রোগ নির্ণয়
এমন অনেক নারী আছেন, যারা জানেনই না যে তাদের জরায়ুতে টিউমার রয়েছে। আপনার ফাইব্রয়েড হয়েছে বলে ডাক্তার যদি সন্দেহ করে থাকেন, তাহলে সুস্পষ্ট প্রমাণের জন্য তিনি আপনার শ্রোণীদেশ পরীক্ষা (Pelvic Examination) করে দেখতে পারেন।
ফাইব্রয়েড নিশ্চিত করার জন্য অথবা আরো যেসব কারণে একই রকম উপসর্গ হতে পারে, সেগুলোকে বাতিল করার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হতে পারে,। এই পরীক্ষাগুলোর জন্য ডাক্তার আপনাকে কোন হাসপাতাল বা প্যাথোলজি সেন্টারে পাঠাতে পারেন।
যেহেতু ফাইব্রয়েড আক্রান্ত হলে সাধারণত কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয় না, তাই কখনো কখনো গাইনোকোলোজিক্যাল রুটিন চেক আপের সময় বা পরীক্ষার সময় ফাইব্রয়েড ধরা পড়ে। তাছাড়াও আলট্রা সাউন্ড (Ultra sound) এর মাধ্যমে জরায়ুর টিউমার নিশ্চিত হওয়া যায় ।
আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা
ফাইব্রয়েড নির্ণয়ের জন্য পরিচালিত অন্যতম পরীক্ষা হলো আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা। এটি একটি ব্যথামুক্ত পরীক্ষা, যেখানে একটি প্রোব বা নল দ্বারা উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ উৎপন্ন করা হয়, যার দ্বারা শরীরের অভ্যন্তরীন বিভিন্ন ছবি ফুটে ওঠে।
ফাইব্রয়েড নির্ণয়ের জন্য ২ ধরণের আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা চালু আছে, সেগুলো হলোঃ
- পেটের আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানঃ এ পরীক্ষা আল্ট্রাসাউন্ডে ব্যবহৃত প্রোব আপনার পেটের উপর নাড়ানো হয়।
- ট্রান্সভ্যাজিনাল আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানঃ এ পরীক্ষায় আল্ট্রাসাউন্ডে ব্যবহৃত প্রোব আপনার যোনিতে প্রবেশ করানো হয়।
এসব পরীক্ষায় প্রাপ্ত ছবি একটি মনিটরে দেখা যায়, যা দেখে ডাক্তার বুঝতে পারেন ফাইব্রয়েড আছে কিনা। যদি আল্ট্রাসাউন্ডে ফাইব্রয়েড ধরা পড়ে, তাহলে নিম্নোক্ত পরীক্ষা করানোর জন্য আপনাকে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের (গাইনোকোলোজিস্ট) কাছে পাঠানো হবে।
হিস্টেরোস্কোপি (hysteroscopy)
হিস্টেরোস্কোপি পরীক্ষাতে একটি ছোট টেলিস্কোপ যোনিতে প্রবেশ করানো হয় যাতে ডাক্তার জরায়ুর অভ্যন্তরীণ অংশ দেখতে পারেন। এই পরীক্ষাটি অ্যানেস্থেশিয়া বা অনুভূতিনাশক প্রয়োগ করে করা হয়, তাই পরীক্ষা চলাকালে আপনি কোনো ব্যথা অনুভব করবেন না। জরায়ুতে ফাইব্রয়েড (সাবমিউকোসাল ফাইব্রয়েড) শনাক্ত করার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষা হলো হিস্টেরোস্কোপি।
ল্যাপোরোস্কোপি (laparoscope)
ল্যাপোরোস্কোপ হলো একটি ছোট টিউব বা নল যাতে একটি একটি লাইট ও ক্যামেরা সংযুক্ত থাকে। ক্যামেরার মাধ্যমে তলপেট অথবা শ্রোণীচক্রের আভ্যন্তরীণ ছবি একটি টেলিভিশনে পর্দায় ফুটে উঠে।ল্যাপোরোস্কোপি করার জন্য ডাক্তার তলপেটে একটি ছোট ছিদ্র করেন এবং ঐ ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ল্যাপোরোস্কোপ প্রবেশ করান, যার ফলে তলপেট অথবা শ্রোণীচক্রের অঙ্গসমূহ এবং টিস্যু সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়। অনুভূতিনাশক ব্যবহার করার কারণে এই পরীক্ষা চলাকালে আপনি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকবেন।
বায়োপসি
অণুবীক্ষণ যন্ত্রে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করার জন্য হিস্টেরোস্কোপি ও ল্যাপোরোস্কোপি পরীক্ষা পরিচালনা করার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র পরিমাণ টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করা হতে পারে, এই টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া বায়োপসি নামে পরিচিত।
ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর টিউমারের চিকিৎসা
যদি জরায়ুর টিউমার এর কোন উপসর্গ না থাকে বা ছোটখাট উপসর্গ থাকে যা দৈনন্দিন কাজকর্মে কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না, তবে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। মেনোপজ (রজঃবন্ধ) হবার পর ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর টিউমার সংকুচিত হয়ে আসে এবং উপসর্গ গুলো ধীরে ধীরে কমে আসে বা সম্পুর্ণ চলে যায়। যদি আপনার এমন ফাইব্রয়েড থাকে যার চিকিৎসার প্রয়োজন, ডাক্তার তখন আপনাকে কিছু ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন যা আপনাকে এই উপসর্গগুলো থেকে মুক্ত করবে। এরপরও যদি সমস্যা থেকে যায়, তাহলে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর প্রয়োজন হবে।
কোন বয়সে বা কি অবস্থায় আছেন রোগী তার ওপরেই চিকিৎসার বিষয়টি নির্ভর করে। কারণ, চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে—
কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট : এই ধারায় কোনোরকম চিকিৎসা না করে ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া হয় এবং মেনোপজ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়।
মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখিয়ে তাদের পরামর্শ মেনে ওষুধ ও ইঞ্জেকশন ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনে হরমোন থেরাপি দিয়ে ‘ফাইব্রয়েড’ শুকিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে যারা মা হতে চান তাদের জন্য এই চিকিৎসা-ধারা অনেক বেশি পজিটিভ।
সার্জিকেল ম্যানেজমেন্ট : যদি আপনার ফাইব্রয়েড এর উপসর্গ খুব বেশি গুরুতর হয় এবং যখন ঔষধের মাধ্যমে এর নিরাময় করা যায় না, তখন সার্জারীর প্রয়োজন হতে পারে । ফাইব্রয়েডস অপারেশনের কয়েকটি ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসক আপনাকে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবেন । সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আপনার সাথে অপারেশনের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবেন, এগুলোর সুবিধা অসুবিধা এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির কথাও আপনাকে জানাবেন।
হিস্টেরেকটমি
হিস্টেরেকটমি জরায়ু ফেলে দেয়ার একটি সার্জিক্যাল পদ্ধতি । এটা ফাইব্রয়েডস থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি । এটা তখনই করা হবে যদি আপনার ফাইব্রয়েডস বেশ বড় হয় অথবা গুরুতর রক্তক্ষরন হয় এবং আপনি যদি আর কোন বাচ্চা নিতে না চান। হিস্টেরেক্টমি বিভিন্ন ভাবে করা যায়, যেমনঃ যোনীপথে কিংবা বাইরে থেকে আপনার পেট কাটার মাধ্যমে।
অপারেশনের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে এনেস্থেসিয়ার পদ্ধতি ঠিক করা হয়। এটি হতে পারে স্পাইনাল এনেস্থেসিয়া (যেখানে আপনাকে কোমড়ের নিচে আসাড় করা হবে ) অথবা জেনারেল এনেস্থেশিয়া ( যেখানে আপনারকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হবে)।
আপনার হিস্টেরেকটমি অপারেশনের পর কিছুদিনের জন্য হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। সম্পূর্ন ভাল হতে প্রায় ৬-৮ সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। এই সময়ে যত পারুন বিশ্রাম নিন।হিস্টেরেকটমির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে সময়ের আগেই মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সহবাসের ইচ্ছে কমে যাওয়া।
মায়োমেকটমি
মায়োমেকটমি গর্ভাশয়ের দেয়াল থেকে ফাইব্রয়েডসকে আলাদা করে ফেলার জন্য একটি সার্জিক্যাল পদ্ধতি। এটা হিস্টেরেকটমির একটি বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, বিশেষ করে সেসব মহিলাদের জন্য, যারা এখনো বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক। তবে মায়োমেকটমি সবরকমের ফাইব্রয়েডস এর জন্য উপযুক্ত নয়। আপনার গাইনী বিশেষজ্ঞ, ফাইব্রয়েডস এর আকার,সংখ্যায় কতগুলো এবং অবস্থান ইত্যাদি দেখে আপনাকে জানাবেন, আপনার জন্য এ অপারেশনটি উপযুক্ত কিনা। ফাইব্রয়েডস এর আকার এবং অবস্থান এর উপর ভিত্তি করে মায়োমেকটমি করা হয়। আপনার পেটে কিছু সংখ্যক ছোট ছিদ্র করে এটা করা হতে পারে বা বা একটিমাত্র বড় কাটার মাধ্যমেও করা হতে পারে (একে ওপেন সার্জারি বলে)।
মায়োমেকটমি জেনারেল এনেস্থেসিয়ার মাধ্যমে করা হয় এবং এই অপারেশনের পর কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। হিস্টেরেক্টোমির মত এখানেও আপনাকে পরামর্শ দেয়া হবে কিছু সপ্তাহের জন্য বিশ্রামে থাকার। মায়োমেকটমি ফাইব্রয়েড এর জন্য একটি কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি, যদিও আবারও ফাইব্রয়েডস গাজিয়ে উঠার একটি সম্ভাবনা থাকে, তখন আবারো অপারেশন এর প্রয়োজন হবে।
ইউটেরাইন আর্টারী এম্বোলাইজেশন (UAE)
ইউটেরাইন আর্টারী এম্বোলাইজেশন (UAE) হিস্টেরেকটমী এবং মায়োমেকটমি চিকিৎসার একটি বিকল্প পদ্ধতি । বড় ফাইব্রয়েড থাকলে এর পরামর্শ দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে যে রক্তনালী ফাইব্রয়েডকে রক্ত সরবারহ করে তাকে বন্ধ করে দেয়া হয়, যার ফলে ফাইব্রয়েড সংকুচিত হয়ে যায়।
এই পদ্ধতিতে, পায়ের একটি রক্তনালীর মধ্য দিয়ে ক্যাথেটারের মাধ্যমে এক ধরনের রাসায়নিক তরল শরীরে প্রবেশ করানো হয়, যা এক্স-রের মাধ্যমে বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। আপনার UAE এর পর দু-একদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে। যখন আপনি হাসপাতাল ত্যাগ করবেন, আপনাকে এক-দু সপ্তাহের জন্য বিশ্রাম নিতে বলা হবে। যদিও UAE এর পর সফল গর্ভ ধারণ করা সম্ভব, উর্বরতায় এবং গর্ভধারনে এটি কোন সমস্যা তৈরি করে না।
নতুন পদ্ধতিসমূহঃ
উপরের পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি ফাইব্রয়েড এর চিকিৎসায় দুইটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই দুই নতুন পদ্ধতি ম্যগনেটিক রেজোন্যন্স ইমেজিং ( MRI ) এর সহায়তায় করা হয়।
- MRI-guided percutaneous laser ablation
- MRI-guided transcutaneous focused ultrasound
এই কৌশলে MRI ব্যবহার করে একটি ছোট সূঁচকে ফাইব্রয়েডের কেন্দ্রস্থল লক্ষ্য করে প্রবেশ করানো হয়। লেজার রশ্মি অথবা আল্ট্রাসাউন্ড শক্তি তখন সুঁচের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ফাইব্রয়েডকে ধ্বংস করে। এই চিকিৎসার পদ্ধতি সব রকমের ফাইব্রয়েড চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়না, এবং এর দীর্ঘ-মেয়াদি ঝুঁকি অজানা। এসকল পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে নতুন, বাংলাদেশে এখনও তেমন প্রচলিত নয়। যদিও গবেষনা এখনো হচ্ছে, কিন্তু কিছু তথ্যপ্রমান বলে যে, এই অক্ষতিকর পদ্ধতিটির কিছু মাঝারী থেকে দীর্ঘ মেয়াদী সুবিধা রয়েছে, যখন একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা তা পরিচালিত হয়।
তবে, গর্ভাবস্থায় এর প্রভাব এবং ভবিষ্যতে যাদের বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি, তাই এটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিৎ।
যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
ফাইব্রয়েড বা টিউমারের কারণে রক্তক্ষরণের ফলে এনেমিয়ার আশঙ্কা থাকলে বেশি করে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। ফাইব্রয়েড অস্ত্রোপচারের পর গর্ভধারণ করলে অবশ্যই ভালো সুযোগ-সুবিধা আছে এমন হাসপাতালে সন্তান প্রসব করাতে হবে।
সবার জন্য শুভকামনা
আরও পড়ুনঃ ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর টিউমার ও গর্ভধারণ
তথ্যসূত্রঃ
- www.maya.com.bd/content/web/wp/1777/
- www.maya.com.bd/content/web/wp/1779/