সাধারণত বেবি পাউডার তৈরি হয় মিনারেল ট্যাল্ক থেকে অথবা কর্ণ স্টার্চ থেকে। যদিও বেবি পাউডার ব্যাবহার করার জন্য আদতে কোন স্বাস্থ্যগত কারণ নেই, তবে অনেক বাবা মা এটা ব্যাবহার করেন তাদের ডায়পার পরা শিশুর ত্বককে শুষ্ক এবং র্যাশমুক্ত রাখার জন্য।
বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে এই ধরনের পাউডার শিশুর নিশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে এবং শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া অন্যান্য কিছু গবেষণায় ট্যাল্ক ব্যাবহারের সাথে ক্যানসারের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গেছে।
বেবি পাউডার সাধারণত কি দিয়ে তৈরি করা হয়?
বেশীরভাগ ট্যালকম পাউডার তৈরি হয় ট্যালকম থেকে আর ঠিক এই কারণেই এই ধরনের পাউডার ট্যালকম পাউডার নামেও বহুল পরিচিত। ট্যালকম পাউডার তৈরির প্রধান উপাদান হল ট্যাল্ক, এটা এক ধরনের মিনারেল যার মধ্যে সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম এবং অক্সিজেন বিদ্যমান।
যেহেতু এই ট্যালকমের মধ্যে আর্দ্রতা শুষে নেয়া এবং এবং ঘর্ষণ কমানোর ক্ষমতা রয়েছে তাই অনেক বেবি পাউডার প্রস্ততকারক এই ট্যালকম দিয়েই বেবি পাউডার তৈরি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এছাড়া বেশ কিছু বেবি পাউডার কর্ণ স্টার্চ থেকেও তৈরি করা হয়, আর এই উপাদানটি ট্যালকম থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
এটা তৈরি হয় কর্ণ অর্থাৎ ভুট্টা থেকে এবং এর গুড়ো গুলোও বেশ বড় বড় দানাদার হয়, যার ফলে শিশুর নিশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করার সম্ভাবনাও বেশ কম থাকে। আর তাই ডাক্তারদের মতেও ট্যালকম পাউডার থেকে কর্ণ স্ট্র্যাচ দিয়ে তৈরি পাউডার অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ।
দৈনিক বেবি পাউডার ব্যাবহারের কারণে শিশুর উপর স্বাস্থ্যগত যে প্রভাবগুলো পড়তে পারে
বেশ কয়েক বছর ধরে একটানা ট্যালকম পাউডার ব্যাবহার করলে সেটা শিশুর শরীরের উপর ঠিক কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে এ বিষয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। সেই গবেষণাগুলো থেকে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য উঠে আসে নি, তবে এই গবেষণা থেকে উঠে আসা দুটি তথ্য বাবা মায়েদের জেনে রাখা প্রয়োজন।
শ্বাস প্রশ্বাস জনিত সমস্যা
আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স এই মর্মে একটি তথ্য প্রকাশ করেছে যে ট্যালকম এবং কর্ণ স্টার্চ থেকে তৈরি এই ধরনের বেবি পাউডার ব্যাবহার করলে শিশুর শরীরের জন্য এটা বেশ ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। কেননা, শিশুরা নিশ্বাসের মাধ্যমে এই পাউডারের গুঁড়ো গ্রহণ করে ফেলতে পারে এবং তার তার ফুসফুসের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
যে সকল বাবা মায়েরা দৈনিক দশবারের থেকে বেশি ডায়পার পরিবর্তন করে বেবি পাউডার ব্যবহার করেন তাদের শিশুদের সাথে সাথে নিজেরাও সর্দি, কাশি এবং শ্বাস প্রশ্বাস জনিত সমস্যা এবং ফুসফুসে তীব্র সমস্যার ঝুঁকিতে থাকে।
Centers for disease control and prevention (CDC) এবং Occupational Safety and Health Administration এর মতেও শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ট্যালকম চলে গেলে সেটা বেশ ক্ষতিকর। এছাড়া কোন শিশু যদি বিশেষ ভাবে সংবেদনশীল হয়ে থাকে তাহলে একটু অতিরিক্ত ট্যালকম ব্যাবহারের কারণে তার মধ্যে হাঁপানি এবং নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
ক্যানসার জনিত উদ্বেগ
যদিও বেশ কিছু গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া গেছে যে ট্যালকমের সাথে ক্যানসারের কিছুটা সম্পর্ক রয়েছে, তবে সেই সম্পর্কটা কি একদম সরাসরি কিনা সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি।
এছাড়া ট্যালকম এর আরেকটি ক্ষতিকারক দিকের কথা অনেকেই বলে থাকেন, সেটা হল এই ট্যালকম নারীদের প্রজনন নালীর মধ্যে চলে যেতে পারে এবং ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। উদাহরণ সরূপ বলা যেতে পারে, যে সকল নারীরা তাদের যৌনাঙ্গের আশেপাশে ট্যালকম পাউডার ব্যাবহার করতেন সেসব নারীদের ওভারিতে টিউমার হলে তার মধ্যেও ট্যালকম পাওয়া গেছে বলে সংবাদ এসেছে।
ন্যাশনাল ক্যানসার ইন্সটিটিউট এর এক জার্নালে একটা গবেষণার কথা উল্লেখ আছে যে যদিও যৌনাঙ্গের আশেপাশে ট্যালকম পাউডার ব্যাবহার এবং অভারির ক্যানসারের মধ্যে কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই, তবে অতিরিক্ত ট্যালকম পাউডার ব্যাবহার এবং অভারি ক্যানসারের মধ্যে পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া The world health international agency for research on cancer ট্যালকম পাউডার ব্যাবহারকে ক্যানসারের অন্যান্য আরো অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
যদিও বেবি পাউডার এবং ক্যানসারের মধ্যে আদতেই কোন সম্পর্ক আছে কি না সে ব্যাপারে একদম নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে বেবি পাউডার ব্যাবহারের ক্ষেত্রে বিরতি আনার জন্য এই পর্যন্ত করা গবেষণাগুলোই যথেষ্ট বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ট্যালকম পাউডার ঘামাচি সারায় না, বরং বিভিন্ন ক্ষতির কারণ হতে পারে
বেশীরভাগ ব্র্যান্ডের বেবি পাউডার ট্যাল্কই হয়, আর ট্যাল্ক বিভিন্ন খনিজ উপাদান এবং কিছু রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি খুব সূক্ষ্ম গুঁড়ো যা সাধারণত ঘর্ষণ প্রতিরোধে কিংবা কিছুকে মসৃণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। আদতে, ঘামাচি ভালো করার সাথে কিংবা গরম কমানোর সাথে এই উপাদানগুলোর কাজের কোন সম্পর্ক নেই।
অন্যান্য বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হলেও, আমাদের শরীরের জন্য ট্যাল্ক হতে পারে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ , কারণ বেশীরভাগ ট্যাল্কেই এমনকি বেবী পাউডারেও থাকতে পারে অ্যাসবেসটস (asbestos) নামক একটি উপাদান, যেটি হতে পারে ক্যান্সারের উল্লেখযোগ্য একটি কারণ।
আর সবচেয়ে বড় কথা , ঘামাচি প্রতিরোধের মূল শর্ত যেখানে শরীরের রোমকূপগুলোকে খোলা রাখা যেন ঘাম জমে না থেকে বেরিয়ে যায়, সেখানে পাউডার দিলে কয়েক মিনিটের জন্য ত্বকে আরাম অনুভূত হলেও, প্রকৃতপক্ষে এগুলো কিছুক্ষণ পর রোমকূপ-গুলোকে বন্ধ করে দেয়, যা ঘামাচি সারানোর পরিবর্তে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর ঘামাচি (Prickly heat) সারাতে ট্যালকম পাউডার কি আসলেই কাজ করে ? ]
ডায়পারের কারণে যে র্যাশ হয় সেটা কি বেবি পাউডার দিয়ে ঠিক হয়?
যদিও এটা সত্য যে বেবি পাউডার শিশুর ত্বক শুষ্ক ও আর্দ্রতা মুক্ত রাখে তবে তার মানে এই না যে বেবি পাউডার দিয়ে শিশুর র্যাশও ভালো হবে। শিশুর ডায়পার যদি সঠিক সময়ে পরিবর্তন না করা হয় এবং শিশুর ত্বকে যদি মুক্ত বাতাস না লাগে তাহলেই তার র্যাশ হয়।
ডিসপোজেবল ডায়পার ব্যবহারের কারণে শিশুর ত্বকে অস্বস্তি সৃষ্টি হতে পারে এবং ফলাফল সরূপ শিশুর এলার্জি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। শিশুর র্যাশ হলে বেবি পাউডার ব্যবহার না করে বরং ভিন্ন ধরনের ও ব্র্যান্ডের ডায়পার ব্যবহার করুন, কেননা বেবি পাউডার আদতে এই সমস্যার কোন সমাধান দেয় না।
[ আরও পড়ুনঃ শিশুর ডায়াপার র্যাশ । কারণ ও প্রতিকার ]
কীভাবে নিরাপদ উপায়ে ডায়পার র্যাশ প্রতিরোধ করা যেতে পারে?
ডায়পার সংলগ্ন শিশুর ত্বকের নিরাপত্তার জন্য কোন ধরনের বিকল্প খুঁজছেন কি? ডায়পার র্যাশ থেকে বেঁচে থাকার জন্য নিম্নে কিছু উপায় বর্ণনা করা হলঃ
- নিয়মিত ডায়পার পরিবর্তন করুন (বিশেষ করে যখন আপনি বুঝতে পারবেন যে এটি ময়লা হয়ে গেছে)
- ডায়পার পরিবর্তনের সময় শিশুর শরীরের নিম্নাংশে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও যাতে বাতাস লাগে সে সুযোগ করে দিন।
- আপনার শিশুর যদি একটু বেশিই র্যাশ হয়ে থাকে তাহলে তার সংবেদনশীল ত্বকে পেট্রোলিয়াম অথবা জিংক-অক্সাইড এর উপর ভিত্তি করে বানানো ক্রিম ব্যাবহার করতে পারেন।
- আপনি যদি ইতোমধ্যেই শিশুর জন্য যে কোন ধরনের বেবি পাউডার ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে দুশ্চিন্তা করবেন না। কেননা অনেক বেবি পাউডার আছে যেগুলোতে ট্যালকম ব্যবহার করা হয় না শুধুমাত্র এটুকু খেয়াল রাখবেন যাতে ভবিষ্যতে শিশুর জন্য বেবি পাউডার ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে পারেন।
নিরাপদ উপায়ে বেবি পাউডার কীভাবে ব্যাবহার করা যায়?
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে এমন কোন তথ্য নেই যে বেবি পাউডারের কারণে ক্যানসার হয়। বিভিন্ন গবেষণায় এ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফলাফল এসেছে। আপনি যদি নিজের অথবা শিশুর ক্ষেত্রে ট্যালকম পাউডার এর সংস্পর্শে চলে আসার ব্যাপারে চিন্তিত হন, তাহলে নিচের উপায় অবলম্বন করে আরো নিরাপদ উপায়ে বেবি পাউডার ব্যবহার করতে পারবেনঃ
- শিশুর যৌনাঙ্গে সরাসরি ট্যালকম পাউডার দেয়া থেকে বিরত থাকুন। এর পরিবর্তে শিশুর যৌনাঙ্গের আশেপাশে ত্বকে এবং পায়ে হালকা করে বেবি পাউডার দিতে পারেন।
- শিশুর চোখে যাতে বেবি পাউডার না চলে যায় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- শিশু এবং আপনার উভয়ের মুখ থেকে বেবি পাউডার দূরে রাখুন। এর মাধ্যমে নিঃশ্বাসের সাথে বেবি পাউডার চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে বিরত থাকা যায়।
- শিশুদের নাগালের বাইরে বেবি পাউডারটি রাখুন।
- বেবি পাউডারটি আপনার হাতের উপর ঝাঁকিয়ে বের করার সময় আপনার হাত, মুখ থেকে দূরে রাখুন।
- সরাসরি বেবি পাউডারের কৌটাটি শিশুর শরীরের উপর ঝাঁকাবেন না বরং একটি কাপড়ের উপর ঝাঁকিয়ে নিন এবং কাপড়টির মাধ্যমে শিশুর শরীরে বেবি পাউডার ব্যবহার করুন।
নিম্নে ট্যালকম বেবি পাউডারের কিছু বিকল্প দেয়া হলঃ
- কর্ণ স্টার্চ পাউডার
- এরারুট স্টার্চ অথবা টাপিওকা স্টার্চ পাউডার
- ওট ফ্লাওয়ার
- বেকিং সোডা
- শিশুদের জন্য পাউডারের বিকল্প হিসেবে জিংক এর উপর ভিত্তি করে বানানো ডায়পার র্যাশ ক্রিম।
সবার জন্য শুভকামনা।