রুবেলা ভাইরাস বা জার্মান হাম কি?
রুবেলা একটি সংক্রামক রোগ। এটি ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এ রোগের জীবাণু প্রধানত বাতাস থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় সুস্থ শরীরে প্রবেশ করে। যদি আপনার রুবেলা হয় তবে আপনার শরীর খারাপ লাগতেপারে , যার সাথে গলার গ্রন্থি ফুলতে পারে এবং অল্প জ্বর বা গলা ব্যথা এবং ত্বকে ফুসকুড়ি ( র্যাশ) হতে পারে ।
কোন কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে রুবেলার কোন লক্ষণই দেখা যায় না। গর্ভবতী মায়েরা গর্ভের প্রথম তিন মাসের সময় রুবেলা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে গর্ভস্থ শিশুটি জন্মগত জটিলতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যা কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম নামে পরিচিত। এমনকি শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।
রুবেলা রোগের লক্ষণগুলো কি কি?
রুবেলা রোগটিকে অনেকে জার্মান হামও বলে থাকেন। এ রোগের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো হামের মতোই। এ রোগের প্রধান লক্ষণ হলো-
- গোলাপি রং-এর হালকা দানা দেখা যায়। প্রথমে দানা মুখমন্ডলে বের হয় যা পরবর্তী ৫-৭ দিনের মধ্যে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।
- ঘাড়ের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
- অল্প জ্বর, সর্দি ও কাশি, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা
- চোখ লাল হওয়া
- ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থি সন্ধি ব্যথা হতে পারে
- অস্বস্থিবোধ করা
রুবেলা কিভাবে শিশুর ক্ষতি করে-
গর্ভধারণের তিন মাসের সময় রুবেলা ভাইরাস আক্রমণ করলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে মায়ের থেকে গর্ভের শিশু আক্রান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে গর্ভপাত; এমনকি গর্ভের শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। শিশুর হৃদযন্ত্রে ছিদ্র হতে পারে, শিশু অন্ধও হতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে দুই হাজার ৯৭৯ জন রুবেলায় আক্রান্ত হয়।
শিশুদের জন্য এ রোগ খুব মারাত্মক না হলেও এটির ভাইরাস দ্বারা কোনো গর্ভবতী মা সংক্রমিত হলে, বিশেষ করে গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসের মধ্যে, তাহলে ৮৫ শতাংশ গর্ভস্থ শিশুর অনেক ধরনের মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন-গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করার আগেই মাতৃজঠরে শিশু মৃত্যুবরণ করে, জন্মের সময় শিশুর ওজন কম হয় বা শারীরিক ত্রুটি নিয়ে শিশু এ পৃথিবীতে আসে।এ সমস্যাগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ‘জন্মগত বা কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম’। জন্মগত সমস্যাগুলো-
- চোখে ছানি, গ্লুকোমা, দৃষ্টিশক্তি কম বা অন্ধত্ব।
- হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব নষ্ট বা হৃৎপিণ্ডের ভেতর ফুটো থাকে, যার জন্য নবজাতক জন্মের পরপরই মৃত্যুবরণ করে।
- মাথার আকার ছোট।
- মানসিক বিকলাঙ্গ বা বুদ্ধি কম।
- কানে কম শোনা বা বধিরতা।
রুবেলা প্রতিরোধে করণীয় কি?
এ রোগ প্রতিরোধের জন্য শিশুর বয়স ৯ মাস হলে এক ডোজ এমআর টিকা ও ১৫ মাস পূর্ণ হলে হামের দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিতে হয়। কিশোরীদের বয়স ১৫ বছর পূর্ণ হলে এক ডোজ এমআর টিকা, এক ডোজ টিটি টিকার সঙ্গে দিতে হবে। পরবর্তী পাঁচ ডোজ টিটি টিকার সময় অনুযায়ী শেষ করতে হবে।
রুবেলা রোগ বা জার্মান হাম সবার জন্য জানা দরকার। এ ক্ষেত্রে মায়েদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে ও এ রোগের প্রয়োজনীয় টিকাটি সময়মতো দিতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ও ক্যানসার, যক্ষ্মা আক্রান্ত শিশু-কিশোরীকে এ এমআর টিকা দেয়া যাবে না।
গর্ভাবস্থায়ও এ টিকা দেয়া যাবে না। তাই গর্ভাবস্থায় রুবেলা রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রত্যেক ১৫ বছর বয়সী কিশোরীকে প্রাপ্যতা অনুসারে ৫ ডোজ টিটি টিকার যে কোনোটির সাথে ১ ডোজ এম আর টিকা গ্রহণ করতে হবে।
গর্ভবতী মায়ের এ রোগ হলে তাঁর জন্যও কোনো চিকিৎসা নেই। গর্ভস্থ শিশুকে রক্ষা করারও কোনো উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মায় বা মৃত্যুবরণ করে। এ জন্য রুবেলা সংক্রমণের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হলো একে প্রতিরোধ করা। টিকার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে শিশু অবস্থায় আপনার রবেুলা হয়েছিল বা দুটি এমএমআর টিকাগ্রহণ করেছিলেন। যদি আপনি নিশ্চিত না থাকেন তাহলে বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনে নিন। আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করতে আপনাকে একটি রক্তপরীক্ষা করতে হতে পারে ।
টীকা দেয়া না থাকলে গর্ভধারণের আগেই তিন মাস বাদ দিয়ে দটিু এমএমআর টিকা গ্রহণ করতে হবে যার দ্বিতীয়টি গর্ভ ধারণের অন্তত এক মাস আগে হলে,তা এই রোগটি থেকে উত্কৃষ্টভাবে আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে । শিশুকালে একবার রুবেলা হলে পরবর্তীতে তা আবার হওয়া খুবই বিরল। তবুও এটি গুরুত্বপূর্ণ যে গর্ভধারণের পরিকল্পনার আগের আরেকবার রুবেলার পরীক্ষা করে নেয়া।
গর্ভাবস্থায় রুবেলার পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ হলে বাচ্চার অসুবিধা হতে পারে। এ অবস্থায় তার সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করা উচিত এবং কর্মস্থলে যথাসম্ভব কম যাওয়া ভালো। সন্তান জন্মদানের পর সে টিকা নিয়ে নেবে।
বাচ্চা দুধ পাওয়ার সময় রুবেলা টিকা নেওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাতে মা ও বাচ্চার কোনও ক্ষতি হয় না। যদি আপনি হাসপাতালে প্রসব করে থাকেন, আপনি বাসায় ফেরার আগে প্রথমটি দিতে হবে । আপনার চিকিৎসক আপনাকে দ্বিতীয়টি দেবেন।
এমআর টিকা
আলাদাভাবে রুবেলার টিকা পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে হাম ও মাম্পস রোগের টিকার সঙ্গে একত্রে রুবেলার টিকা পাওয়া যায় এমএমআর নামে। এ টিকা দুটি দিতে হয়। প্রথমটি শিশুর ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে এবং দ্বিতীয়টি চার থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এ টিকা মাংসপেশিতে দিতে হয় এবং এর কোনো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই।
এমএমআর টিকা শিশুদের জন্য অত্যন্ত দরকারি, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের জন্য। ছেলেশিশুরাও এ টিকার মাধ্যমে হাম, রুবেলা ও মাম্পস রোগ থেকে মুক্ত থাকবে। যদি কোনো কারণে শৈশবে শিশুকে এ টিকা দেওয়া না হয়, তাহলে যেকোনো সময়ে এ টিকা কিশোর বা কৈশোর উত্তীর্ণদেরও দেওয়া যায়, যা শিশুদের ভালো রাখবে এবং পরবর্তী প্রজন্মকেও বিপদমুক্ত রাখবে।
টিকা পরবর্তী বিরূপ প্রতিক্রিয়া (AEFI) :
এমআর (হাম-রুবেলা) টিকা খুবই নিরাপদ। এই টিকা দেয়ার পর সাধারণত টিকার স্থানে সামান্য ব্যথা ও জ্বর হতে পারে। এগুলো এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। তবে খুবই অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ ধরনের কোনো সমস্যা হলে এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে যোগাযোগ করুন অথবা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অতিসত্বর প্রেরণ করুন।
টিকা প্রাপ্তির পর কোনো অসুবিধা হয় কিনা না দেখার জন্য প্রতিটি শিশুকে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা টিকা কেন্দ্রে অপেক্ষা করতে হবে। টিকাদানকারী শেষ টিকা দেয়ার পর এক ঘণ্টা পর্যন্ত কেন্দ্রে অপেক্ষা করবেন।
সবার জন্য শুভকামনা।