ফর্মুলা কিংবা দুধের বিকল্প হিসেবে ‘পেডিয়াশিওর’ দিচ্ছেন?- একটু জেনে নিন।

Spread the love

আজকাল অনেক বাবা-মাই বিজ্ঞাপন দেখে কিংবা অনেক সময় ডাক্তারের পরামর্শেও পেডিয়াশিওর নামক সাপ্লিমেন্টটি বাচ্চাকে দিয়ে থাকেন। বেশীরভাগ মানুষই এই সাপ্লিমেন্টটিকে দুধ কিংবা বাচ্চাদের ফর্মুলার বিকল্প ধরে নেন- বিষয়টি নিয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য গ্রহণ করে লেখাটি পাঠিয়েছেন ফারাহ হক।      

‘প্রথমেই বলে নিই, এই পোস্টটি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় হবে কিন্তু আপনার শিশুকে পেডিয়াশিওর খাওয়াবেন কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই পোস্টের তথ্যগুলো আপনার জানা জরুরি।  

বিজ্ঞাপণ

এখন সরাসরি কথায় আসা যাক, পেডিয়াশিওর আসলে কি? পেডিয়াশিওর হলো এক ধরণের নিউট্রিশন্যাল সাপ্লিমেন্ট বা ১ বছর বয়স্ক শিশুদের খাওয়ার উপযোগী হেলথ-শেইক যেখানে ৭ গ্রাম প্রোটিনের সাথে ৩৭ টি পুষ্টি উপাদান মিশ্রিত থাকে।

শিশুর শরীরের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে এবং একটি আদর্শ সাপ্লিমেন্ট হিসেবে গড়ে উঠার জন্যে এতে যেমন মিনারেল, ফেইট, প্রোটিনের মতো পুষ্টি উপাদান আছে, আবার এতে জিংক, প্রোবায়োটিকস, কপার ও ভিটামিন-এ এর মতো উপাদানও আছে।

প্রত্যেকটা মায়েরই স্বপ্ন থাকে এমন একটা খাবার যা শিশুর সকল পুষ্টি উপাদানের চাহিদাই পূরণ করবে।  খেতে না চাওয়া বাচ্চাদের জন্যে হলে তো কথাই নেই। আচ্ছা আপাতত কথা এখানেই থাকুক, আমরা পরে আবার এ কথায় ফিরে আসবো।

এখন নজর দেওয়া যাক মায়েদের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ কিংবা কমিউনিটি গ্রুপে হওয়া একটি নিয়মিত চিত্রে। সেখানে প্রায়ই এক ধরণের প্রশ্ন করা হয় যে, “আমি আমার শিশুকে একটু বেশীই দুধ দিতে চাচ্ছি। ফর্মূলা দুধ হিসেবে পেডিয়াশিওর কেমন হবে?” অথবা “আমার শিশুকে প্রতিদিন কতটুকু করে পেডিয়াশিওর ফর্মূলা খাওয়ানো যাবে?”।

শব্দগুলোর দিকে খেয়াল করুন, – দুধ এবং ফর্মুলা। পেডিয়াশিওর এর কোনোটাই নয়। হতে পারে, ফর্মুলা দুধের যায়গাটা নেওয়ার জন্যে এটা পেডিয়াশিওর প্রস্তুতকারকদের এক ধরণের মার্কেটিং ট্যাকটিকস। একে ফর্মূলা দুধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একে ফর্মূলা দুধের মতো করে একই ছবি, স্টিকার দিয়ে টিনের কৌটায় মোড়কজাত করা হয়।

একে অনেক জায়গায়ই ট্রাঞ্জিশন মিল্ক বা ফর্মূলা ডাকা হলেও এতে ফর্মুলা দুধের মত সকল পুষ্টি উপাদান নেই। পেডিয়াশিওরের সব পুষ্টি উপাদানগুলো না লিখে কয়েকটার উপাদানের নাম উল্লেখ করছি যেগুলো পেডিয়াশিওরে থাকে, যেমন-  সয়া দুধ পাউডার, কর্ন সিরাপ, ভেজিটেবল অয়েল, প্রোটিন কনসেন্ট্রেট, কৃত্রিম স্বাদ, লবণ ও চিনি প্রভৃতি।

৩০% পেডিয়াশিওর মিশ্রণে চিনি ব্যাবহার করা হয়, অর্থাৎ ২৫০ মিলির বোতলে প্রায় কমবেশী ৫ চা চামচের মতো চিনি থাকে। খারাপ স্বাদের কিছু ভিটামিন ও প্রোটিন কনসেনট্রেটস যাতে এই পানীয়ের স্বাদকে প্রভাবিত করতে না পারে, তাই  স্বাদকে চাপা দিতে চিনি মিশ্রণের যুক্তি দেয় এদের ওয়েবসাইট।

আবার নতুন মিশ্রণে দুধের বদলে তারা ৪০% সয়া প্রোটিন ব্যাবহার করে। Jennifer L. Pomeranz, JD, MPH এর মতে, এই পানীয়গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম প্রোটিন এবং দুধ অপেক্ষা বেশী সোডিয়াম থাকে।

পুষ্টিগত দিক থেকে এই পানীয় কোনদিক থেকে সেরা, এমন কোন প্রমাণও নেই, এমনকি এটা আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন দ্বারা ঠিকঠাক পরীক্ষাও করা হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (WHO) এই বিষয়ে একমত হয়েছে যে এই পানীয় শিশুদের জন্যে অনুপুযুক্ত। 

এতসব জটিল হিসাব নিকাশ বাদ দিয়ে পেডিয়াশিওরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক:

 ১. শিশুর খাওয়ার অভ্যাসে প্রভাব ফেলে।

আপনি হয়তো আপনার খেতে না চাওয়া শিশুর খাওয়ার সমাধান হিসেবে পেডিয়াশিওরকে ভাবছিলেন, কিন্তু এই সমস্যা কমানো দূরে থাক, বরং বাড়িয়েই দিতে পারে পেডিয়াশিওর। এটি আপনার শিশুর খাবারের প্যাটার্নে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

খেতে না চাওয়ার স্বভাবটা ১ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে বেশ নিয়মিতই দেখা যায়। মা-বাবা, অভিভাবকদের একটা অভ্যাস রয়েছে যে তারা শিশুর চাহিদা কতটুকু বা সে কতটুকু খাবে তা নিজের মতো করে নির্ধারণ করেন। কিন্তু শিশুদেরও খাওয়ার রুচি বা স্বাদ বলতে একটা ব্যাপার আছে যেটা অনেক মা-বাবাই পাত্তা দেন না আর এই কারণেই খাওয়া নিয়ে মা-বাবার যুদ্ধ যেন নিত্যদিনের ঘটনা।

খাবারে অতিরিক্ত চিনির ব্যবহারের কারণে শিশু সেটাকেই নিজের স্বাভাবিক কার্যকলাপের জ্বালানী হিসেবে নিয়ে নেয় এবং শিশুর স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার রুচিতে প্রভাব ফেলে। তারা চিনি জাতীয় খাবারই বেশী পছন্দ করা শুরু করে এবং স্বাস্থ্যকর খাবারে অনিহা প্রকাশ করে এবং এটাই অভ্যাস হয়ে যায়।

২. ক্ষতিকর উপাদান

পেডিয়াশিওরে কৃত্রিম স্বাদ ব্যবহার করা হয়। যদিও এটা সরাসরি শিশুর উপর কোন খারাপ প্রভাব ফেলে না, কিন্তু কৃত্রিম অপেক্ষা শিশুকে প্রাকৃতিক খাবার এবং স্বাভাবিক স্বাদের মাঝেই রাখা উচিত। এছাড়াও এতে জেনেটিক্যালি মডিফাইড অয়েল (GMO) রয়েছে যা মূলত প্যাকেটজাত স্যুপ কিংবা কোমল পানীয়ের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়।

বিজ্ঞাপণ

আপনি নিশ্চয়ই আপনার শিশুকে তৈলজাত ফ্যাট থেকে দূরে রাখতে চাইবেন কারণ এই ফ্যাট আপনার শিশুর হৃদযন্ত্রের জন্যে সবসময়ই ক্ষতিকর। এছাড়া পেডিয়াশিওরে যে প্রোটিনটি ব্যাবহার করা হয়, তা প্রক্রিয়াজাত।

যে কোন উপাদানই প্রক্রিয়ার আগে যেমন পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে, প্রক্রিয়ার পর তা কমে যায়। আর চিনির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা তো হলোই। আবারো মনে করিয়ে দিই, এই পানীয়তে হাস্যকর মাত্রার অতিরিক্ত চিনি রয়েছে।

৩. দুধে এলার্জি

পেডিয়াশিওরে মিশ্রিত দুধ কিছু কিছু শিশুর হজম হতে সমস্যা হতে পারে। আবার দুধে এলার্জি আছে এমন শিশুদের জন্যেও এই পানীয় নয়। এলার্জি আছে এমন শিশুরা এটা গ্রহণ করলে বমি বমি ভাব, দাদ, ফুসকুড়ি, পেটে ব্যাথার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

 ৪. ভিটামিন ও মিনারেল আসলেই কাজ করে তো!

প্রথমেই কিন্তু একটা কথা বলা হয়েছিল যে, পেডিয়াশিওরকে আদতে দেখতে সেই আদর্শ পানীয় মনে হয়, যেখানে ২৫ টি বিভিন্ন মিনারেল এবং ভিটামিন রয়েছে যা শিশুর সকল ধরণের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সক্ষম। তবে এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতেই হবে যে, একেকটা ভিটামিন শরীরে যেয়ে ঠিকঠাক কাজ করার জন্যে সেগুলো গ্রহণের পদ্ধতিও রয়েছে বিভিন্ন রকম।

এই প্রোটিন শেকগুলোর প্রস্তুতকারকেরা কিন্তু এটা কখনোই নিশ্চয়তা দেয় না যে শিশু সবগুলো পুষ্টি উপাদান থেকেই উপকৃত হচ্ছে। যদি তা না হয়, তাহলে অধিকাংশ পুষ্টি উপাদানই গ্রহণের বদলে বেরিয়ে যায়। আবার শিশুর শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের ওভারডোজের কারণে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।

 ৫. ক্যান্সারের ঝুঁকি

মিল্ক প্রোটিনের বিকল্প হিসেবে পেডিয়াশিওর সোডিয়াম ক্যাসিনেট ব্যাবহার করে থাকে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ক্যাসিনের ওভারডোজের কারণে ক্যান্সার সেলের বৃদ্ধি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং এখনও গবেষণা চলছে, তবু এটা জানার পর কয়জনই বা ঝুঁকি নিতে চাইবে?

এখন কিছু কিছু মায়েরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতে পারেন কারণ তাদের ডাক্তারেরা প্রেসক্রিপশনে পেডিয়াশিওর লিখে দিয়েছিলেন বলেই তিনি শিশুকে তা খাওয়াচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ডাক্তার কেন সেটা লিখেছেন?

কিছু কিছু শিশুদের এমন মেডিকেল কন্ডিশন থাকে যারা কোন নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে পেডিয়াশিওর খাওয়ানো হয় আবার ওজন বেশী বাড়ছে না, – এমন শিশুদেরও এই পানীয় খাওয়ানো যায়। পেডিয়াশিওরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী তারা বলে থাকে, নিম্নোক্ত মেডিকেল কন্ডিশনে থাকা শিশুদের জন্যেই এই পানীয় উপযোগী :

  •   বয়সের গ্রুপ অনুযায়ী যাদের শারিরীক বৃদ্ধির হার কম
  •   কোন অসুস্থতার কারণে শিশুর শরীরে ক্যালোরি ও পুষ্টির চাহিদা বেড়ে গেলে
  • অপুষ্টিতে ভুগছে এমন কিংবা অসুস্থতা কিংবা অরুচির কারণে শরীরে বেশী খাদ্য জমা রাখতে পারে না এমন শিশু

আপনার শিশুর ওজন কম হলে আপনার ডাক্তারের সাথে কিংবা কোন পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলুন যিনি শিশুকে পরীক্ষা করে ওজন কম হওয়ার মূল কারণটা আপনাকে জানাবেন এবং সেটা নিয়ে কাজ করবেন। শিশুকে অতিরিক্ত চিনি খাইয়ে কৃত্রিমভাবে শিশুর ওজন বাড়ানো থেকে সেই কাজটা করাই কি ভালো না?

পরিশেষে মায়েদের গ্রুপগুলোতে যারা ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের পেডিয়াশিওর খাওয়ানো নিয়ে প্রশ্ন করেন, তার উদ্দেশ্যে – এই পানীয় ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্যে নয়। আমেরিকান একাডেমি অফ পিডিয়াট্রিকসের মতে, ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের কেবল মায়ের বুকের দুধ এবং আইরন-ফর্টিফাইড ফর্মুলা দুধই খেতে দেওয়া উচিত।

এরপরও যদি আপনি শিশুকে পেডিয়াশিওর খাওয়াতে চান, তাহলে নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলো নোট করে নিন:

  • এটা একটা সাপ্লিমেন্টারি পানীয় যা খাবারের মাঝখানে বা বিরতিতে খাওয়াতে পারেন কিন্তু কোনভাবেই এটা কোন খাবারের বিকল্প হিসেবে খাওয়ানো যাবে না।
  • ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের এই পানীয় খাওয়ানো যাবে না। ১ থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের ২ গ্লাস/বোতল করে এই হেলথ শেক খাওয়ানো যায়।
  • এর সাথে কোনভাবে দুধ মেশাবেন না কারণ এতে করে এই পানীয়ের ফর্মুলেশন পাল্টে যেতে পারে। একে পানির সাথে মিশিয়েই খাওয়ানো উচিত। আবার একে শক্ত খাবার যেমন সিরিয়ালের সাথে মিশিয়ে কিংবা একে রান্না করেও খাওয়ানো যাবে না।‘

মুলঃ © Farah Huq.  Sydney. Australia. 

অনুবাদঃ ফেইরিল্যান্ড প্যারেন্টস

অনুমতি ব্যাতিত লেখার কোনো অংশ কপি করা নিষেধ।

এই বিষয়ে আরো তথ্যের জন্যে নিম্নোক্ত লিংকে ঢু মারতে পারেন


Spread the love

Related posts

Leave a Comment