বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো কিভাবে বন্ধ করবেন

Spread the love

বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা– এর মানে কি?

বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা বা বুকের দুধ ছাড়ানো বলতে বোঝায় যখন সে আর বুকের দুধ খেতে চাইবে না এবং স্তন ব্যাতীত অন্যান্য খাদ্য উৎস থেকে সে সঠিক মাত্রার পুষ্টি উপাদান পাবে। যদিও অনেক মা শিশুকে ফীডারে করে বুকের দুধ খাইয়ে থাকেন, কিন্তু এখানে শিশুর সরাসরি স্তনপানের কথাই বলা হচ্ছে।

তবে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করার মানে কিন্তু এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে এর মাধ্যমে আপনার এবং আপনার শিশুর মধ্যকার যে ঘনিষ্টতম সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তার ইতি ঘটবে। বিষয়টাকে এমনভাবেই নিতে পারেন যে, এর মাধ্যমে আপনি শিশুকে যত্নআত্তি ও লালনপালনের নতুন উপায় অবলম্বন করছেন।

বিজ্ঞাপণ

জন্মের পর প্রথম প্রায় ছয় মাস শিশুকে শুধুই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। এরপর ধীরে ধীরে তার অন্য খাবারের চাহিদা তৈরি হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর শিশু আস্তে আস্তে বাইরের খাবার থেকে সব ধরনের পুষ্টি পেতে শুরু করে।

এভাবে প্রায় দু’বছর পর্যন্ত শিশু মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারে অভ্যস্ত হতে থাকে। একপর্যায়ে শিশুর শরীরের চাহিদামত পুষ্টিগুন বাহিরের খাবার থেকেই যোগান দেয়া সম্ভব হয়। তখন আর মায়ের দুধের প্রয়োজন পড়ে না।।

উদাহরণস্বরূপ, আপনার শিশু কান্নাকাটি করলে তাকে বুঝ কিংবা শান্ত করার জন্যে যদি আপনি বুকের দুধ পান করানোটা অভ্যাস করে ফেলেন, তাহলে এই সময়ে এসে শিশুকে শান্ত করতে আপনি ভিন্ন কিছু করতে পারেন। যেমন- শিশুকে নিয়ে বই পড়া, একসাথে গান গাওয়া অথবা বাইরে খেলতে যাওয়া প্রভৃতি।

শিশু যদি প্রতিবাদ করে, শান্ত না হতে চায়, নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখুন, তার সাথে যথাসম্ভব ভালো এবং হাসিখুশি আচরণ করুন। মাঝে মাঝে শিশুকে তার বাবার কোলে দিন।

কখন বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করবো?

বাচ্চাকে কখন বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করবেন, সেটা নির্ধারণ যদি কেউ করে থাকে, সেটা আপনিই। এর কোন ডেডলাইন বা বাধ্যবাধকতা নেই যে এই বয়সের পর আর বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে না। তখনই বুকের দুধ ছাড়াবেন যখন আপনি এবং আপনার শিশু উভয়ই এর জন্যে প্রস্তুত।

দ্য আমেরিকান একাডেমি অফ পিডিয়াট্রিক্স অন্ততপক্ষে শিশুর ১ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে বলে। তবে মা এবং শিশু উভয়েই যদি চায়, তাহলে সেটা এর বেশী সময় ধরেও হতে পারে।

আপনার বন্ধু, আত্মীয়স্বজন এমনকি পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই অনেক কিছু বলবে, কিন্তু সত্যিটা হলো বুকের দুধ ছাড়ানোর কোন পারফেক্ট সময় নেই। আপনার যখন মনে হবে, তখনই বন্ধ করতে পারেন, অথবা শিশুর উপরেই ছেড়ে দিতে পারেন। সে যখন একটু বড় হয়ে যাবে, বুকের দুধ আর চাইবে না, বন্ধ করে দিন।

বাচ্চার ইচ্ছা অনুযায়ী বুকের দুধ ছাড়ানো

অনেক শিশুর ক্ষেত্রে বয়স ৪ মাস থেকে ৬ মাস হলে, সে যখন সলিড খাবার খাওয়া শুরু করে, তখন থেকেই সে ধীরে ধীরে বুকের দুধের প্রতি আগ্রহ হারানো শুরু করে। আর শিশু একদমই বুকের দুধ খেতে না চাইলে, তবেই তা বন্ধ করাটা সবচেয়ে সহজ এবং সঠিক।

কিছু শিশুর বয়স ১২ মাস হলে, সে যখন বিভিন্ন ধরণের শক্ত খাবার এবং কাপ থেকে পানি, দুধ ইত্যাদি তরল খাবার খাওয়া শুরু করে, তখন থেকেই সে আর বুকের দুধের প্রতি অতো একটা আগ্রহী থাকে না।

১ বছর বয়সী শিশুরা একটু দুরন্ত হলেই তারা এক যায়গায় অনেক্ষণ বসে থেকে যে খাবে, তাদের সে ধৈর্য্যটাও থাকে না। এছাড়া আপনার শিশু যদি একটু চঞ্চল এবং অধৈর্য্য হয়, সে এমনিতেও দুধপান করার সময় মনযোগ হারিয়ে ফেলবে এবং এর মাধ্যমে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে তাকে বুকের দুধ ছাড়ানোর সময় হয়েছে।

মায়ের ইচ্ছায় বুকের দুধ ছাড়ানো

হয়তো অফিস শুরু করতে হবে এই কারণে কিংবা এটাই প্রকৃত সময়, এমন মনে হলে, মা নিজেই যদি চান, তিনিও বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনি যদি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন কিন্তু মনে হচ্ছে যে আপনার শিশু এখনো স্তন থেকে দুধ পান করতে আগ্রহী, সেক্ষেত্রে হঠাৎ  বন্ধ না করে কাজটা ধীরে ধীরে করতে পারেন।

মা যখন চাইবেন, তখন অবশ্যই বন্ধ করার প্রক্রিয়াটি অনেক সময় ও ধৈর্য্য নিয়ে করতে হবে। এছাড়া শিশুর বয়স কত এবং সে পরিবর্তনটার সাথে কতটা মানিয়ে নিতে পারছে, সেটাও দেখার বিষয়।

ধারাবাহিক নিয়মের বাইরে গিয়ে হুট করে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা উচিত নয়। যেমন- এটা কোনভাবেই আদর্শ হবে না যে বুকের দুধ পান করানোর মাধ্যমে শিশু এবং আপনার মধ্যকার যে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক হয়েছে, তার ইতি ঘটাতে আপনি এক বন্ধের দিনে শিশুকে রেখে কোথাও ঘুরতে গেলেন।

এক্সপার্টরা বলে থাকেন, শিশু আগ্রহী থাকলে হঠাৎ করে স্তনপান করানো বন্ধ করে দিলে তা শিশুর উপর মানসিকভাবে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে, আবার এতে করে মায়ের স্তনে দুধের জমাট বেধে যাওয়া কিংবা ইনফেকশনও দেখা দিতে পারে।

কিভাবে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করবো?

ধীরে ধীরে এগোন এবং শিশুর বুকের দুধে অনীহা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। পরিবর্তনের সাথে শিশুকে মানিয়ে নিতে নিম্নোক্ত পন্থা অবলম্বন করতে পারেন।

একবার একবার করে এড়িয়ে যান: শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ে এর পরিবর্তে তাকে একবার বোতলে কিংবা মগে করে দুধ খেতে দিন এবং এতে শিশুর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করুন। দুধটা যে কোন দুধই হতে পারে। স্তন থেকে পাম্প করে বের করা দুধ, ফর্মূলা দুধ, কিংবা গরুর দুধ (শিশুর বয়স যদি কমপক্ষে ১ বছর হয়)।

বিজ্ঞাপণ

এমন করে এক সপ্তাহ পর পর একবার করে বুকের দুধ পান করানো কমিয়ে দিন। এতে করে শিশু পরিস্থিতির সাথে ঠিকঠাক মানিয়েও নিতে পারবে, আবার আপনার স্তনে দুধের উৎপাদন প্রক্রিয়ায়ও এতে ব্যাঘাত ঘটবে না। স্তনে দুধ জমে থাকা জনিত ব্যাথাও হবে না।

দুধপান করানোর সময় কমিয়ে দিন: বুকের দুধ পান করার সময়টা কমিয়ে দিন৷ যদি সে সাধারণত ১০ মিনিট ধরে পান করে, সেটা কমিয়ে ৫ মিনিটে নিয়ে আসুন।

শিশুর বয়সের উপর নির্ভর করে, তাকে স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে পারেন যেমন চিনি ছাড়া আপেল সস অথবা এক কাপ দুধ কিংবা ফর্মূলা দুধ। তবে ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের কিন্তু বুকের দুধ বা ফর্মুলা ব্যতীত কোন শক্ত খাবার খাওয়ানো যাবে না।

রাতে দুধপান করানোর ক্ষেত্রে সময় কমানোটা কিছুটা কঠিনই হয়ে যেতে পারে কারণ শিশু দিনের শেষ খাবারটা রাতেই খায়।

অপেক্ষায় রাখুন এবং মনযোগ সরিয়ে দিন: শিশু যদি দিনে কয়েকবার বুকের দুধ পান করতে অভ্যস্ত থাকে, সেক্ষেত্রে দু একবার খাওয়ানো স্থগিত রেখে দেখা যেতে পারে।

শিশু একটু বড় হলে, এই প্রক্রিয়াটি তার সাথে বেশ ভালো কাজ করবে৷ এই প্রক্রিয়ায়, শিশু যখন দুধ পান করতে চাইবে তাকে বোঝান যে তাকে দেওয়া হবে কিন্তু সে যাতে একটু অপেক্ষা করে এবং এ সময়ে তাকে অন্য কোন কাজে ব্যস্ত করে তার মনযোগ সরিয়ে দিন। শিশু যদি সন্ধ্যায়ই দুধ পান করতে চায়, তাকে বোঝান তাকে রাতে ঘুমানোর সময়েই দেওয়া হবে।

শিশুকে বোতলে খাওয়ানোতে অভ্যস্ত করতে, তার ঠোঁটে কিংবা জিহবায় প্রথমে কয়েক ফোটা বুকের দুধ দিন, এর পর ফিডারের নিপলটা মুখে তুলে দিন।

আরেকটি কাজ করতে পারেন, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কয়েক ঘন্টা পর তাকে বোতলে করে বুকের দুধই পান করাতে পারেন। শিশু বেশী ক্ষুধায় অস্থির হওয়ার আগেই তাকে বোতলের দুধ খাওয়ানো উচিত।

অনেক বাচ্চা বুকের দুধ ছাড়ানোর সময় প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে, জেদি হয়ে যায় এবং যে কোনও জায়গাতেই দুধ খাওয়ার জন্য বায়না করতে পারে। তাকে আদর করে ভোলাবার চেষ্টা করুন। ধমকে বা বকে কোনও কাজ হয় না, বরং হিতে বিপরীত হয়।

অনেক বাচ্চা মনে করে যে, মা তার থেকে হয়তো দূরে চলে যাচ্ছে বা তাকে আগের মতো ভালোবাসছে না। এই ধারণা থেকে সে আরও বেশি জেদি হয়ে যায় এবং দুধ খাওয়ার জন্য বায়না বেশি করে। বাচ্চাকে এই সময় বেশি আদর করুন, সঙ্গ দিন এবং তাকে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন।

বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করলে সে কি সঠিক পুষ্টি পাবে?

শিশুকে যদি কেবল বুকের দুধই পান করিয়ে থাকেন, তাও কিন্তু শিশুর মধ্যে ভিটামিন-ডি এর মতো কিছু পুষ্টি উপাদানের চাহিদা রয়ে যায় যা বুকের দুধ পূরণ করতে পারে না।

শিশুর ১ বছর হওয়ার আগেই যদি তাকে স্তন থেকে দুধ পান করানোর অভ্যাসটি পালটে ফেলেন, এর পরও ১ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুকে কিন্তু বোতলে করে পাম্প করা বুকের দুধ অথবা আয়রন ফোর্টিফাইড ফর্মূলা দুধ খাওয়াতে হবে।

শিশুর বয়স ১ বছরের বেশী হয়ে গেলে, তার সঠিক ভাবে বেড়ে উঠা নিশ্চিত করতে এবং বিভিন্ন প্রকারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে অনেক ধরণের খাবারই খাওয়াতে হবে।

শিশুকে বুকের দুধ ছাড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়লে কি করা উচিত?

বিজ্ঞাপণ

বুকের দুধ পান করানোর অভ্যাসটা পরিবর্তন করতে আপনি সম্ভব সবকিছু করার পরও যদি দেখেন যে শিশুর সাথে কাজ করছে না এবং শিশু তাও বুকের দুধ পানেই আগ্রহী, সেক্ষেত্রে এটাই ভেবে নিন যে এখনো অভ্যাস পরিবর্তন করার সঠিক সময় আসে নি৷

আপনাকে আবার অফিসে জয়েন করতে হয়েছে? এই রুটিনের সাথে মানিয়ে নিতে শিশুর কিছু সময় তো লাগবেই।

আপনার শিশু কি অসুস্থ? শিশু যখন অসুস্থ থাকে তখন সে বেশী বেশী বুকের দুধ পান করতে চায়। বুকের দুধ পান অসুস্থ শিশুদের কেবল আরামই দেয় না, তার পুষ্টির চাহিদাও ঠিকঠাক পূরণ করে দেয়।

আপনার বাসায় কিংবা আপনার জীবনে কি বড় কোন পরিবর্তন হয়েছে? কোন নতুন পরিবেশে যাওয়া, ডিভোর্স প্রভৃতি ঘটনা ঘটলেও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বুকের দুধ পান করানো বন্ধ করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি শিশু ডেভেলপমেন্টাল স্টেজের এক ধাপ থেকে নতুন ধাপে উঠলেও অনেক ক্ষেত্রে এই অভ্যাস পরিবর্তনটা কঠিন হয়ে পড়ে।

অভ্যাস পরিবর্তন করা যদি কঠিনই হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে থাকুক না! পরের মাস থেকে আবার চেষ্টা করুন। আগে হোক পরে হোক, শিশু একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, এই অভ্যাসটি আপনা আপনিই চলে যাবে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment