বাড়ির ছোট বাচ্চাটি অসুস্থ হলে পরিবারের সকলেই দারুন চিন্তিত হয়ে পড়েন। সব থেকে দুশ্চিন্তা যে মায়েরই হয় তা তো বলাই বাহুল্য।
ছোট শিশুরা শারীরিক অসুবিধার কথাগুলো পরিষ্কার করে আমাদের বলতে পারে না। তবে বাচ্চাকে দুর্বল দেখালে,খেতে না চাইলে,খেলা ধুলা না করলে ধরে নেয়া যায় যে বাচ্চার শরীরে কোন সমস্যা হচ্ছে। বাচ্চা অসুস্থ কি করে বুঝবেন তাই নিয়েই আজকের আলোচনা-
বাবা কিংবা মা হিসেবে আপনি জানেন সুস্থ থাকলে আপনার সন্তানকে কেমন দেখায়, আর এজন্যই তার মেজাজ, আচরন, ক্রিয়াকলাপ এবং ক্ষুধায় খুব সামান্য পরিবর্তন হলে আপনি বুঝতে পারেন আপনার বাচ্চা হয়ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
যদি লক্ষনগুলো দেখে মনে হয় তার অসুস্থতা খুব হালকা সেক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে দেখা করার আগে অসুস্থতা কি পরিমান বাড়ছে তা দেখা জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।
আপনি যদি আপনার বাচ্চাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হন তাহলে উচিত হবে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে সাধারনত আপনি আপনার পারিবারিক ডাক্তারের কাছে প্রথম যেতে পারেন।
কখন চিন্তিত হওয়া উচিত?
অধিক্তর গুরুতর অসুস্থতার কিছু সাধারন লক্ষন থাকে যেগুলো দেখলে আপনার উচিত হবে অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- চঞ্চলতা কমে যাওয়া এবং খিটখিটে মেজাজ
- শ্বাসক্রিয়া
- ত্বকের রং এবং অবস্থা
- তরল পদার্থ গ্রহন ও বর্জন- আপনার বাচ্চা কি পরিমান পানি পান করছে এবং কি পরিমান প্রস্রাব করছে।
এই লক্ষনগুলো যদি খুব দ্রুত বাড়তে থাকে এবং সবগুলো একসাথে দেখা দেয় কিংবা যদি আপনার বাচ্চা খুব অল্প বয়সী হয় তাহলে আপনার উচিত হবে জরুরী ভিত্তিতে সাহায্য চাওয়া।
চঞ্চলতা
আপনার শিশু যখন অসুস্থ হয়ে পড়বে তখন হয়তো সে ছোটাছুটি করবে না, ঘুমাবে বেশী এবং অধিক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। আরও গুরুতর যেসব অস্বাভাবিকতা রয়েছে সেগুলো হল- অসাড়তা, ক্ষীণ শব্দে কাঁদা, খিটখিটে মেজাজ কিংবা তার চারপাশের জিনিসগুলোর প্রতি তেমন খেয়াল না করা। যদি এসব দেখা যায় তাহলে খুব শীঘ্রই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
শ্বাসপ্রশ্বাস
যদি আপনার বাচ্চা দ্রুত শ্বাস নেয়, শব্দ সহকারে শ্বাস নেয় কিংবা শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয়, তাহলে আপনাকে জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
যদি সমস্যাটি খুবই গুরুতর হয় তাহলে হয়তো আপনি বাচ্চার ঠোঁটের চারপাশে কাল রঙের দাগ দেখতে পাবেন কিংবা হয়তো সে থেমে থেমে শ্বাস নেবে। যদি এমনটি ঘটে তাহলে আপনার উচিত হবে একটি অ্যাম্বুলেন্স ডাকা।
ত্বকের রং ও অবস্থা
যদি আপনার শিশু অস্বাভাবিকভাবে ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে কিংবা তার ত্বকে গাঁড় বেগুনী রঙের এলোমেলো দাগ দেখা দেয় তাহলে আপনার উচিত হবে একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়া।
অনেক ফুসকুড়ি মৃদু সংক্রমনের কারণে হয় এবং সেগুলো গুরুতর নয়। যদি আপনার শিশুর বেগুনী রঙের ফুসকুড়ি থাকে যা চাপ দিলে মিলিয়ে যায় না তাহলে আপনাকে জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। চামড়ার উপর একটি গ্লাস নিয়ে চাপ দিন এবং এর ভেতর দিয়ে দেখুন ফুসকুড়িটি মিলিয়ে গেছে কিনা। এটি মেনিঞ্জোকক্কাল সংক্রমণের লক্ষন হতে পারে।
তরল পদার্থ গ্রহন ও বর্জন
যদি আপনার বাচ্চা স্বাভাবিকের অর্ধেকের চেয়েও কম পরিমান পানি পান করে কিংবা প্রতি ৬ ঘণ্টা অন্তর মুত্র ত্যাগ না করে তাহলে সে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে কিনা তা দেখার জন্য আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
গুরুতর সমস্যার লক্ষণগুলো হলো- রক্ত কিংবা সবুজ রঙের তরল (পিত্ত) পদার্থ সহকারে বমি করা, কিংবা রক্ত পায়খানা হওয়া। যদি এমনটি হয় তাহলে আপনার উচিত হবে জরুরিভিত্তিতে একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়া।
অন্যান্য সম্ভাব্য গুরুতর সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে তীব্র কিংবা ক্রমাগত ব্যাথা বা কষ্ট হওয়া, ফুসকুড়ি এবং খিঁচুনি হওয়া।
জ্বর
এমনিতে জ্বর হওয়া ক্ষতিকর কিছু নয়। যে সংক্রমণের কারণে জ্বর হয় তা প্রায়ই ভাইরাসজনিত এবং এর জন্য দরকার বিস্রাম এবং পানি পান। তবে কখনো কখনো এটি হয় ব্যাকটেরিয়া জনিত যার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক নেয়া দরকার হয়।
৩ মাসের কম বয়সী শিশুর যদি ৩৮ (১০০.৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট) ডিগ্রীর সেলসিয়াসের উপরে জ্বর হয় তাহলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে কারণ প্রায়ই এর কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয় এবং অসুস্থতার অন্যান্য লক্ষণগুলো শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে।
একটি অপেক্ষাকৃত বেশী বয়সের জ্বরাক্রান্ত শিশু কতটুকু অসুস্থ (চঞ্চলতায় পরিবর্তন, শ্বাসপ্রশ্বাস, ত্বকের রং এবং কি পরিমান তরল শরীরে যাচ্ছে কিংবা বের হচ্ছে) তা নির্ধারণের জন্য উপরে বর্ণিত লক্ষণগুলো ব্যাবহার করুন। যদি আপনার বাচ্চা জোড়ে কাঁপুনি দেয়, তাহলে আপনার একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর জ্বর । কখন স্বাভাবিক, কখন নয় ]
খিঁচুনি বা ফিট
কোনো সংক্রমণ বা আঘাত ছাড়া অন্য খিঁচুনির ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। খিঁচুনির সঙ্গে শিশু জ্ঞান হারালে, চোখ পিটপিট করলে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে, চোখ উল্টে গেলে, হাত ও পা কাঁপলে ও প্রস্রাব-পায়খানার নিয়ন্ত্রণ হারালে তাকে শান্ত রাখুন। শিশুকে একপাশে কাত করে রাখুন কিংবা উপুড় করে রাখুন। এতে মুখ থেকে লালা বেরিয়ে যেতে পারে। খিঁচুনির পর শিশুকে বিশ্রামে রাখুন।
খিঁচুনির সময় দুই দাঁতের পাটির মাঝখানে জোর করে কোনো বস্তু ঢোকাবেন না, শিশুকে ধরার চেষ্টা করবেন না কিংবা তার কাঁপাকাঁপি বন্ধের চেষ্টা করবেন না, কোনো কিছু পান করাবেন না কিংবা কোনো ওষুধ দেবেন না, খিঁচুনি থামানোর জন্য গোসল করাবেন না। খিঁচুনি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে শিশুকে দ্রুত পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর জ্বরজনিত খিঁচুনি (Febrile Convulsion) ]
যেসব লক্ষণ দেখা মাত্র হাসপাতালে নিতে হবে-
বাচ্চার যদি খিঁচুনি দেখা দেয়।বাচ্চা যদি খুব শব্দ করে তাড়াতাড়ি নিঃশ্বাস নেয়। শ্বাস নেয়ার সময় বুক যদি ভেতরের দিকে ডেবে যায়।অতিরিক্ত জ্বরের কারনে বাচ্চা যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
বাচ্চা যদি পড়ে বা কোনোভাবে ব্যথা পেয়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বাচ্চা যদি ঝিমিয়ে পরতে থাকে, নড়াচড়া কম করে। বাচ্চার শরীরের কোন অংশে যদি বেগুনি বা লাল রক্তের ছোপের মতো র্যাশ দেখা দেয়।
যদি নিম্নোক্ত লক্ষণসমূহ দেখা যায় তবে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনুন
- শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে
- শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হলে (শ্বাস নেয়ার সময় পাঁজরের মাঝের স্থান গুলো ভিতরে ডেবে গেলে)
- অচেতন হয়ে পড়া কিংবা কি হচ্ছে তা বুঝতে না পারা
- ঘুম থেকে সহজে না জাগা
- সুস্থ হচ্ছে এমন মনে হলেও প্রথমবার অজ্ঞান হয়ে পড়া
- জ্বর থাকা ও প্যারাসিটামল, আইবোপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ গ্রহণের পরও নিরবচ্ছিন্নভাবে অবসন্ন থাকলে
- তলপেটে তীব্র ব্যাথা থাকা
- শরীরের কোনো জায়গা কেটে গেলে রক্ত পড়া না থামলে বা কেটে যাওয়া জায়গা খোলা থাকলে
- হাত, পা-তে আঘাত পাওয়ার কারণে হাত, পা ব্যবহার করতে না পারা
বিশেষভাবে লক্ষণীয়-
- অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে যত জলদি সম্ভব বাচ্চাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।
- নিজের আন্দাজ মতো কোন ওষুধ বাচ্চাকে খাওয়াবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়ান ।
- খুব বেশি মানুষকে বাচ্চার আশে পাশে আসতে দেবেন না। বাচ্চাকে নিরিবিলিতে রাখার চেষ্টা করুন।
- নিজের বা অন্য কারও কথা মতো বাচ্চাকে ঘরোয়া টোটকা দেয়ার চেষ্টা করবেন না । কোন কিছু করার আগে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিন।
- বাচ্চাকে দেখে চিকিৎসক যদি হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলে তবে দেরি না করে জলদি হাসপাতালে ভর্তি করান।
সবার জন্য শুভকামনা।