গবেষণায় উঠে এসেছে, সন্তানের বয়স যখন মাত্র ৬ মাস, তখন থেকেই তার ওপরে বাবা-মায়ের ঝগড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করে। শুধু তাই নয়, যে সন্তানের বয়স ১৯ বছর, তার ওপরেও বাবা-মায়ের ঝগড়া উল্লেখযোগ্যভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
অনেকেরই ধারণা সন্তানের গায়ে হাত না তোলাটাই যথেষ্ট। কিন্তু এটা ভুল। কখনো কখনো মা বাবার মধ্যকার ঝগড়াও সন্তানের উপর বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যেসব বাচ্চারা নিয়মিত এসব ঘটনার সম্মুখীন হয় তারা একদিকে যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তেমনি এধরনের পরিস্থিতি বাবা মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। স্বভাবতই বাবা মা যখন রেগে থাকবে তারা হয়তো বাচ্চার সাথে খুব সুন্দর সময় কাটাতে পারবেনা। এতে তার স্ট্রেস লেভেল বেড়ে যেতে পারে এবং তা তার সার্বিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
মা বাবার ঝগড়া কখন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়
সবচেয়ে সুখী দম্পতির মাঝেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়, মতের অমিল হয়। সব বিষয়ে দু’জন মানুষ একমত হবে, এটা সম্ভব নয়। কিন্তু সমস্যা হয় যখন সন্তাদের সামনেই সেই দু’জন মানুষ অর্থাৎ, বাবা ও মা ঝগড়া করতে শুরু করে। সন্তানের কাছে বাবা-মা সবচেয়ে আপন ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তারা যখন তর্কে জড়িয়ে যায়, তীব্র কথা কাটাকাটি করে তখন তা অবধারিতভাবে সন্তানকে মানসিকভাবে আঘাত করে।
ঝগড়ার সময় বাবা মায়ের যেসব আচরণ সন্তানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে সেগুলো হলো –
- রাগের মাথায় দাম্পত্য সঙ্গীকে বিভিন্ন বাজে নাম ধরে ডাকা।
- অপমান করা।
- ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদের হুমকি দেওয়া।
- যেকোনো ধরনের শারীরিক হিংস্রতা (দাম্পত্য সঙ্গীর শরীরে আগাত করা, কোনো কিছু ছুঁড়ে ফেলা, আছাড়া দেওয়া)।
- শীতলতা বজায় রাখা।
ঝগড়া করে অভিভাবকরা হয়তো সঙ্গীর সাথে ৩ দিন ধরে কথা বলা বন্ধ রেখেছেন। ভাবছেন, যেহেতু চুপচাপ আছি, এতে সন্তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আপনার ধারণা ভুল। সন্তানের ক্ষতি হচ্ছে। তারা শিখছে, কোনো সমস্যা হলে সেটা নিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনা না করে বরং কথা বলা বন্ধ করে দিতে হয়। তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে সমস্যার সমাধান করার কৌশল সম্পর্কে জানতে পারছে না।
বাবা-মায়ের মাথায় রাখতে হবে, তারা সন্তানের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাবা-মা যা করেন, সন্তানও সেটা করার জন্য উৎসাহ পায়। বাবা কিংবা মা যখন তার সঙ্গীকে অপমান করে, অসম্মান করে কথা বলে, তখন সন্তানের কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক বলে মনে হয়। ফলে সে নিজেও অন্য ব্যক্তিদের সাথে অসম্মান করে কথা বলতে শুরু করে।
বাবা-মায়ের ঝগড়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে
বুদ্ধিবৃত্তি কমে যাওয়া
গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মা ঘনঘন ঝগড়ায় লিপ্ত হলে সন্তানের মনোযোগ নষ্ট হয় এবং তারা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। গবেষণায় আরও দেখা গেছে এসব বাচ্চাদের কোন সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা এবং কোনো প্যাটার্ন দেখে দ্রুত সেটা চিহ্নিত করার ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে।
যেসব পরিবারে বেশি মাত্রায় ঝগড়া-বিবাদ বিরাজ করে, সেসব পরিবারের সন্তানেরা বাজে গ্রেড পয়েন্ট পায়। কেউ কেউ মাঝপথে পড়াশোনাও ছেড়ে দেয়।
সম্পর্ক স্থাপনে সমস্যা
সন্তান যদি বাসায় অস্থির, প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাহলে ভবিষ্যতে নিজের সম্পর্ক স্থায়ী করার ব্যাপারে তার অনেক সমস্যা ভোগ করতে হয়। সেটা প্রেমের সম্পর্ক হোক, বন্ধুত্ব হোক বা কর্মক্ষেত্রে; সবজায়গায় তারা হোঁচট খায়।
ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের ঝগড়া-বিবাদ দেখতে দেখতে বড় হওয়া সন্তান, তার আশেপাশের মানুষগুলোর সাথেও বাজে আচরণ করার সম্ভাবনা থাকে। শুরুতে তারা নিজের ভাই বা বোনের সাথে বিবাদে জড়ায়। বাবা-মা যেভাবে ঝগড়া করে, তারাও বাবা-মায়ের অনুকরণ করে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়।
এধরনের সন্তানেরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও নিজের জন্য বিশ্বস্ত কাউকে বেছে নিতে পারে না। বাবা-মায়ের ঝগড়া তাদেরকে বিবাহিত জীবন কিংবা কারো সাথে প্রেমে সম্পর্কে জড়াতেও অনুৎসাহিত করতে পারে। তারা আশংকা করে সম্পর্কে জড়ালেই হয়তো আঘাত পেতে হবে।
উগ্র স্বভাব
সন্তান যদি বাবা-মাকে ঝগড়া করতে দেখে সন্তান ভাবে, কোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য ঝগড়া করা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে অন্য কারো সাথে সমস্যা হলে সন্তানেরা ঝগড়া করে সমাধানে পৌঁছুনোর চেষ্টা করে।
এধরনের ভাবনা ও আচরণের কারণে সেই সন্তানদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ছোট বয়সে তারা স্কুলে মানিয়ে নিতে হিমশিম খায়। বড় হওয়ার পর তারা কারো সাথে সফলভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না।
মাদকগ্রহণ
যে বাড়িতে অশান্তি বিরাজ করে, সেই বাড়ির সন্তানের মাদক গ্রহণ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বাবা-মায়ের ঝগড়া থেকে সৃষ্ট মানসিক অবসাদ ভুলে থাকতে তারা মাদকের আশ্রয় নিতে পারে। তারা অ্যালকোহল, তামাক, মারিজুয়ানা সহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে যেতে পারে।
আত্মবিশ্বাস হারানো
বাবা-মায়ের ঝগড়ার সময় সন্তান অসহায়বোধ করে থাকে। সন্তান লজ্জা পায়, নিজেকে তার অযোগ্য বলে মনে হয়। এভাবে সে মানসিকভাবে তীব্র চাপে পিষ্ট হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আত্মবিশ্বাসের ঘাঁটতি থাকার কারণে পরবর্তী জীবনে তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম ও শারীরিক ক্ষতি
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানের খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের পেছনে অভিভাবকদের ঝগড়া বেশ বড় ভূমিকা রাখে। এছাড়া তাদের ঝগড়ার কারণে সন্তানের শারীরিক ক্ষতিও হতে পারে। যেমন : ঘুমের সমস্যা, পেট ব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি।
সর্বোপরি এ ধরণের পরিস্থিতিতে বড় হওয়া সন্তানেরা পুরো জীবনটার উপরই এক ধরণের নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে।
কিভাবে এর সমাধান করা যায়
দাম্পত্য জীবনে বাবা-মায়ের মাঝে সন্তানের এক-আধটু ঝগড়া হতেই পারে। উত্তেজিত অবস্থায় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে তাদের সন্তান সেই ঝগড়ার কী শুনছে, কী দেখছে। সেই ঝগড়া থেকে যেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, মানসিকভাবে আঘাত না পায় সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ঝগড়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, সন্তানকে একদম জটিল খুঁটিনাটি জানানোর দরকার নেই। তবে মূল বিষয়টি জানানো উচিত। তাদের কাছে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে নিজেদের ভুল স্বীকার করা উচিত। যেমন : “সেদিন আমরা বিষয়টা নিয়ে ঝগড়া করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলাম। কাজটা একদমই ঠিক হয়নি। আমরা ভুল করেছি।”
সন্তানকে আশ্বস্ত করা উচিত। সন্তানকে জানানো উচিত বাবা-মায়ের ঝগড়াটা নিতান্তই সাধারণ ঘটনা ছিল। সিরিয়াস কিছু নয়। সন্তানকে নিশ্চিত করা উচিত, বাবা-মা এখনো পরস্পরকে ভালবাসেন।
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। সন্তানকে বোঝানো উচিত, পারিবারিক বন্ধন যথেষ্ট মজবুত। মাঝে মাঝে ঝগড়া বা তর্ক হতে পারে, বাবা-মা একটু মেজাজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন কিন্তু তাতে তাদের মাঝে ভালবাসা কমে যায়নি। পারিবারিক বন্ধন ঠিকই অটুট রয়েছে।
[আরও পড়ুন- সন্তানের সামনে বাবা মায়ের ঝগড়া সামাল দেয়ার ৫ টি টিপস]
তবে বাবা-মায়ের মাঝে ঝগড়া মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে, সেক্ষেত্রে সন্তানের মঙ্গলের জন্য বাবা-মায়ের উচিত থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হওয়া এবং নিজেদের মানসিক চিকিৎসা করানো। এখানে একটা বিষয় স্পষ্টভাবে জানা উচিত, মানসিক চিকিৎসা নেওয়া মানেই “পাগল হওয়া” নয়।
আমাদের সমাজে মানসিক চিকিৎসা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে। শরীরের ছোটখাটো অসুখ বা রোগের জন্য যেমন চিকিৎসা নেওয়া হয়, তেমনি মানসিক অসুখের জন্য চিকিৎসা নেওয়া যায়। মানসিক চিকিৎসাকে বাঁকা চোখে দেখার কিছু নেই। মানসিক চিকিৎসা নেওয়ায় লজ্জার কিছু নেই।
সবার জন্য শুভকামনা।