প্রতিটি বাচ্চারই নতুন জিনিসের সাথে অভ্যস্থ হতে একটু সময় লাগে। সময়ের সাথে সাথে সে সব কিছুর সাথেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। তাই বাচ্চার মা বাবাদের ব্যাপার গুলো নিয়েও খুব দুশ্চিন্তার মাঝে পড়তে হয়।
বেশির ভাগ বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই কোষ্ঠকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা। বেশি সমস্যায় পরতে হয় যখন শিশু নতুন বা শক্ত খাবার শুরু করে। এসময় বেশিরভাগ বাবা মায়ের একটাই অভিযোগ থাকে যে শিশুর পায়খানা হচ্ছেনা।
শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য হলে কান্নাকাটি করে, পেট মোচড়ায় এবং খাওয়াদাওয়াও কমিয়ে দেয়। অস্বস্তি হয় বলেই এমনটা করে তারা। শিশুর এই অস্বস্তি মায়েদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দেয়।
স্বাভাবিক পায়খানা দুই-তিন দিন পরপর হলেও তাকে কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে না। পরপর তিন দিন শক্ত পায়খানা হলে বা মলত্যাগ করতে কারও যদি অসুবিধা হয় অথবা বেশি সময় লাগে, তাকেই কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হয়।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য কিভাবে বুঝবেন?
বাচ্চা কতবার বা কখন পায়খানা করবে তার কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আপনার শিশুর প্রথম কয়েক সপ্তাহে, মলত্যাগের রুটিন তৈরী হতে কিছুটা সময় লাগবে৷ একদিন হয়ত পায়খানা পাতলা হবে, আবার পরের দিন শক্ত হবে৷ কোনটা স্বাভাবিক আপনি শীঘ্রই বুঝতে পারবেন৷
যতদিন আপনার শিশু শুধুই বুকের দুধ খাবে, তার মল নরম থাকবে ও মলত্যাগ সহজ হবে৷ যখন ও শক্ত খাবার খেতে শুরু করে, তখন কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে, হয়ত তার পায়খানা শক্ত হয়ে উঠবে, মলত্যাগ করতে কষ্ট হবে এবং দেখা যাবে স্বাভাবিক অবস্থায় যতবার পায়খানা হতো, ততবার শিশুর পায়খানা হচ্ছেনা।
কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণগুলি সহজেই বোঝা যায়৷ যদি পায়খানা করতে গিয়ে আপনার শিশু কান্নাকাটি করে, সেটা একটা লক্ষণ হতে পারে৷ আপনি এটাও লক্ষ্য করতে পারেন যে তার মল শুকনো ও শক্ত৷ সে স্বাভাবিকের তুলনায় কম পায়খানা করতে পারে, কখনো কখনো সারা সপ্তাহে মাত্র ৩ বার পায়খানা করতে পারে৷মল ও গ্যাসে দুর্গন্ধ হলে সেগুলিও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ৷ আরেকটা লক্ষণ হল পেট শক্ত হয়ে, ফুলে যাওয়া৷
কখনো কখনো খুব তরল পায়খানাও কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ হয়৷ যে শক্ত মল পাচন তন্ত্রে বাধা সৃষ্টি করে তার চারপাশ দিয়ে তরল পায়খানা বেড়িয়ে আসতে পারে৷ যদি আপনার মনে হয় আপনার শিশুর এইরকম কিছু হয়েছে, তাহলে ডাক্তার দেখান৷
নবজাতকের পায়খানা কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।
কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়?
শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে-
ফর্মুলা দুধ
মায়ের দুধে সঠিক পরিমান প্রোটিন ও ফ্যাট আছে, যার জন্য বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না। কিন্তু ফর্মুলাতে অনেক সময় কোনো একটা প্রোটিনের জন্য বাচ্চার সমস্যা হতে পারে।
ফর্মুলা খাওয়ানো বাচ্চাদের কোষ্ঠ কাঠিন্য বেশী হতে পারে কারণ ফর্মুলা, বুকের দুধের চাইতে কম হজম হয় যার ফলে শিশুর পায়খানা শক্ত ও বড় হয়ে যায়। বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চার পায়খানা সাধারনত নরম হয় এমনকি সে যদি তিন চারদিন পর পরও পায়খানা করে।
সলিড খাবার
যখন আপনার বাচ্চা প্রথম সলিড খাবার খাওয়া শুরু করে, তখন একটু কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। কম আঁশযুক্ত খাবার খেলে অনেক শিশু কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতে পারে। রাইস সিরিয়ালগুলোতে ফাইবার খুব কম থাকে বলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। মায়ের দুধ খাওয়া হটাৎ বন্ধ বা কমিয়ে দিলে বাচ্চার শরীরে পানি কম হয়ে যায়, এবং তার জন্য কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
ডিহাইড্রেশন
বাচ্চা তার বিভিন্ন শারীরিক অসুবিধার কারণে, যেমন- দাঁত ওঠার সময়, মুখে থ্রাশ হলে, ইনফেকশন হলে, সর্দি কাশি বা কানের ইনফেকশন হলে দুধ না খেতে চাইতে পারে। আর সলিড খাওয়ানো বাচ্চারা সলিড খাবারের পাশাপাশি দুধ বা পর্যাপ্ত পানি পান না করলে অর্থাৎ বাচ্চার শরীরে তরলের ঘাটতি হলে তার মল শক্ত ও শুকনো হতে পারে।
অসুস্থতা
কখনও কখনও কোষ্ঠকাঠিন্য শিশুর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার লক্ষন হতে পারে যেমন- ফুড অ্যালার্জি, ফুড পয়জনিং বা শিশুর খাবার হজমে সমস্যা যা মেটাবলিক ডিসঅর্ডার নামে পরিচিত।
এছারাও শিশুর শারীরিক ত্রুটি, যেমন অ্যানোরেকটাল স্টেনোসিস বা মলদ্বার জন্মগতভাবে বন্ধ থাকলে, স্নায়ুর সমস্যা বা সেরেব্রাল পলসি থাকলে, হাইপোথাইরয়েডিজম থাকলেও কোষ্ঠ কাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রতিকার
যদি আপনার শিশুর বয়স ৬ মাসের কম হয় এবং যদি আপনার মনে হয় যে তার কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে তাহলে তাকে প্রচুর বুকের দুধ খাওয়ান৷ বুকের দুধই হল আদর্শ। পানি বা অন্য কোনো পানীয় দেবেন না, শুধু বুকের দুধ দিন৷যদি আপনার শিশু শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে থাকে, তাহলে ওকে বুকের দুধ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ফল ও সব্জি খেতে দিন, আর পরিষ্কার, বিশুদ্ধ পানি খাওয়ান৷
এটা এটা মল নরম করতে সাহায্য করবে৷ বাচ্চা যদি ফর্মুলা খায় তবে ৬ মাস হওয়ার পর ফর্মুলার পাশাপাশি কিছু পানি দিন। তবে ফর্মুলাতে বেশী পানি মিশাবেন না। ফর্মুলা বানানোর সময় পানি ও ফর্মুলার অনুপাত ঠিক থাকা জরুরী। ফর্মুলা পাওডার এর পরিমান বেশী হলেও বাচ্চা ডিহাইড্রেটেদ হয়ে যেতে পারে।
বাচ্চার যদি বুকের দুধ খায় তবে মায়ের ডায়েটের কোন প্রোটিনের কারণে বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। কিসের কারণে হচ্ছে তা নিশ্চিত করা গেলে তা মায়ের ডায়েট থেকে বাদ দিন।
যদি বাচ্চা ফর্মুলা খায় তবে ফরমুলার কোন প্রোটিন হয়ত বাচ্চার সহ্য হচ্ছেনা তাই গ্যাস হচ্ছে। এমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ফর্মুলা পরিবর্তন করে দেখতে পারেন। মায়ের ডায়েটের কারণে হচ্ছে মনে হলে মায়ের ডায়েট থেকে একবারে একধরনের খাবার বাদ দিয়ে দেখুন বাচ্চার সমস্যা কম হচ্ছে কিনা।
আপনার বাচ্চাকে একটু এক্সারসাইজ করান। বাচ্চাকে হামাগুড়ি দিতে দিন। খেলনার সাহায্যে বাচ্চাকে আরো উৎসাহ দিন হামাগুড়ি দেবার জন্য। যদি আপনার বাচ্চা হামাগুড়ি দিতে না পারে, তাহলে ওর পা দুটি সাইক্লিং করার মতো হালকা করে ঘোরাতে পারেন।আপনি আপনার বাচ্চার পেটে ম্যাসাজ করতে পারেন। নাভীর থেকে ৩ আঙ্গুল নিচে, বাঁ দিকে আঙুলের ডগা দিয়ে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করতে পারেন।
যদি আপনার বাচ্চা সলিড খাবার খেতে অভ্যাস্ত থাকে, তাহলে তাকে ভাত, গাজর বা কলা কম করে দেবেন, এই সবের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। ভাল ফলাফলের জন্য আলুবোখারা, এপ্রিকট, বা নাশপাতি কয়েক টেবিল চামচ খাওয়াবার চেষ্টা করুন।আপনার শিশুকে প্রথমে পেটে ম্যাসেজ দিন,তারপর কিছু উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ান।
বারবার দুধ খাইয়ে বা ঘুমের মধ্যে ফিডার খাইয়ে পেট ভরিয়ে রাখলে শিশু সবজি খেতে চাইবে না। তাই শিশু যখন ক্ষুধার্ত থাকবে তখন তাকে ফল, সবজি, ভাত, ডাল খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
সলিড খাওয়ানো শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা দূর করতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস জরুরি। কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত শিশুকে প্রচুর পরিমাণে পানি, তরল খাবার, শাকসবজি, পাকা ফল, বিভিন্ন রকম ফলের শরবত, ইসবগুলের ভূসির শরবত এবং আঁশযুক্ত খাবার খাওয়াতে হবে।তবে এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস শুধু শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার পরে নয়, শিশুকে নিয়মিত এসব খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। তা হলে শিশু সহজেই থাকতে পারবে কোষ্ঠকাঠিন্যমুক্ত।
যদি আপনার বাচ্চার পায়খানা শুষ্ক আর রুক্ষ হয়, পায়খানার সঙ্গে রক্ত দেখতে পান, বা পায়খানা করার জায়গাতে একটু ফাটল দেখতে পান, তাহলে, সেখানে একটু Aloevera লাগাতে পারেন। ওই জায়গাটাকে যতটা সম্ভব শুকনো আর পরিষ্কার রাখুন। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
এ সব ঘরোয়া পদ্ধতিতেও যদি বাচ্চা কোষ্ঠকাঠিন্যের উন্নতি না হয় তবে ডাক্তার শিশুদের উপযোগী জোলাপ ব্যাবহারের পরামর্শ দিতে পারেন। আপনার বাচ্চার চিকিৎসার পদ্ধতি নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। স্টুল সফটনার ব্যবহার করতে পারবেন কি না, সেটা জিজ্ঞেস করুন। কিন্তু, কক্ষনোই বিনা অনুমতিতে Laxative দেবেন না। এতে আপনার বাচ্চার ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে।
খাবার-দাবার ও কিছু বিষয় নজরদারিতে রাখলে শিশু খুব সহজেই সুস্থ হয়ে উঠতে পারে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা এড়িয়ে চলতে পারবে। তবে জন্মগত কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
নবজাতকের পায়খানা যদি স্বাভাবিকের চাইতে ভিন্ন কিছু দেখেন সে ক্ষেত্রে ডাক্তারকে জানাতে হবে। এটাই নিয়ম।যদি আপনার বাচ্চা না খায়, ওজন হারায় বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত থাকে, তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। যদি প্রাথমিক চিকিৎসা, যেমন খাবার পাল্টানো, কাজ না করে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
যদি দেখেন আপনার ৪ মাসের শিশুর সাধারণ সময়ের থেকে ২৪ ঘন্টার বেশি পায়খানা হচ্ছেনা, তাহলে ডাক্তারকে জানানো উচিত। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কিন্তু ল্যাক্সাটিভে দেবেন না।
সবার জন্য শুভ কামনা।