শিশুকে বোতলে দুধ খাওয়া অভ্যাস করানোর সবচাইতে সেরা উপায়
বেশিরভাগ ল্যাক্টেশন বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুকে ফিডার বা বোতলে দুধ খাওয়া অভ্যাস করানোর পূর্বে শিশুর নুন্যতম এক মাস বয়স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যাতে বাচ্চা ঠিকমত স্তন্যপান করা শেখার সুযোগ পায়।
আপনার যদি অফিস অথবা অন্যান্য কর্মব্যস্ততা থাকে তাহলে ব্যস্ততা শুরু হওয়ার নুন্যতম দুই সপ্তাহ আগে থেকে শিশুকে ফিডারের মাধ্যমে খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করতে হবে। এতে করে আপনি এবং আপনার শিশু উভয়েই নতুন এই বিষয়টার সাথে মানিতে নেয়ার সময় পাবেন। (ফিডারে দুধ খাওয়ানো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের বোতলে দুধ খাওয়ানোর আর্টিকেলগুলো পড়ুন)
ফিডারে বা বোতলে দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা স্তন্যপান থেকে একটু ভিন্ন রকম, কেননা এতে মুখ ও জিহ্বার ভিন্ন রকম নড়াচড়ার প্রয়োজন পরে। তাই এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য শিশুর কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। স্তন্যপান থেকে শিশুর অভ্যাস ফিডারের দিকে পরিবর্তন করাকে আরেকটু সহজ করার জন্য নিচের এই টিপসগুলো অনুসরণ করতে পারেনঃ
বিকেলে শিশুকে নিয়মিত স্তন্যপান করানোর পরে তাকে ফিডারে করে দুধ খেতে দিন, যাতে করে সে ফিডারের নিপলের সাথে মানিয়ে নিতে পারে। ফিডারের মধ্যে অর্ধেক আউন্সের মত অল্প পরিমাণে বুকের দুধ দিয়ে তাকে অভ্যাস করানো শুরু করুন।
এমন নিপল দিয়ে শুরু করতে পারেন, যেটাতে দুধ অপেক্ষাকৃত একটু ধীরে বের হয়। কেননা, একদম নবজাতকদের যদি আপনি সাধারণ নিপলের মাধ্যমে ফিডারে করে দুধ খাওয়াতে চান তাহলে অনেক বেশি পরিমাণে দুধ বের হবে, যেটা শিশুর জন্য মানিয়ে নেয়াটা একটু কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথমবার যখন ফিডারে করে দুধ খাওয়াতে যাবেন তখন আপনি নিজে না দিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে ফিডারে করে দুধ খাওয়ান। যদি আপনি নিজেই তাকে ফিডারের দুধ খাওয়াতে যান, তাহলে সহজাত ভাবে সে একটু অবাক হবে যে আপনি কেন তাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন না। তাই অন্য কেউ যদি প্রথমবারের মত ফিডারে করে খাওয়ায় তাহলে আপনার শিশু একটু কম বিভ্রান্ত হবে। এ ব্যাপারে আপনার মা, আপনার সঙ্গী, শিশুর নার্স অথবা অন্য কোন বন্ধুর সাহায্য নিতে পারেন।
যখন অন্য কেউ শিশুকে ফিডারে করে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন, তখন আপনি বাসার বাইরে থাকুন। কেননা শিশু অনেক দূর থেকেও তার মায়ের ঘ্রাণ পেয়ে থাকে। তাই আপনি যদি পাশের রুমের থাকেন তাহলে সে বুঝতে পারবে আপনি আশেপাশেই আছেন।
টরি উইনিক তার সন্তান ফিলিপকে ৩ সপ্তাহ বয়স থেকেই ফিডার দিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমার এখনো মনে আছে, আমি বুকের দুধ পাম্প করে ফিডারের মধ্যে নিয়ে আমার স্বামীকে দিয়ে সন্তানকে খাইয়েছি” তিনি আরো বলেন, “আমাদের অনেকগুলো নিপল পরিবর্তন করে দেখতে হয়েছে, এরপর আমরা একটা ফিডার পেয়েছি যেটা বুকের নিপলের সাদৃশ্য। আমার স্বামী মাইক যখন ফিলিপকে ফিডারে করে দুধ খাওয়াত তখন তার কাছেও বিষয়টি খুব ভালো লাগত, এই কারণে যে শুধু আমি না বরং সেও শিশুকে খাওয়াতে পারছে।”
আপনি যখন বাসায় থাকেন না তখন শিশু কিন্তু খুব একটা খাওয়া দাওয়া করতে চায় না এবং যে দিনগুলোতে আপনি অফিসে বা কাজে থাকেন তখন রাতে প্রায়ই শিশু জেগে যায়। মাঝরাতে যখন শিশু জেগে যাবে তখন খুব একটা অবাক হবেন না বরং এই সময়টাকে কাজে লাগান। কেননা, দিনের বেলায় ব্যস্ততার কারণে আপনি শিশুকে তেমন একটা আদর করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
শিশু যদি বোতলে খেতে না চায়, তখন আপনি কি করবেন?
কিছু শিশু কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই খুব দ্রুত ফিডারের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে অনেক সমস্যা দেখা যায়। এই অভ্যাস পরিবর্তন করতে আপনার শিশুর যদি কষ্ট হয়, তাহলে নিচের এই উপায়গুলো অবলম্বন করে দেখতে পারেনঃ
ফিডারে এমন নিপল ব্যাবহার করুন, যেটা শিশুর মায়ের নিপলের সাদৃশ্য। এছাড়া শিশু যদি চুষনিতে অভ্যস্ত থাকে তাহলে এমন বোতল ব্যাবহার করুন যেটার নিপল তার চুষ নিরমত। শিশুকে খাওয়ানোর আগে নিপল একটু কুসুম গরম পানিতে রেখে দিন, যাতে করে শিশুর জন্য সেটা মেনে নিতে একটু সহজ হয় এবং তার কাছে এটা বাস্তব সাদৃশ্য হয়।
নিপলে কিছু বুকের দুধ লাগিয়ে দিন। কেননা, যখন আপনার শিশু নিপলে মুখ লাগানোর সাথে সাথেই বুকের দুধের স্বাদ পেয়ে যাবে তখন সে আরো খাওয়ার জন্য নিপল চুষতে শুরু করবে। (১২ মাস বয়সের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে কখনো নিপলে মধু ব্যবহার করবেন না, কেননা এতে করে তার খাবারে বিষক্রিয়া হতে পারে)
শিশুকে নিপল নিয়ে খেলতে দিন, এতে করে সে নিপলের সাথে পরিচিত হতে পারবে। যদি সে নিপল কামড়াতে চেষ্টা করে, তাহলে তাকে সেটা করতে দিন। এতে করে অচিরেই সে নিপল শিশু চুষতে শুরু করবে।
শিশুকে অন্য কোন পজিশনে ধরে দুধ খাওয়ান। শিশুকে আধশোয়া অবস্থায় শিশুদের জন্য তৈরি বিশেষ বিছানায় বা কার সিটে রেখে তাকে ফিডারে করে দুধ খাওয়াতে পারেন। অথবা আপনার কোলে রেখেও শিশুকে খাওয়াতে পারেন, তবে খেয়াল রাখবেন শিশুর পিঠ যেন আপনার দিকে হয় অর্থাৎ শিশু বুকের দুধ খাওয়ার সময় যেভাবে থাকে তার বিপরীত দিকে রেখে শিশুকে ফিডারে খাওয়ান। সে যখন বোতলে খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন আপনি আগের মত করেই তাকে খাওয়াতে পারেন।
ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রার দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে দেখুন। কেননা ব্যাপারটা এমনও হতে পারে যে, শিশু একটু কুসুম গরম দুধ খেতে পছন্দ করে। তাই ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রার দুধ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন। এছাড়াও আপনি একটু খেয়াল করে দেখবেন যে, মাত্র পাম্প করা দুধ ও ফ্রিজে রাখা দুধের মধ্যে কোনটা সে খেতে চায়।
বিভিন্ন সময়ে ফিডারে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। যেমন ধরুন, আপনার শিশু যদি দিনের বেলায় ফিডার খেতে না চায় তাহলে তাকে রাতের বেলায় ফিডার খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। আবার রাতের বেলায় খেতে না চাইলে দিনের বেলায় চেষ্টা করুন।
কোন কোন বুদ্ধিমান বাবা তার স্ত্রীর পোশাক গায়ে দিয়ে ফিডারকে বগলের নিচে রেখে বুকের দুধ খাওয়ানোর মত করে শিশুকে ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এমন উর্বর চিন্তা ভাবনা বাবাদের ক্ষেত্রে কাজ করে তবে মায়েদের ক্ষেত্রে তেমন একটা কাজ করে না।
সবকিছু চেষ্টা করেছেন, তবুও শিশু কিছুতেই বোতলে দুধ খেতে চাচ্ছে না?
শিশুদের নতুন কোন অভ্যাসের সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগতে পারে। আর তাই নতুন কোন উপায় অবলম্বন করার আগে একই বোতল, নিপল এবং টেকনিক দিয়ে বেশ কিছুদিন চেষ্টা করুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চেষ্টা অথবা নিপল পরিবর্তন করলে শিশু হয়ত বিভ্রান্ত এবং হতাশ হয়ে যেতে পারে।
একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবেন, শিশুকে নতুন অভ্যাসের সাথে মানিয়ে নিতে যখন চেষ্টা করবেন, তখন যেন আপনার হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় থাকে। যদি আপনার শিশু ফিডার দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করার সময় কাঁদে এবং ফিডার ঠেলে সরিয়ে দেয়, তাহলে একটু থামুন শিশুকে আদর করুন এবং এরপর পুনরায় চেষ্টা করুন।
আর এইভাবে পর পর তিনবার যদি শিশু ফিডার দিয়ে খেতে না চায় তাহলে আপাতত এই চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। তবে এক্ষেত্রে সাথে সাথে বুকের দুধ খাওয়াবেন না, পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন এরপর বুকের দুধ খাওয়ান। এতে করে শিশুর এই ধারণা সৃষ্টি হবে না যে ফিডার খেতে না চাইলে সাথে সাথেই সে বুকের দুধ খেতে পারবে।
দুই এক ঘণ্টা পর আপনার শিশু যখন একটু কম ক্ষুধার্ত থাকবে তখন আবার চেষ্টা করুন তাকে ফিডারের সাথে অভ্যস্ত করে তুলতে।
প্রাথমিক অবস্থায় শিশু খুব সহজেই ফিডারে করে খাওয়া মেনে নিয়েছিল, কিন্তু এখন আবার সে বুকের দুধ ছাড়া খেতে চায় না
প্রাথমিক অবস্থায় শিশু যদি ফিডার মেনে নেয় তবে কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনার শিশু সবসময়েই ফিডার দিয়ে খাওয়া মেনে নিবে। কেননা অনেক শিশুই প্রাথমিক অবস্থায় ফিডারে করে খাওয়া মেনে নিলেও তারা পরবর্তীতে আবার ফিডারে করে না খেয়ে বুকের দুধ খেতে চাইতে পারে। আর শিশু এটা কেনই বা চাইবে না? বুকের দুধ খেতে উষ্ণ, আরাম এবং এই সময়ে তার প্রিয় মানুষ অর্থাৎ তার মা তার পাশেই থাকে।
তবে এতে খুব একটা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, কেননা বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই এটা তার স্বাভাবিক বৃদ্ধিরই একটা অংশ। তাই হুট করে যদি শিশু ফিডারে করে খাওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে বার বার চেষ্টা করার আগে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করে দেখুন এর পিছনে কি অন্য কোন অসুস্থতা জনিত কারণ আছে কি না।
আপনি যদি বোতলে খাওয়ানো একদমই বাদ দিয়ে শিশুকে কাপ দিয়ে খাওয়াতে চান তাহলে কি করবেন?
কোন কোন দেশে বাচ্চাকে খুব বেশি সময় দেয়া সম্ভব না হলে একদম শুরু থেকেই কাপ দিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস করা হয়। এই পদ্ধতির কিছু ভালো দিক আছেঃ যেমন নিপল নিয়ে শিশুর মধ্যে কোন ধরনের বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকবে না। এছাড়াও শিশুর ঘুমানোর সময় আপনাকে বোতল ধরে রাখতে হবে না, আর এইভাবে ফিডার ধরে রাখলে শিশু দাঁত ক্ষয়েরও সম্ভাবনা থাকে। আর আপনাকে ফিডারের অভ্যাস পরিবর্তনের জন্যও বারবার চেষ্টা করতে হবে না।
শিশুকে কাপের মাধ্যমে খাওয়ানোর অভ্যাস করাটা অবশ্যই বেশ সময় সাপেক্ষিক। তবে সিপি কাপের মাধ্যমে অথবা কাপের মধ্যে স্ট্র দিয়ে খাওয়ানোটা অপেক্ষাকৃত একটু সহজ।
কাপের মাধ্যমে শিশুকে খাওয়ানোর অভ্যাস করার বেশিরভাগ নিয়মই ফিডারে খাওয়ানোর অভ্যাস করার মতই। শিশুকে অল্প বয়স থেকেই কাপ দিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস তৈরি করুন (তবে সেটা কখনই ভালোভাবে বুকে দুধ খাওয়া শেখার আগে নয়)। প্রতিদিন একবার করে কাপের মাধ্যমে খাইয়ে ধীরে ধীরে শিশুকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করুন।
যদি সামনে আপনার কর্ম ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় তাহলে তার নুন্যতম এক সপ্তাহ আগে থেকে শিশুকে কাপের মাধ্যমে খাওয়ানোর অভ্যাস তরী করুন। এতে করে নতুন অভ্যাসের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য আপনি এবং শিশু উভয়ই যথেষ্ট পরিমাণে সময় পাবে।
যখন বোতলে খাওয়ানো কোনভাবেই সম্ভব হয়না
এমনটা যদি ঘটে তবে নিজেকে দোষারোপ করতে যাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনার তখন মনে হতে পারে, ঈশ! আমি যদি একদম শুরু থেকেই ধীরে ধীরে ফিডার দিয়ে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করতাম তাহলে আজকে এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হত না। তবে এটা কিন্তু একদমই সত্য নয় আর নিজেকে দোষারোপ করারও কিছু নেই। কেননা, কোন কোন শিশু একদমই ফিডার দিয়ে খায় না।
আবার কেউ আপনাকে এমন বলতে পারে যে, ” শিশু অনেক ক্ষুধার্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর। অনেক খুদা লাগলে শিশু নিজ থেকেই ফিডারে করে খাবে।” আর এই তথ্যটিও একদম সঠিক নয় এবং শিশুকে দীর্ঘ সময় ধরে না খাইতে রাখাটা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য কিন্তু মোটেও ভালো কিছু নয়। কোন অবস্থাতেই খাবারের সময়টাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিবর্তন করবেন না।
যদি ফিডারে খাওয়ানোর সকল প্রচেষ্টাই একদম ব্যর্থ হয় তাহলে শিশুকে কাপ দিয়ে খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা শুরু করে দিন। শিশুকে এক হাতের উপর একটু সোজা করে ধরুন এবং অন্য হাত দিয়ে তার মুখে ধীরে ধীরে সামান্য পাম্প করা বুকের দুধ অথবা ফরমুলা দুধ ঢালুন। প্রথম দিকে সে হয়ত মুখ থেকে বের করে দিবে, তবে ধীরে ধীরে সে একসময় কাপ দিয়ে খাওয়া শিখে যাবে। এছাড়া লম্বা ডাঁট ওয়ালা ওষুধ খাওয়ানোর চামচ (Hollow handled medicine spoon) দিয়েও আপনি এটা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
সবার জন্য শুভকামনা।