শিশুর লার্নিং ডিসএবিলিটি | শেখার অক্ষমতা

Spread the love

বলা হয়ে থাকে, শিশুরা কোমলমতি ও ফুলের মতো নিষ্পাপ হয়। তাদের প্রাণ মাতানো, ভুবন ভুলানো হাসি ও দুরন্ত চলাফেরা আমাদের মাঝে আনন্দের খোড়াক যোগায়। কিন্তু খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে কিছু সংখ্যক শিশুকে বিভিন্ন রকম শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা বা ব্যাধির সম্মুখীন হতে হয়। লার্নিং ডিসএবিলিটি বা শেখার অক্ষমতা তেমনই একটি ব্যাধি।

পৃথিবীর অসংখ্য-অগনিত  শিশু এই লার্নিং ডিসএবিলিটিতে ভুগছে। এই সমস্ত শিশুর পিতা-মাতারা কেন তাদের সন্তানের এমন হচ্ছে, এখন তাদের করণীয় কী – এগুলো নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকেন। তাদের জন্য আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি কিছুটা হলেও উপকারী হবে।

বিজ্ঞাপণ

লার্নিং ডিসএবিলিটি কী?

“লার্নিং ডিসএবিলিটি” টার্মটি সাধারণত কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বাঁধা ও ব্যাধির সম্মুখীন হওয়া বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এটি এক ধরনের স্নায়বিক ব্যাধি যা শিশুর মস্তিষ্কের তথ্য সঞ্চালন ও তথ্য বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। সুতরাং, লার্নিং ডিসএবিলিটি হচ্ছে একটি তথ্য প্রক্রিয়াকরণগত সমস্যা যার দরুন শিশুকে কোনো দক্ষতা শেখা ও সেটি ব্যবহার করতে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়।

শিশুরা যখন বিভিন্ন দক্ষতামূলক কাজের সাথে পরিচিত হয়, হোক সেটা কিছু পড়তে পারা বা লিখতে পারা বা বুঝতে পারা – সেক্ষেত্রে তাদের কাছে প্রথমদিকে বিষয়গুলো কঠিন মনে হতে পারে বা একজন শিশু যেটা খুব তাড়াতাড়ি বোঝে, আরেকজন শিশুর সেটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। এগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বারবার বুঝিয়ে দেওয়ার পরও যদি সে বিষয়গুলো বুঝতে না পারে অথবা বুঝলেও বলতে বা লিখতে না পারলে সেক্ষেত্রে ওই শিশুর লার্নিং ডিসএবিলিটি থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুর নিম্নের কোনো একটি বা একাধিক ব্যাপারে সমস্যা থাকতে পারে।

  • পড়তে না পারা।
  • লিখতে না পারা।
  • কোনো বিষয় অথবা বিষয়ের কোনো প্রসঙ্গ বা আলোচনা না বোঝা।
  • গণিত না বোঝা।
  • দিকনির্দেশনা না বোঝা

উপরের একটি বা একাধিক সমস্যা আপনার শিশুর মধ্যে দেখতে পেলে ধরে নিতে পারেন যে তার লার্নিং ডিসএবিলিটি আছে। শিশুদের জন্য এটি একটি সর্বজনীন সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ এর অনূর্ধ্ব প্রায় (৮-১০)% শিশু লার্নিং ডিসএবিলিটিতে ভোগে। তাছাড়া দেশটিতে লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত প্রায় ১ মিলিয়ন শিশু স্কুলে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করে।

মনে রাখবেন একটি শিশু কতটা চটপটে, কতটা বুদ্ধিমান – এর সাথে লার্নিং ডিসএবিলিটির কোনো সম্পর্ক নেই। লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুদের কোনো কিছু দেখা, শোনা বা বোঝা অন্য শিশুদের চেয়ে ভিন্ন হয়। যার কারণে তারা নিত্যদিনের পড়াশোনা বিশেষ করে শ্রেণীকক্ষে মনোযোগী থাকা বা পরীক্ষার সময় প্রস্তুতি নিতে সমস্যার মধ্যে পড়ে।

বিভিন্ন ধরনের লার্নিং ডিসএবিলিটি

লার্নিং ডিসএবিলিটি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে এবং এর দ্বারা বিভিন্ন শিশু বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হতে পারে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি লার্নিং ডিসএবিলিটি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।

একটি বিষয় মনে রাখা দরকার এটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD) এবং অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো লার্নিং ডিসএবিলিটির সাথে মিল থাকলেও এই সমস্যাগুলো ভিন্ন।

ডিসলেক্সিয়া

ডিসলেক্সিয়া মূলত শিশুর ভাষাগত প্রক্রিয়াকরণে সমস্যা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি এটি শিশুর পড়তে পারা ও লিখতে পারা কঠিন করে তোলে। তাছাড়া এটি ব্যাকরণগত সমস্যা সৃষ্টি ও পড়া বোঝার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করে। তাছাড়া এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা কোনো কথোপকথন চলাকালে নিজেদের মত প্রকাশ করা ও তৎক্ষনাৎ চিন্তাভাবনা করতে জটিলতার মুখোমুখি হয়।

এই সমস্যাটি প্রকাশ পায় মূলত লেখা এবং লিখিত কোনো অংশের পাঠোদ্ধার করার সময় কারণ তার জন্য সঠিকভাবে ধ্বনি ও বর্নের সমন্বয় করা সম্ভব হয় না।  খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যাক্তির (dyslexic) লিখতে ও পড়তে বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তবে এটি শারীরিক অন্যান্য সমস্যা যেমন চোখ, কিংবা কান অথবা বুদ্ধিমত্বার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়।   

ডিসক্যালকুলিয়া

এই ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত গণিতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। যেমন হিসাব করা, গাণিতিক সূত্র ও সমীকরণ বোঝা ও মনে রাখা এবং সময় ও টাকা সংক্রান্ত বিষয় বুঝতে সমস্যায় পড়ে। ডিসক্যালকুলিয়ার লক্ষণগুলি সাধারণত সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়।

ছোট শিশুরা হয়তো গণনার ক্ষেত্রে জটিলতায় পড়তে পারে। আবার কিছুটা বড় শিশুরা হয়তো সংখ্যা বা কলাম বা সারি উল্টো-পাল্টা করে ফেলতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা বড় হওয়ার পরও গাণিতিক সমস্যা সনাক্ত ও সমাধানে বাঁধার সম্মুখীন হয়।

এই ধরনের ডিসএবিলিটি সাধারণত ফাঙ্কশনাল স্কিল  যেমন বোর্ড গেইম খেলা, কোনো কিছু পরিমাপ করা এবং টাকা গুণার ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি করতে পারে।

ডিসপ্রাক্সিয়া

ডিসপ্রাক্সিয়া সাধারণত শিশুর মোটর স্কিল বা অঙ্গ সঞ্চালনকে প্রভাবিত করে। মোটর দক্ষতা আমাদের চলাফেরা এবং সবকিছুর সমন্বয় করতে সহযোগিতা করে।

ডিসপ্রাক্সিয়া আক্রান্ত শিশু হয়তো আচমকাই কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেতে পারে অথবা একটি চামচ বা পেন্সিল ধরে রাখার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে পারে বা নিজের জুতা পড়তে জটিলতায় পড়তে পারে। এসব শিশু পরবর্তীতে লেখা ও টাইপ করার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তে পারে। এছাড়া আরো বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা যেতে পারে, যেমন :

  • চোখের মুভমেন্টে সমস্যা।
  • কথা বলার ক্ষেত্রে জটিলতা।
  • আলো, স্পর্শ, স্বাদ ও ঘ্রাণের প্রতি সংবেদনশীলতা।

ডিসগ্রাফিয়া

ডিসগ্রাফিয়া হচ্ছে লেখার কাজে জটিলতা বোধ করা অর্থাৎ ডিসগ্রাফিয়া শিশুর লেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। ডিসগ্রাফিয়া আক্রান্ত শিশুর সাধারণত নিম্নলিখিত সমস্যা দেখা যায়। যেমন :

  • বাজে হ্যান্ডরাইটিং।
  • বানান সংক্রান্ত সমস্যা।
  • তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা বা পাঠ্যবই থেকে অর্জিত জ্ঞান খাতায় লিখতে না পারা।

সেন্সরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার

এই ধরনের ডিসেবিলিটি মস্তিষ্কের তথ্য গ্রহণ ক্ষমতা, এর প্রক্রিয়াকরণ এবং কার্যকরী উপায়ে ব্যবহারের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে। লেখক ও থেরাপিস্ট লিন্ডসে বাইয়েল বলেন, “লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত সেন্সরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডারে ভোগে যা তাদের সমস্যা আরো জটিল করে তোলে। তিনি আরো বলেন, “অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা যেমন শব্দের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, শ্রেণীকক্ষে মাথার উপর আলোর ঝলকানি, এমনকি সহপাঠী বা স্কুলের কারো ঘ্রাণও তাদের মনোযোগ ব্যহত করে”।

এই ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুরা প্রায়শই দুটি একই রকমের জিনিস পড়তে বা বুঝতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। পাশাপাশি তারা হাত ও চোখের সমন্বয়ও করতে পারেনা সহজে।

অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার

এটি মস্তিষ্কের শব্দ প্রক্রিয়াকরণে বাঁধার সৃষ্টি করে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুকে বিভিন্ন রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। যেমন :

  • পড়তে না পারা।
  • দুটো কাছাকাছি ধরণের শব্দ আলাদা করতে না পারা।
  • দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে না পারা।
  • যা শুনেছে তা মনে রাখতে না পারা।

লার্নিং ডিসএবিলিটির কারণ

এটি খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে স্কুলে যাওয়ার বয়সী প্রায় ৫% শিশু লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে এর কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। তবে কিছু কিছু বিষয়কে এর জন্য দায়ী মনে করা হয় –

বংশগত ইতিহাস

পরিবারের যে কারো বিশেষ করে বাবা-মা কারো যদি লার্নিং ডিসএবিলিটি থাকে, তাহলে তাদের সন্তানেরও লার্নিং ডিসএবিলিটি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

জন্মের পূর্বে বা পরে অসুস্থতা

জন্মের আগে বা পরে কোনো রকম অসুস্থতা বা আঘাত পাওয়া থেকে লার্নিং ডিসএবিলিটি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় কোনো রকম শারীরিক আঘাত, ভ্রূণের ঠিক মতো বেড়ে উঠতে না পারা, গর্ভকালীন সময় অ্যালকোহল বা মাদকদ্রব্য সেবন, জন্মের সময় ওজন খুব কম হওয়া, নির্ধারিত সময়ের আগে প্রসব বা দীর্ঘ সময় ধরে প্রসব লার্নিং ডিসএবিলিটির অন্যতম কারণ।

মানসিক আঘাত

শিশু বয়সে কোনো রকম মানসিক আঘাত বা হয়রানি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে বাঁধা প্রদান করে। এবং সেই সাথে তার লার্নিং ডিসএবিলিটি হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়।

শারীরিক আঘাত

জন্মের পরে কোনো গুরুতর ব্যাধি যেমন প্রচণ্ড জ্বর, মাথায় আঘাত পাওয়া, অপুষ্টিজনিত কারণ, নার্ভ সিস্টেমে ইনফেকশন ইত্যাদি কারণে লার্নিং ডিসএবিলিটির সম্ভাবনা থাকে।

পারিপার্শ্বিক কারণ

দীর্ঘ সময় ধরে কোনো বিষাক্ত পদার্থ যেমন লেড, সিরামিক, রঙ ইত্যাদির সংস্পর্শে থাকলে লার্নিং ডিসএবিলিটির শঙ্কা থাকে।

কীভাবে বুঝবেন আপনার শিশুর লার্নিং ডিসএবিলিটি রয়েছে কিনা

লার্নিং ডিসএবিলিটি হচ্ছে এমন এক ধরনের ডিসঅর্ডার বা ব্যাধি যার কারণে আমাদের মস্তিষ্কে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সময় কিছু তথ্য মস্তিষ্ক ধারণ কর‍্তে পারেনা বা বুঝতে পারেনা। শিশু বয়স বা প্রাইমারি স্কুলে প্রত্যেক শিশুই নিজের মতো করে কোনো বিষয় বুঝতে বা শিখতে চেষ্টা করে। কিন্তু যদি দেখেন যে আপনার সন্তান সংখ্যা, অক্ষর বা শব্দ চেনা, পড়তে পারা ও লিখতে পারা এবং কথা বলার ক্ষেত্রে ক্রমাগত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তাহলে তার লার্নিং ডিসএবিলিটি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত কোনো শিশু হয়তো কোনো একটি গল্প পড়ে বুঝবে যে এখানে কী বলা হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে তাকে এই সম্পর্কিত প্রশ্ন করা হলে সে আর বলতে পারেনা বা লিখতে পারেনা।

আবার একটি শিশু হয়তো গড়গড়িয়ে বাংলা বা ইংরেজি বর্ণমালা বা গণিতের কোনো নামতা পড়তে পারবে কিন্তু তাকে যখন কোনো নির্দিষ্ট অক্ষর চিহ্নিত করে জিজ্ঞেস করা হয় বা নামতার কোনো একটা অংশ যেমন চার পাঁচে কত হয় এই জাতীয় প্রশ্ন করা হয় তখন সে আর বলতে পারেনা, অথচ একটু আগে পুরোটাই সে বলেছে।

আবার আরেকটি শিশু হয়তো জুতার বেল্ট লাগানো, শার্ট বা সোয়েটারের বোতাম লাগানো এগুলো ঠিক মতো করতে পারেনা। এই সমস্ত লক্ষণ দেখলে বুঝতে পারবেন আপনার শিশুর লার্নিং ডিসএবিলিটি রয়েছে।

বিজ্ঞাপণ

লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুর বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক মাত্রার বা তার চাইতে বেশি থাকতে পারে, কিন্তু তারা তাদের অর্জিত জ্ঞানকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখীন হয়। তাদের জন্য সব বিষয়ে পারদর্শী হওয়া খুব কঠিন কাজ। এজন্য তারা সবসময় বিভিন্ন রকম মানসিক অবসাদ, ক্রোধ, হতাশা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধের অভাব বোধ করে।

আপনার সন্তান হয়তো বুঝতে পারে যে তাকে কি বলতে হবে করতে হবে বা লিখতে হবে, কিন্তু সেই কাজটা করার সঠিক পদ্ধতি সে খুঁজে পায় না। অথবা সে হয়তো বুঝতেই পারেনা তাকে কি করতে হবে। এই সমস্ত লক্ষণ আপনার শিশুর মধ্যে আছে কিনা ভালো করে খেয়াল করে দেখুন, তাহলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আপনার সন্তান লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত কিনা।

লার্নিং ডিসএবিলিটির সতর্কতা সংকেতগুলি কী কী?

শিশুর লার্নিং ডিসএবিলিটি রয়েছে কিনা তা সাধারণত শিশু অন্তত তিন বছর স্কুলে কাটানোর আগ পর্যন্ত পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে এর কিছু লক্ষণ হয়তো বাবা-মারা আগে থেকেই লক্ষ্য করে থাকতে পারেন। যেমন :

  • কথা বলতে দেরী হওয়া (Speech Delay)
  • উচ্চারণে সমস্যা
  • নতুন শব্দ শিখতে সমস্যা হওয়া
  • বর্ণ, সংখ্যা, দিনগুলোর নাম, রং, আকার ইত্যাদি শিখতে সমস্যা হওয়া।
  • মনোযোগ রাখতে না পারা
  • কলম বা পেন্সিল ধরতে সমস্যা হওয়া।
  • জামার বোতাম বা জুতার ফিতা লাগাতে না পারা।
  • পড়া, লেখা, বানান করা, ও গণিতে আশানুরূপ দক্ষ না হওয়া ।
  • একটু আগে বা মাত্রই কী শুনেছে তা মনে রাখতে না পারা।
  • দিকনির্দেশনা বোঝা ও অনুসরণের ক্ষেত্রে জটিলতা বোধ করা।
  • খেলাধূলা, চলাফেরা যেকোনো দক্ষতামূলক কাজে সমন্বয় করতে না পারা যেমন ফুটবলে কিক মারতে না পারা অথবা কলম ধরে রাখতে না পারা।
  • সময় এর ব্যাপারটা বুঝতে না পারা যেমন এখন কয়টা বাজে দশ মিনিট পর কয়টা হবে এসব ব্যাপারে সমস্যার মুখোমুখি হওয়া।

লার্নিং ডিসএবিলিটির কোনো প্রতিকার রয়েছে কি?

লার্নিং ডিসএবিলিটির কোনো নিরাময় নেই, তবে early intervention অর্থাৎ যত ছোটো বয়সে এই সমস্যা সনাক্ত করা যায়, এবং যত তাড়াতাড়ি প্রফেশ্যানালদের সাহায্য নিয়ে শিশুকে উৎসাহ প্রদান করে, তার অন্যান্য গুনাবলির বিকাশ ঘটিয়ে এবং আক্রান্তদের জন্য সহায়ক বিশেষ উপায়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে তাকে নিরাময় অযোগ্য এই সমস্যাটির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে শেখানো শুরু করা যায়, ততই পরবর্তী জীবনে তার সাফল্যের সম্ভবনা বেড়ে যায়।

বাড়তি সহযোগিতা

একজন রিডিং স্পেশালিষ্ট (পড়ার পদ্ধতি শেখাতে সাহায্য করেন), একজন গণিতের শিক্ষক অথবা অন্য যেকোনো প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী বা শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেন যিনি বা যারা আপনার শিশুকে বিভিন্ন রকম সহজ ও সাবলীল পদ্ধতিতে পড়াশোনা, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক দক্ষতার উন্নতিতে সহায়তা করবে।

একক শিক্ষা ব্যবস্থা

আপনার সন্তানের যদি স্কুলে বা কোচিংয়ে অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে পড়া বুঝতে বা শুনতে কোনো রকম সমস্যা হয় তাহলে তার স্কুলের যেকোনো শিক্ষক বা বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক তাকে আলাদাভাবে বিষয়গুলো ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারেন।

সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি

শ্রেণীকক্ষে শিশুকে কিছু বিশেষ সুবিধা দেয়া যেতে পারে, যেমন অ্যাসাইনমেন্ট বা পরীক্ষায় সময় কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া, শিশুকে শিক্ষকের পাশাপাশি বসানো যাতে সে ভালো মতো মনোযোগ দিতে পারে। আবার শিশু কম্পিউটারের সাহায্য নিতে পারে যার মাধ্যমে তার লেখা ও টাইপ করার ক্ষমতা বাড়বে এবং গণিতের সমাধানেও উপকারী হতে পারে। পাশাপাশি শিশুকে একটি অডিওবুক দিতে পারেন যার মাধ্যমে তার শ্রবণ ক্ষমতা ও পড়ার ক্ষমতা দুটোরই উন্নতি হবে।

থেরাপি

এটি মূলত শিশুর লার্নিং ডিসএবিলিটির ধরনের উপর নির্ভরশীল। অনেক শিশুরই থেরাপি দেওয়াতে উপকার হতে পারে। যেমন ‘অকুপেশনাল থেরাপি’ শিশুর অঙ্গ সঞ্চালনের উন্নতি ঘটায় যা তার লেখনীর সমস্যা হ্রাস করে। আবার “স্পিচ থেরাপি” তার ভাষা ও কথা বলা সংক্রান্ত সমস্যার বিকাশে সহযোগিতা করে।

ঔষধ

শিশুর পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে তার চিকিৎসক হয়তো তাকে ডিপ্রেশন, হতাশা ও অন্যান্য মানসিক সমস্যার ঔষধ দিতে পারেন। এসব ঔষধ তার পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হতে উপকারী হতে পারে।

বিকল্প থেরাপি/চিকিৎসা

গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে নাচ, গান বা ছবি আঁকা লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে। অনেকে মনে করেন যে ডায়েট বা খাওয়া-দাওয়ার পরিবর্তন, ভিটামিনের ব্যবহার, চোখের অনুশীলন, প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে উপকারী হতে পারে। তবে এসব বিষয়ে বিস্তারিত ও সঠিক ফলাফল জানার জন্য আরো গবেষণা প্রয়োজন।

শিশুর সমস্যা যত তাড়াতাড়ি ধরতে পারা যায় আর যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই ভালো। আর চিকিৎসাকালীন লক্ষ্য করবেন সন্তান চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছে কিনা বা তার উন্নতি হচ্ছে কিনা। যদি না হয়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তন করতে পারেন।

অভিভাবকগণ কীভাবে ভিন্নভাবে শেখা চিন্তা করা সন্তানদের সাহায্য করতে পারেন?

এই রোগে আক্রান্ত শিশুদেরকে বিভিন্নভাবেই সহযোগিতা করা যায় যাতে তাদের কাজগুলো সহজে হয়ে আসে। এই ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালন করতে পারেন তাদের বাবা-মা। মা-বাবা হিসেবে সবচেয়ে ভালো যে কাজটা আপনি করতে পারেন সেটা হচ্ছে তাদেরকে ভালোবাসুন এবং তাদেরকে সমর্থন করুন। এছাড়াও তাদেরকে আরো বিভিন্নভাবে আপনি সাহায্য করতে পারেন। যেমন :

রোগটি সম্পর্কে সবকিছু জেনে নিন

আপনার সন্তানের লার্নিং ডিসএবিলিটি কি ধরনের, কোন পর্যায়ে আছে এবং কীভাবে এটি শেখার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। তার চিকিৎসকদের সাথে রোগটি নিয়ে কথা বলুন এবং জানুন। পাশাপাশি নিজেও রোগটি সম্পর্কে গবেষণা করুন এবং এতে উপকারী হতে পারে এমন কোনো পদ্ধতি খুঁজে বের করুন। মোটকথা সন্তানের ভালোর বা সুস্থতার জন্য আপনি যা যা করতে পারেন সবই করুন।

তার শক্তির জায়গায় ফোকাস করুন

সব শিশুরই এমন কোনো বিষয় বা কাজ রয়েছে যা তার ভালো লাগে এবং যা তার ভালো লাগে না। আপনার সন্তানের পছন্দের ও শক্তিমত্তার জায়গা খুঁজে বের করুন এবং তাকে এগুলোতে আরো উন্নতি কর‍্তে সহায়তা করুন। হতে পারে সে ভালো গান করে, নাচে পারদর্শী, খেলাধূলায় ভালো, গণিতে ভালো অথবা ভালো আর্ট করতে পারে। তাকে ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করুন এবং প্রতিবার যখন সে কোনো ভালো কাজ করবে তখন অবশ্যই তার প্রশংসা করবেন।

আপনার সন্তানের উকিল হন

আপনার সন্তানের জন্য একক শিক্ষা পরিকল্পনা (এমন একটি পরিকল্পনা যা শিশুর জন্য একটি কাঙ্খিত লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করে) করতে স্কুল প্রশাসন ও শিক্ষকদের সাথে কাজ করুন এবং তাদের সহযোগিতা করুন।

বিশেষ শিক্ষা আইন ও স্কুলের নীতিগুলো সম্পর্কে জানুন যাতে আপনি নিশ্চিত করতে পারেন যে আপনার সন্তান স্কুল থেকে সব রকমের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। এমন অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে যেগুলো শুধুমাত্র তখনই দেওয়া হয় যখন আপনি চাইবেন। তাই আপনার সন্তানের জন্য সবরকম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করুন। পাশাপাশি সে এখান থেকে কতটা লাভবান হচ্ছে সেটাও লক্ষ্য করুন।

আপনার সন্তানের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন

একজন শিশু যার রাত্রিবেলায় পর্যাপ্ত ঘুম হয়, যে স্বাস্থ্যকর খাবার খায়, এবং প্রচুর পরিমাণে শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম করে সে শিশু শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই ভালো থাকে। তাই আপনার সন্তানের ভালো থাকা নিশ্চিত করতে তার মধ্যে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও শৃঙ্খলা গড়ে তুলুন।

সন্তানের মানসিক অবস্থার প্রতি মনোযাগী হন

লার্নিং ডিসএবিলিটি আপনার সন্তানের আত্নমর্যাদাবোধ ও আত্মসম্মান কমিয়ে দেয়। লক্ষ্য করুন সন্তানের মধ্যে ডিপ্রেশন বা অন্যান্য মানসিক সমস্যার কোনো লক্ষণ দেখতে পান কিনা যেমন – তার স্বাভাবিক কর্মকান্ডে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মেজাজ অতিরিক্ত খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ঘুমের পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি। এই সমস্ত লক্ষণ দেখলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করুন

লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত শিশুর পিতা-মাতারা সবসময় তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় থাকেন। তাদেরকে নিজেদের পছন্দ ও শক্তিমত্তা অনুযায়ী ক্যারিয়ার গড়তে সহযোগিতা করুন।

তাদেরকে মনে করিয়ে দিন যে কোনো কিছু ভিন্নভাবে শেখার সাথে তার বুদ্ধিমত্তা বা মেধার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং লার্নিং ডিসএবিলিটিতে আক্রান্ত ছিলেন বা আক্রান্ত এমন অনেকেই বর্তমানে বেশ ভালো অবস্থানে আছে।

অনেক প্রতিষ্ঠানই ভিন্নভাবে চিন্তা করা বা শেখা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে থাকে। এগুলো ওই সমস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই উপকারী হতে পারে। তাই আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তাকে ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করুন।

ভিন্নভাবে চিন্তা করা ও শেখা শিশুরাও সহযোগিতা পেলে অনেক ভালো কিছু করতে পারে। যত তাড়াতাড়ি আপনি আপনার শিশুর সমস্যার কথা জানবেন বা বুঝবেন ততো বেশি আপনি তাকে সাহায্য করতে পারবেন। সমস্যা বুঝতে পারা মাত্রই তার শিক্ষক এবং চিকিৎসকদের সাথে কথা বলুন। সবার সমর্থনে আপনার শিশুও বেশ ভালোভাবেই জীবনযাপন করতে পারবেন।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment