শিশুর বেড়ে ওঠা | তৃতীয় মাস

Spread the love

জন্মের পরপরই নবজাতক শরীরের ঘ্রাণ ও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে মাকে চিনতে পারলেও তার অনুভূতি সেভাবে প্রকাশ করতে শেখেনা। তৃতীয় মাসের দিকে এসে বা দুই মাস অতিক্রম করার পর মা, বাবা কিংবা প্রিয় কোনো  মুখ দেখে সে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে শুরু করে। হয়তো সে অপরিচিত কারো সাথেও হাসবে যারা তার সাথে হাসে বা কথা বলে কিন্তু সে তার প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে হাসি বা উত্তেজনার মাধ্যমে তার অনুভূতি প্রকাশ করবে। এবয়সী প্রায় অর্ধেক শিশুই এ সময় বাবা মাকে দেখলে বা তাদের গলা শুনলে প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে।

এ মাসে শিশুর মস্তিষ্কের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হতে থাকবে যার ফলে তার আচরণগত অনেক পরিবর্তন হতে থাকে। চলুন জেনে নেই তৃতীয় মাসে শিশুর বেড়ে ওঠা কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে।

বিজ্ঞাপণ

তৃতীয় মাসে শিশুর খাবার

শিশু তৃতীয় মাসে পা দেয়ার পর তার প্রতিবার খাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান আগের চাইতে কিছুটা বেশি হতে পারে। এই সময় অনেক শিশুরই খাওয়ার একটি রুটিন তৈরি হয়ে যায় এবং মায়েরা শিশুর খাবারের সম্ভাব্য সময়গুলো নিয়ে মোটামুটি একটি ধারণা পেয়ে যান। যদিও মাঝে মাঝে এই রুটিনে পরিবর্তন আসতে পারে।

বুকের দুধ খাওয়া শিশুরা এই সময় প্রতি ৩-৪ ঘণ্টা অন্তর খেতে চাইতে পারে। এভাবে হয়তো প্রতিদিন ৬-১০ বার সে ব্রেস্টফীড করবে। তবে এর ব্যতিক্রম হওয়াটাও স্বাভাবিক। বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় একপাশের ব্রেস্ট পুরোপুরি খালি হওয়ার পর অন্য পাশের ব্রেস্ট থেকে খেতে দিন।

যেসব শিশু ফর্মুলা খায় তারা এসময় প্রতি ৩-৪ ঘণ্টা পরপর ৪-৫ আউন্স দুধ খেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে শিশু এসময়ের আগেও খেতে চাইতে পারে। তাই সবসময় তার ক্ষুধার লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখুন।  

স্বাভাবিক অবস্থায়, শিশু  দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে জাগিয়ে খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। তবে বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন বৃদ্ধি যদি কম হয় বা তার যদি কোনো মেডিকেল কন্ডিশন থাকে তবে বিশেষজ্ঞরা শিশুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

তৃতীয় মাসে শিশুর মলত্যাগ

শিশু বুকের দুধ খাচ্ছে নাকি ফর্মুলা, তার উপর নির্ভর করে তার মলের ধরন এবং পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের মল সাধারনত হলুদ এবং পাতলা হয় আর ফর্মুলা খাওয়ানো শিশুদের মল কিছুটা গাঢ় বর্ণের এবং ঘন হয়।

এবয়সে শিশু দিনে এক বা তার অধিকবার মলত্যাগ করতে পারে। তবে বুকের দুধ খাওয়ানো শিশু যদি বেশ কয়েকদিন মলত্যাগ না করে তবে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এক্ষেত্রে তার হাবভাবের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি তাকে সন্তুষ্ট মনে হয় এবং তার পেট নরম থাকে তাহলে তেমন কোন সমস্যা নেই। মলত্যাগ না হওয়ার কারণে শিশুকে অসুস্থ বা অখুশি মনে হলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।

ফর্মুলা খাওয়ানো শিশুদের দিনে অন্তত একবার মলত্যাগ করা স্বাভাবিক। এসব শিশু যদি ২ বা তার বেশীদিন মলত্যাগ না করে তবে ধরে নেয়া যায় সে কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত।

এমন হলে শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করতে হবে কারণ কোষ্ঠকাঠিন্য অ্যালার্জির কারনে হতে পারে আবার সে ব্র্যান্ডের ফর্মুলা ঠিকমত হজম না হওয়ার কারণেও হতে পারে।

এ বয়সী শিশুদের দৈনিক ৬-৮ বার প্রস্রাব করাকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়।

তৃতীয় মাসে শিশুর ওজন ও উচ্চতা

জন্মের পর ৬০ থেকে থেকে ৯০ দিন বয়সের মধ্যে শিশুর ওজন জন্ম ওজনের চেয়ে ৪-৫ পাউন্ড বা ২-২.৫ কেজি পর্যন্ত বাড়তে পারে। সেই সাথে উচ্চতাও ১-২ ইঞ্চি বৃদ্ধি পেতে পারে।  

এই সময়কালে, একটি ছেলে শিশুর গড় ওজন হতে পারে ১২.৩৮ পাউন্ড বা ৫.৬ কেজি এবং উচ্চতা হতে পারে ২৩ ইঞ্চির মত। একটি মেয়ে শিশুর এসময় গড় ওজন হতে পারে  ১১.২৫ পাউন্ড বা ৫.১ কেজি এবং উচ্চতা হয় প্রায় ২২.৫ ইঞ্চি।

তবে মনে রাখতে হবে প্রতিটি শিশুর শারীরিক গঠন ভিন্ন এবং ওজনের ক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য হওয়াও স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সবচাইতে জরুরী বিষয় হলো শিশুর বৃদ্ধির দিকে নজর রাখা এবং বৃদ্ধি ঠিকমত হচ্ছে কিনা তা ডাক্তারের কাছ থেকে চেকআপ করিয়ে নেয়া। প্রত্যেকটি সাক্ষাতে ডাক্তার শিশুর ওজন, উচ্চতা ও মাথার পরিধি মেপে দেখবেন এবং কোনো অস্বাভাবিকতা পেলে জানাবেন।

তৃতীয় মাসে শিশুর ঘুম

শিশুর দিনের বেলার ঘুম এখন অনেকটা রুটিন মাফিক হয়ে উঠতে পারে।এ বয়সে দিনে সাধারণত দু’বার ঘুমানো স্বাভাবিক এবং প্রতিবার শিশু দেড় থেকে দুঘণ্টা ঘুমোতে পারে। তার রাতের ঘুমের সময়ও এখন কিছুটা বাড়তে পারে। তবে পুরো রাত ঘুমিয়ে কাটানোর আশা এখনো তার কাছ থেকে না করাই ভালো। ২ মাস বয়সে শিশু দৈনিক ১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটাতে পারে

রাতে শিশু জেগে গেলে রুমে বেশি আলো জ্বালাবেন না। তাকে খাওয়ানো এবং ন্যাপি পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তা মৃদু আলোতে করুন। তার সাথে বেশি কথা বলবেন না। এতে সে বুঝতে শিখবে রাতের বেলা ঘুমানোর সময়।

শিশুর ক্লান্ত হয়ে পড়ার লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখুন এবং যখনই তার মধ্যে ক্লান্তভাব দেখবেন তখনি তাকে শুইয়ে দিন। শিশু অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লে খিটখিটে হয়ে ওঠে এবং ঘুমাতে চায়না।

তাকে ঘুম পাড়ানোর সময় যখনই তার মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব দেখবেন তখনি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিন। পুরোপুরি ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন না। দুলিয়ে ঘুম পাড়ানো হলে সে এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে এবং পরবর্তীতে তাকে ঘুম পাড়ানো কঠিন হয়ে উঠবে।

তৃতীয় মাসে শিশুর টিকা

দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার ২৮ দিন পর অর্থাৎ শিশুর বয়স ১০ সপ্তাহ বা আড়াই মাস হলে তৃতীয় ডোজ টিকা দিতে হবে। তৃতীয় ডোজের সময়  ২য় ডোজের টিকাগুলোই আবার দেয়া হয় রোগের বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধ তৈরী করার জন্য।মনে রাখতে হবে একই টিকার দুই ডোজের মধ্যে কমপক্ষে ২৮ দিনের বিরতি থাকতে হবে।

এসময় শিশুকে ২ ফোঁটা পোলিও টিকা বা ওপিভি  মুখে খাওয়ানো হয়। এর সাথে সাথে ডান পায়ে নিউমোনিয়ার টিকা পিসিভি দেয়া হয়। আর বাম পায়ে দেয়া হয় আর একটি টিকা যা পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন নামে পরিচিত।এই টিকাটি একটি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেয়া হলেও এটি পাঁচটি রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।রোগ গুলো হচ্ছে- ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হেমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা- বি।

টিকার সাধারণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসাবে সামান্য জ্বর হতে পারে, টিকা দেয়ার স্থানে সামান্য লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া ও অল্প ব্যথা হতে পারে, যা ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে সাধারণত সেরে যায়। এসময় ডাক্তারের পরামর্শে শিশুদের উপযোগী প্যারাসিটামল খাওয়ানো যেতে পারে।

শিশুদের ডায়রিয়ার প্রধান কারণ রোটা ভাইরাস। এজন্য রোটা ভাইরাসের প্রতিষেধক দিতে হবে। বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে রোটা রিক্স ও রোটা টেক নামে দুই ধরনের রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন দেয়া হয়। রোটা টেক তিন ডোজ নিতে হয়। রোটা রিক্স নিতে হয় দুই ডোজ ।

রোটা টেক সাধারণত ২ মাস, ৪ মাস এবং ৬ মাস বয়সে দেয়া হয়। রোটা রিক্সের দুই ডোজ দেয়া হয় ২ মাস এবং ৪ মাস বয়সে। তবে দুটো টিকারই প্রথম ডোজ দিতে হবে শিশু বয়স ১৫ সপ্তাহ হওয়ার আগে এবং ৩২ সপ্তাহের মধ্যে সব ডোজ শেষ করতে হবে।

তৃতীয় মাসে শিশুর গ্রোথ স্পার্ট

তৃতীয় মাসে অনেক শিশু একটি উল্লেখযোগ্য গ্রোথ স্পার্টের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। গ্রোথ স্পার্ট বা দ্রুতবর্ধন হচ্ছে এমন একটি সময়কাল, যখন শিশুর বিকাশ অন্য যেকোনো স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি হয়। গ্রোথ স্পার্টের সময় শিশুর ওজন কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। খানিকটা লম্বাও হতে পারে, এমনকি মাথার পরিধিও কিছুটা বাড়তে পারে।

এই সময় শিশুর মাঝে রাতারাতি আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। হঠাৎ করেই সে ঘন ঘন খেতে চাইতে পারে, আবার তার স্বাভাবিক ঘুমের রুটিনের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন হতে পারে। এছাড়াও শিশু অন্য সময়ের তুলনায় বেশি খিটখিটে আচরণ করতে পারে এবং দিনের বেশিরভাগ সময় তার মধ্যে অস্থিরভাব কাজ করতে পারে।

তবে দিন কয়েকের মধ্যে যদি শিশু পূর্বের রুটিনে ফিরে না আসে, অর্থাৎ খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি নিয়ে সমস্যা দীর্ঘদিন চলতে থাকে তখন বিষয়টি  চিন্তার কারণ হতে পারে। পাশাপাশি লক্ষ্য রাখতে হবে শিশু জ্বর, বমি বা অন্য কোনো সমস্যায় ভুগছে কিনা। এগুলো গ্রোথ স্পার্টের সময় হওয়ার কথা নয়। এমতাবস্থায় অবশ্যই চেকআপ করিয়ে নিতে হবে।

তৃতীয় মাসে শিশুর কান্না

তৃতীয় মাসে শিশুর কান্নার আওয়াজ আগের তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে। অনেক কারণেই সে কান্না করতে পারে, যেমন- খিদে লাগা, ন্যাপি ভিজে যাওয়া, ক্লান্ত লাগা ইত্যাদি। এছাড়াও এসময় তার স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ দ্রুত হতে থাকার কারণে সে ঘন ঘন মায়ের সান্নিধ্য চাইতে পারে। সুখবর হলো- এই সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ মা-বাবাই শিশু কেন কান্না করছেন তা সহজেই বুঝে যান।

শিশুরা স্বভাবতই কোলে থাকতে ভালবাসে। কোলের উষ্ণতা তাদের আরামদায়ক অনুভতি জাগায়। তাকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে দুলিয়ে গান শুনানোটা তার কান্না থামাতে দারুন ভাবে কাজ করে।

গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই মায়ের হৃদস্পন্দনের সাথে শিশুর একটা ভালোলাগা মিশে থাকে। তাই তারা মায়ের কোলে থেকে মায়ের হৃদস্পন্দনের আওয়াজ শুনতে ভালোবাসে।আবার অনেক সময় ভ্যাকিউম ক্লিনার, ওয়াশিং মেশিন বা হেয়ার ড্রাইয়ারের একটানা ও একঘেয়ে শব্দে সে শান্ত হয়ে যেতে পারে।

যেকোনো ছোটখাটো বিষয়ে বিরক্ত হওয়া বা কেঁদে ওঠা, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, চুপচাপ এবং স্থির হয়ে যাওয়া, এগুলো সবই তার ঘুম পাওয়ার কিছু লক্ষণ। তাই এই লক্ষণগুলো দেখলে তার ঘর শান্ত এবং নিরিবিলি করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিন।

শিশুর অন্য কোন শারীরিক সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি কান্না করলে বুঝে নিতে পারেন সে হয়তো কলিক। এমন হলে শিশুকে খুব অসন্তুষ্ট মনে হয় এবং তাকে শান্ত করার সব চেষ্টা বৃথা যায়। কলিক নিয়ে বিস্তারিত জানতে কমেন্ট বক্সে দেয়া ভিডিওটি দেখে নিন।

বিজ্ঞাপণ

শিশু যে কারনেই কান্না করুক না কেন, তার ঘন ঘন কান্না করাটা বাবা-মায়ের জন্য এক ধরণের মানসিক চাপের সৃষ্টি করে। তাই বাবা মায়ের যথেষ্ট ধৈর্যশীলতা ও শক্ত মনোবল থাকতে হবে, যেন এইরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে শান্ত করতে পারেন।

মনে রাখবেন শিশুর এই অবস্থা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। কলিক সাধারণত বাচ্চার দুমাস বয়সে সবচাইতে বেশী থাকে এবং ৩ থেকে ৪ মাস বয়স থেকে কমতে থাকে।

একজন মা ই তার বাচ্চাকে সবথেকে ভালো বুঝতে পারেন। সুতরাং বাচ্চার কান্না আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলে নিকটস্ত  কোন শিশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

তৃতীয় মাসে শিশুর যত্ন

মাসাজ

শরীর মাসাজ শিশুর নিয়মিত পরিচর্যারই  অংশ। স্বাস্থ্যকর মাসাজ  শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশেও ভালো ভূমিকা রাখে। আর নিয়মিত মাসাজের ফলে শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং সে অনেক শান্ত থাকে। কলিক শিশুদের জন্যও মাসাজ উপকারি ভূমিকা রাখতে পারে। এমনকি শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও কমতে পারে।

আপনি হয়ত দেখবেন শিশুকে মাসাজ করার ফলে আপনার নিজের মুড অনেক ভালো থাকবে এবং মা কিংবা বাবা হিসেবে নিজেকে অনেক পরিপূর্ণ মনে হবে। মাসাজের এ সময়টা হয়ে উঠবে আপনাদের বিশেষ সময় কারন যখন বাচ্চাকে মাসাজ করাবেন তখনই বাচ্চার সাথে অনেক বেশী কথা বলা হয় এবং আই কন্টাক্ট করা হয়- এতে দুজনের মধ্যে বন্ডিং অনেক জোরালো হয়ে ওঠে।

বাচ্চাকে আলতো মাসাজ করতে পারেন। সামান্য বেবি অয়েল বা অলিভ অয়েল নিয়ে দু’হাতে ঘষে তা হালকা গরম করে নিন। এরপর বাচ্চার চোখে চোখ রেখে তার সাথে কথা বলতে বলতে বা মৃদু স্বরে গান করতে করতে মাসাজ করুন।

শিশুর শরীরে মালিশ করার উপযুক্ত সময় হল যখন সে শান্ত ও স্থির অবস্থায় থাকে। মালিশ করার সময় যদি শিশু কান্না করে তাহলে বুঝতে হবে সে তা উপভোগ করছেনা। তখন মাসাজ করা বন্ধ করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে নিরাপদবোধ করানোই শ্রেয়।  

ডায়াপার র‍্যাশ

অভিভাবক হিসেবে সচেতন থাকলে আর নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখলে ডায়াপারজনিত র‍্যাশ থেকে শিশুকে নিরাপদ রাখা যাবে খুব সহজেই।একটি ডায়াপার দীর্ঘসময় ধরে পরিয়ে রাখা ঠিক নয়। যত দ্রুত সম্ভব অপরিস্কার ডায়াপার বদলে ফেলা উচিত।

শিশুর ডায়াপার যাতে খুব আঁটসাঁট না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। ডায়াপার পরিবর্তনের পর একটি নরম কাপড় বা টাওয়েল আলতো চেপে চেপে বা কিছুক্ষণ খোলা রেখে শিশুর ত্বককে শুকিয়ে নিন। প্রতিবার ডায়াপার পরিবর্তনের পর হালকা উষ্ণ পানি দিয়ে স্থানটি পরিষ্কার করুন। তবে ঘষে পরিষ্কার করবেন না।

নতুন ডায়াপার পড়ানোর আগে ভালো মানের ডায়াপার বা ন্যাপি অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নিন। এতে র‍্যাশ হবার সম্ভবনা কমে যায়।  ডায়াপার পরানোর অংশে কিংবা মুখমণ্ডলে কখনো পাউডার দেবেন না। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

নখ

নবজাতকের নখ বড়দের তুলনায় পাতলা এবং নরম হতে পারে, কিন্তু বেশ  ধারালো হয়। নবজাতকের যেহেতু নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ তেমন একটা থাকেনা তাই সে সহজেই নিজেকে এমনকি বড়দেরও  খামচি দিয়ে ক্ষত তৈরি করে ফেলতে পারে। তাই কিছুদিন পর পর শিশুর উপযোগী নিরাপদ নেইল কাটার বা নেইল ক্লিপার দিয়ে নখগুলো কেটে দিন। বড়দের নেইল কাটারগুলো নবজাতকের ছোট হাতের নখ কাটার জন্য উপযোগী নয়। নখ কাটার সময় নখের নীচের অংশ নখ থেকে দুরে সরিয়ে দিন যাতে তা কেটে না যায় এবং বাচ্চার হাত শক্ত করে ধরে রাখুন।

শিশু যখন ঘুমিয়ে থাকে অথবা খাওয়ানোর সময় নখ কাটা অনেক সহজ। কারণ এ সময় তারা খুব একটা নড়াচড়া করেনা। এছাড়াও গোসলের পর নখগুলো অনেক নরম থাকে তাই কাটতে সুবিধা হয়। শিশুর নখ কাটার সময় যাতে পর্যাপ্ত আলো থাকে সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

তৃতীয় মাসে শিশুর শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তন এবং মাইলস্টোন

দুইমাস শেষে অর্থাৎ তৃতীয় মাসে এসে শিশু তার হাত পা নাড়ানো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও  বিক্ষিপ্তভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আপনার হাতের আঙ্গুল তার দিকে বাড়িয়ে দিলে সে হয়তো সেগুলো ধরার চেষ্টা করবে। এই সময় সে নিজের হাতে ধরে থাকা কোনো জিনিসের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।

এবয়সে অনেক শিশু তার হাত নিজের মুখের কাছে আনতে শিখে যায় এবং অনেকে আঙ্গুল চুষতেও শুরু করতে পারে। এটাই তার নিজেকে নিজে শান্ত করার প্রথম ধাপ। এসময় শিশুর নিজের হাত এবং পায়ের প্রতি আকর্ষন বাড়বে এবং পেট ভরা অবস্থায় অনেকটা সময় এ দুটোকে নিয়েই তিনি ব্যাস্ত থাকবেন। পা দুটোকে ধরা অথবা হাতের আঙ্গুলের প্রতি মনোনিবেশ করা হয়ে উঠবে তার সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যম।

এখন থেকে বেশিরভাগ শিশুই সামাজিকতার হাসি দিতে শুরু করে, অর্থাৎ জেনে বুঝে তার খুশির বহিঃপ্রকাশ শুরু করার বেশ উপযুক্ত সময় এটি । হয়তো সে অপরিচিত কারো সাথে হাসবে যারা তার সাথে হাসে বা শব্দ করে কিন্তু সে তার প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে অন্য ধরণের অনুভূতি প্রকাশ করবে। শিশু এসময় তার প্রিয় মুখটি দেখলে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে চাইবে। মায়ের কাছে থাকলে এসময় সে শান্ত থাকবে এবং চোখে চোখ রাখবে বা বা তার চোখ মাকেই খুঁজে বেড়াবে। আর যখনই খুঁজে পাবে সে হয়তো হেসে উঠবে বা আনন্দে হাত পা ছুড়তে থাকবে।

শিশু তার চোখ দুটো এখন আরো বেশি ফোকাস করতে পারে। তার দৃষ্টি সীমার মধ্যে কিছু নাড়ানো হলে সে চোখ দিয়ে তা অনুসরণ করতে পারে। এসময় শিশুরা সাধারণত ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত দূরত্বের জিনিস ভালোভাবে দেখতে পায়। আপনি নানা রকম মজার মুখভঙ্গী করলে বা ভেংচি কাটলে শিশু মৃদু কিংবা খিলখিল করে হাসতে শুরু করবে এবং ছেলেমানুষি কাণ্ডকারখানায় খুব আনন্দ পাবে।

নানারকম শব্দ শুনতেও তার মজা লাগবে। জিভ দিয়ে টক টক আওয়াজ করুন, শিস দিন বা জন্তুজানোয়ারের ডাক ডাকুন।  পেট ভরা এবং  ক্লান্ত না থাকলে তারা এগুলো বেশ উপভোগ করে। সে আপনার মুখভঙ্গি এবং শব্দগুলো নকল করারও চেষ্টা করতে পারে। এসময় শিশু তার পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনলে সেদিকে মাথা ঘোরানোর চেষ্টা করতে পারে।

বুকের উপর শুইয়ে দিলে সে এখন হাতের উপর ভর দিয়ে তার মাথা ও বুক উপরে তুলতে পারবে। এসময় তার মাথা তুলে ধরা আগের চাইতে বেশি নিয়ন্ত্রিত থাকবে। সাধারণত এই ৬০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে শিশু চিত হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় তার মাথা ৪৫ ডিগ্রী পর্যন্ত তুলে ধরতে পারে।

তৃতীয় মাসে কীভাবে শিশুর বিকাশে সাহায্য করবেন

গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশুর বাবা মা তার সাথে প্রচুর কথা বলে পরবর্তীতে সেসব শিশুর IQ এবং শব্দভাণ্ডার অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক ভাল থাকে। তাই শিশুর সাথে কথা বলুন, গল্প বলুন এবং বিভিন্ন জিনিসের নাম বলুন। সে এসব শব্দ এখন বুঝতে বা উচ্চারণ করতে না পারলেও এগুলো তার মস্তিষ্কের বিকাশে ভূমিকা রাখে, যা আপাতদৃষ্টিতে বোঝার উপায় নেই।

শিশুর সাথে কথা বলার জন্য কথা খুঁজে পাওয়া অনেক সময় দুষ্কর হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে তাকে মজার কোন বই পড়ে শোনান, এতে আপনারা দুজনেই মজা পাবেন। আর এই অভ্যাসটি শিশুর সাথে বন্ডিংয়ে খুব ভালো ভূমিকা রাখে।   কোনোভাবেই ছোট নাজুক শিশুদের কোনো ডিভাইস অর্থাৎ মোবাইল, ট্যাব কিংবা টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকাতে উৎসাহী করবেন না। নিজেদেরও মোবাইল ব্যবহার সীমিত রাখাটাই সমীচীন। ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস শিশুদের ব্রেইনের বিকাশে হুমকিস্বরূপ।  

শিশুরা মূলত খেলার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন বিষয় শিখে থাকে। খেলতে খেলতে তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করে, অন্য মানুষদের ব্যাপারে ভাবতে শেখে এবং নিজেদের আশেপাশের দুনিয়া সম্পর্কে জানতে শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, খেলাধূলা শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে, বিভিন্ন মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক গড়তে এবং মৌলিক দক্ষতা অর্জন করতে সহায়তা করে।

বিজ্ঞাপণ

সে যখন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে তখন তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে রঙিন খেলনা ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। সে উৎসাহী হবে এবং হাত পা ছুঁড়ে খেলনাটি ধরার চেষ্টা করবে। এভাবে খেলার চর্চা করলে আপনার শিশুর ঘাড়ের পেশীগুলো শক্তিশালী হবে, তার বুক এবং পাজরের হাঁড় মজবুত হবে। ফলে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের প্যাটার্নে পরিবর্তন আসবে এবং তা বিকশিত হবে। শিশুদের কথা বলার ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের এই বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এখন যেহেতু সে আস্তে আস্তে ধরতে শিখছে তাই হালকা, নিরাপদ এবং ধরতে সুবিধা এমন কিছু তাকে ধরতে দিন। কাপড়ের খেলনা ও কাপড়ের রঙ্গিন বই, ঝুনঝুনি বা র‍্যাটল টয়গুলো  এসময়ের জন্য উপযোগী খেলনা।

প্রতি সপ্তাহেই আপনার শিশুর ঘাড়ের পেশী আস্তে আস্তে মজবুত হচ্ছে। তাই এখন থেকেই তাকে অন্তত কিছু সময় এর জন্য উপুড় করে শুইয়ে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি তার পেশীর বিকাশে সাহায্য করে। সে হয়তো খুব বেশী সময় মাথা উপরের দিকে  ধরে রাখতে পারবেনা, তাই সে যতটা সময় স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে ততক্ষণই তাকে টামি টাইম দিন। তবে কোনভাবেই  বাচ্চাকে উপুড় করে একা ছেড়ে যাবেন না ।  

শিশুর ইন্দ্রিয়গুলো এখন যেহেতু আরও সজাগ হয়ে উঠছে তাই এখন থেকেই তাকে কিছু সময়ের জন্য বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনতে পারেন।এটি হতে পারে বাড়ীর উঠোন বা ছাদ।  চারপাশের বিভিন্ন রং এবং শব্দ তার ভালো লাগবয়ে এবং এটি তার বিকাশের জন্যও দরকারি ।

বিপদ চিহ্নঃ

  • শিশু চলন্ত কিছুর দিকে দৃষ্টি না দেয়া।
  • তীব্র আলো বা শব্দে প্রতিক্রিয়া না দেখানো।
  • হাত নিজের মুখের কাছে আনতে না পারা।
  • পেটের উপর শুয়ে থাকা অবস্থায় মাথা উপরে তুলে ধরে না পারা।
  • কারো  দিকে তাকিয়ে না হাসা।
  • সবসময় চোখ ট্যাঁরা করে রাখা ( মাঝে মাঝে চোখ ট্যাঁরা করে থাকা এ সময় স্বাভাবিক)

পরিশিষ্ট

এ সময় কি কি  মাইলস্টোন আপনার শিশু অর্জন করতে যাচ্ছে তা জানার সাথে সাথে ভুলে যাবেন না যে এট শুধু মাত্র একটা গাইডলাইন। প্রতিটি শিশুই ইউনিক অর্থাৎ তার কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং তার বেড়ে ওঠার গতিও অন্য শিশু থেকে ভিন্ন হতে পারে।

কোনো শিশু  ‘প্রিম্যাচিওর’ হয়ে জন্মালে তার ডেভেলপমেন্ট জন্মতারিখ থেকে শুরু না করে, তার যেসময় জন্মানোর কথা ছিল সেই সময় থেকে হিসাব করা বাঞ্ছনীয় ।

এই টাইমলাইন সিরিজ যেন আপনার কোনোরকম দুঃশ্চিন্তার কারন না হয় খেয়াল রাখবেন। প্রতিটি টাইমলাইনকে একটি গাইড হিসেবে ধরে নিতে হবে । নবজাতকের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

সবার জন্য শুভকামনা।

 <<শিশুর বেড়ে ওঠা – ২ মাস

শিশুর বেড়ে ওঠা – ৪ মাস>> 


Spread the love

Related posts

Leave a Comment