয়ার চেষ্টা করবে। যেমনঃ ‘আপনি বললেন, আমার ময়না পাখি কি করে?’ সেসময় আপনি ঠিক তার চোখের সামনে না থাকলে সে ঘাড় এবং মুখ ঘুড়িয়ে শব্দের উৎস খুঁজবে , এটা যে আপনার গলার আওয়াজ এটাও বুঝতে পারবে, এবং কু- কু, কিংবা ও- ও, কিংবা দা-দা করে আপনার সাথে কথোপকথন চালাতে শুরু করবে।
আপার শিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে যতটা সম্ভব ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ অন্যদের ও অন্য কিছুর ব্যাপারে কথা বলার সময় ঐদিকে আঙুলের ইশারা করে দেখান৷ ৩ এবং ৪ মাসে, শিশুর কান্না কম হবে ও নানা রকম শব্দ করতে শুরু করে৷ ও নিজের নাম চিনতে শুরু করে৷ একটু দূর থেকে ওর নাম ধরে ডাকুন ও সাড়া দেয় কিনা দেখুন৷
পরিশিষ্ট
মায়ের নিজের শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখবেন, সুস্থ ও হাসি-খুশি মা-বাবা এবং সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ বাচ্চার মানসিক গঠনে অনেকটুকু ভুমিকা রাখে। বাচ্চার দেখাশোনা করার সাথে সাথে এখন থেকে নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতিও নজর দিন। নিজেদের অনেক চাওয়া পাওয়া হয়তো এই সময় বিসর্জন দিতে হয়, তবে তা ছোট্ট ফুটফুটে সন্তানের তুলনায় নগন্য। তাই, স্বামী স্ত্রী যথাসম্ভব একে অন্যের পাশে থাকুন।
এক একটি বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক গঠন এক এক রকম , সুতরাং তাদের বৃদ্ধিতেও তারতম্য হবে। প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চা হলে, তাদের বৃদ্ধি কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে। আপনার বাচ্চার বৃদ্ধি ঠিকমত হচ্ছে কিনা বোঝার জন্য একই বয়সের অন্য একটি বাচ্চার সাথে তুলনা না করে , কিছু মাইলফলক অনুসরন করতে পারেন, এবং কোন কিছু অস্বাভাবিক মনে হলে, অবশ্যই এক্সপার্ট ও ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
মাইলস্টোন- চতুর্থ মাস
- অন্যদের সাথে হাঁসতে শুরু করে
- খেলতে পছন্দ করে, খেলা বন্ধ হলে কান্না শুরু করে।
- গলার আওয়াজ অনুকরন করার চেষ্টা করবে।
- ব ধ্বনি দিয়ে শব্দ তৈরী করা শুরু করে যেমন বাব্বা, আব্বা, বু…, বেবে ইত্যাদি।
- ক্ষুধা, ব্যাথা বা ক্লান্তির জানান দিতে হয়তো ভিন্নভাবে কান্না শুরু করবে।
- শিশু হাসবে, কিছু বলার চেস্টা করবে।
- এখন শিশুরা গড়াগড়ি খায়, আকর্ষনীয় জিনিসের দিকে নিজে এগিয়ে যায়
- পেটের উপর শুয়ে থাকলে বুক ও মাথা উপরে তুলতে পারে।
- দাঁর করালে পায়ের উপর ভর দিতে পারে
- অন্যদের মুখভঙ্গী দেখে অনুভুতি পড়ার চেষ্টা করা শুরু করে।
- মা অথবা যিনি সর্বাধিক যত্ন নেন (খাবার খেতে দেন) তার সাথে অন্যদের পার্থক্য করতে শেখে।
- উজ্জ্বল রঙের বস্ত ও এর নড়াচড়ার দিকে খেয়াল করে এবং সাড়া দেয়।
- শব্দের দিকে ঘুরে তাকায়।
- অন্যের চেহারার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়।
- আপনি তার দিকে তাকিয়ে হাসলে সেও ফিরতি হাসি দেয়।
বিপদ চিহ্ন:
- জড়সড় বা নিস্তেজ থাকা।
- চলন্ত কিছুর দিকে দৃস্টি না দেয়া।
- মাথার ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারা
- কারও দিকে তাকিয়ে না হাঁসা।
- আকর্ষনীয়কিছু দেখলে আগ্রহী না হওয়া
- কোন ধরনের শব্দ না করা
- দাঁর করিয়ে দিলে পায়ে ভর দিতে না পারা।
- কোন কিছু হাত দিয়ে মুখের কাছে না আনা
এ সময় কি কি মাইলস্টোন আপনার শিশু অর্জন করতে যাচ্ছে তা জানার সাথে সাথে ভুলে যাবেন না যে এট শুধু মাত্র একটা গাইডলাইন। প্রতিটি শিশুই ইউনিক ( স্বকীয় ) এবং তার বেড়ে ওঠার গতিও ভিন্ন।
যে শিশুটি অন্যদের থেকে প্রথমে বসতে শিখেছে সে হয়ত সবার শেষে হামাগুড়ি দিতে শিখবে। অথবা ১৮ মাস বয়সী যে শিশুটি শব্দ ও অঙ্গাভঙ্গির মাধ্যমে এখনো ভাবের আদান প্রদান করছে সে হটাৎ করেই দুই বছর বয়সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্য বলা শুরু করতে পারে।
এই টাইমলাইন সিরিজ যেন আপনার কোন রকম দুঃশ্চিন্তার কারন না হয় খেয়াল রাখবেন। প্রতিটি টাইমলাইনকে একটি গাইড হিসেবে ধরে নিতে হবে ।নবজাতক এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।