গর্ভবতী মায়ের জ্বর আসলে প্রথমেই মনে যে প্রশ্নটা আসে তা হলো গর্ভের বাচ্চা ঠিক আছে কিনা। কিন্তু প্রথমেই যেটা দরকার তা হলো ডাক্তারের সাথে কথা বলে জ্বর নামানোর ব্যাবস্থা করা। এরপরের কাজ হোল কি কারণে জ্বর হলো তা খুঁজে বের করা। কারণ গর্ভাবস্থায় জ্বর বেশিরভাগ সময়ই অন্য কোন উপসর্গের লক্ষণ যা গর্ভের বাচ্চার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় জ্বর কিভাবে গর্ভের বাচ্চাকে প্রভাবিত করতে পারে?
যখনই একজন গর্ভবতী মায়ের শরীরের তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রী থেকে বেড়ে জ্বরের কাছাকাছি চলে যায় তখনি বুঝতে হবে যে মায়ের শরীর কোন ইনফেকশনের সাথে লড়াই করছে। এই কারণে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হবে।
পশু পাখির ভ্রূণের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভাবস্থার শুরু দিকের জ্বরের সাথে বাচ্চার জন্মের সময় হৃদপিন্ডের জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনা আছে। তবে জ্বরের কারণে এমনটা হয় নাকি যে কারণে জ্বর হয়েছে তার কারণে এমন হয় সেটা বোঝার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
আপনি যদি গর্ভাবস্থার প্রথম ট্রাইমেস্টারে থাকেন এবং জ্বর যদি ১০২ ডিগ্রীর বেশী হয় তবে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। এর ফলে বাচ্চার স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদী জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
গর্ভে বাচ্চার বৃদ্ধি একটি নির্দিষ্ট ধারা মেনে চলে যা সঠিক সময়ে বাচ্চার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গঠন নিয়ন্ত্রণ করে। বাচ্চার বৃদ্ধির এই ধারা নিয়ন্ত্রণ করে প্রোটিন-যা শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন হতে সাহায্য করে।
যদি কোন কারণে শরীরের তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রী থেকে বেড়ে জ্বরের তাপমাত্রার কাছাকাছি চলে যায় তবে তা এই প্রোটিনকে সঠিকভাবে কাজ করতে বাঁধা দেয়। এর ফলে গর্ভপাত এমনকি বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে মুখে মাপা তাপমাত্রা ১০০.৪ ডিগ্রী হলে এবং মলদ্বার বা কানে মাপা তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রী ফারেনহাইট হলে তাকে জ্বর হিসেবে গণ্য করা হয়।
আরো একটি ঘটনা ঘটে সেটি হলো, জ্বর হয়ে আমাদের শরীরে যখন তাপমাত্রা বাড়ে তখন শরীরে শিরা উপশিরাগুলো প্রসারিত হয়। প্রসারিত হওয়ার কারণে শিশুর দেহে মায়ের শরীর থেকে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়ে যায়। এতে মায়ের গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে। এরপর সঠিক পুষ্টি না পাওয়ার কারণে বাচ্চার কম ওজন হতে পারে। সময়ের আগেই প্রসব বেদনা হতে পারে। জন্মের পরও বাচ্চা মারা যেতে পারে। এসব জটিলতা হতে পারে বাচ্চার ও মায়ের।
গর্ভবতী মায়ের জ্বর কি কারণে হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই দুর্বল থাকে কারণে। এই কারণে গর্ভাবস্থায় ইনফেকশন, কাঁপুনি, জ্বর বেশী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ সময় জ্বর হওয়ার কিছু কারণ থাকতে পারে। সেগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
সাধারণ সর্দি কাশি
সাধারণ সর্দি কাশির সাথে প্রায়ই জ্বর আসতে পারে। এর লক্ষণগুলো ফ্লু এর মতো, যেমন- নাক থেকে পানি ঝরা, কাশি, গলা ব্যাথা এবং শ্বাস কষ্ট ইত্যাদি। এই লক্ষণগুলো সাধারণত ১০-১৫ দিনের ভেতর চলে যায়। তবে যদি লক্ষণ গুলো চলতেই থাকে তবে দ্রুত ডাক্তারকে জানান জরুরী।
সাধারণ সর্দি কাশি প্রতিরোধের জন্য বাসাবাড়ি এবং কাজের জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। নিয়মিত হাত ধোন এবং অসুস্থ ব্যাক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
ফ্লু
গর্ভাবস্থায় জ্বরের আরেকটি বড় কারণ হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু। এর লক্ষণ গুলো হলো জ্বর, কাশি, বমি এবং বমি বমি ভাব। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই ডাক্তারকে জানাতে হবে। ফ্লুতে আক্রান্ত হলে প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহন করতে হবে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ফ্লু এর টিকা নেয়া উচিৎ।
ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন
গর্ভাবস্থায় প্রায় ১০ ভাগ মা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে আক্রান্ত হতে পারে। এর লক্ষণ গুলোর মধ্যে আছে ধূসর বা রক্ত মিশ্রিত প্রস্রাব, জ্বর, কাঁপুনি এবং প্রসাবে জ্বালা পোড়া। এই ইনফেকশন হলে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়বে এবং সেই সাথে প্রচুর পানি খেতে হবে। এর চিকিৎসা করা না হলে কিডনি ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে এবং বিভিন্ন গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন- প্রি-টার্ম লেবার।
ফুড পয়েজনিং
ফুড পয়েজনিং এর কারণেও গর্ভাবস্থায় জ্বর হতে পারে। খাদ্য বিষক্রিয়া সাধারণত ভাইরাস বা অল্প কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া (বা তাদের toxins) দ্বারা সৃষ্ট হয়। ফুড পয়েজেনিং হলে বমি বমি ভাব, পানিশূন্যতা, পাতলা পায়খানা দেখা দিতে পারে।
যদি এমন কিছু হয় তবে দ্রুত দেহের পানি এবং ইলেকট্রোলাইট পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এর কারণে পানিশূন্যতা, জরায়ুর সংকোচন এবং প্রি-টার্ম লেবারের মত জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও আর যে সব কারণে জ্বর হতে পারে তা হলো-
- pneumonia
- tonsillitis
- viral gastroenteritis (stomach virus)
- pyelonephritis (kidney infection)
জ্বর হওয়ার সাথে সাথে আর যে সব লক্ষণ দেখা দিতে পারেঃ
- শ্বাস কষ্ট
- পিঠের ব্যথা
- শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
- পেটে ব্যথা
- ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
গর্ভাবস্থায় ভাইরাল জ্বর হওয়াটা স্বাভাবিক। মৃদু জ্বর যা অল্প কিছু দিন থাকে, তাতে ভয়ের তেমন কোন কারণ নেই। যদি জ্বর বেশিদিন ধরে থাকে এবং বেশ কয়েকদিন পড়েও না কমে সেক্ষেত্রে জ্বরের কারণ হতে পারে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন। যদি নীচের লক্ষণগুলো থাকে তবে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে –
- আপনার যদি অন্য কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকে, যেমন- ডায়াবেটিস বা দীর্ঘস্থায়ী কোন সমস্যা এবং এর সাথে যদি জ্বর হয়।
- জ্বরের সাথে সাথে যদি কিডনি ইনফেকশনের কোন লক্ষণ দেখা দেয়।
- পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে
- কোন কারণ ছাড়া মৃদু জ্বর ৪ দিনের বেশী থাকলে।
- কোন কারণ ছাড়া জ্বর প্রতি ৩ সপ্তাহে ১ বারের বেশী বার হলে।
- জ্বরের সাথে স্রাব নির্গত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে এবং দুর্গন্ধ থাকলে।
গর্ভাবস্থায় জ্বর কমানোর কিছু ঘরোয়া উপায়
গর্ভাবস্থায় ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয়। অনেক ওষুধ থেকে গর্ভপাত পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তাই জ্বর হলে ওষুধ ছাড়াই কমানোর চেষ্টা করুন।
জলপট্টি- পাতলা, পরিষ্কার এক টুকরো কাপর ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে কপালে দিয়ে রাখুন। এতে শরীরের তাপমাত্রা কমবে। তবে কাপড়টা ভাল করে চেপে নেবেন। টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়লে কিন্তু ঠান্ডা লাগবে।
গোসল- হাল্কা গরম পানিতে গোসল করে নিন। গোসল করতে ইচ্ছা না হলে তোয়ালে ভিজিয়ে ভাল করে গা মুছে নিন। এতে তাপমাত্রা নেমে যাবে।
পাতলা পোশাক- গর্ভাবস্থায় জ্বর হলে একটা মাত্র পাতলা পোশাক পরুন। শীত করলেও এক গাদা পোশাক চড়াবেন না। এতে শরীর গরম হবে। জ্বর কমবে না। যদি শীত করে তবে পাতলা চাদর বা কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকুন।
পানি- শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্রচুর পানি খান। ফলের রস, পাতলা চা, পাতলা গরম ডাল, স্যুপ খেলে জ্বর কমবে তাড়াতাড়ি।
বিশ্রাম- এমনিতেই গর্ভাবস্থায় সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তার ওপর জ্বরে শরীর দুর্বল হলে ঝুঁকি বাড়ে। তাই এই সময় প্রয়োজন না পড়লে বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। যদি চাকরি করেন তাহলে অবশ্যই ছুটি নিন। বাড়িতেও বেশি কাজ না করে যত পারুন বিশ্রাম নিন ও ঘুমোন। এতে জ্বর তাড়াতাড়ি ছাড়বে, দুর্বলতা কমবে, অন্য সংক্রণের ঝুঁকিও কম থাকবে।
ভিটামিন- ওষুধ না খেতে গিয়ে কিন্তু চিকিত্সক গর্ভাবস্থায় আপনাকে যে ভিটামিন, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড থেকে বলেছেন সে সব বাদ দেবেন না। এই সব ওষুধ নিয়মিত খেতে থাকুন।
যদি গা, হাত পায়ে ব্যথা হয় তবে পেন কিলার খাবেন না। কোনও রকম অ্যান্টিবায়োটিক বা জ্বর কমার ওষুধ নিজে থেকে খেতে যাবেন না। জ্বর বাড়লে অবশ্যই চিকিত্সকের পরমার্শ নিন।
গর্ভাবস্থায় জ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে?
মাকে মনে করতে হবে অন্য সময় তার যে চলাফেরা, জীবন যাপন, গর্ভাবস্থায় সেখানে তাঁকে একটু বাড়তি সাবধান থাকতে হবে। কারণ এ সময় মায়ের শরীরে সংক্রমণ খুব বেশি হতে পারে। এজন্য যেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে সেখানে যেতে সতর্ক হবে।
যেমন হাসপাতাল, হাসপাতালে সবাই রোগ নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে গর্ভাবস্থায় সে যাবে না। কিংবা কারো জ্বর হয়েছে এমন যদি শোনেন তাকে সাধারণত দেখতে যাওয়া ঠিক না। কিংবা অনেক ভিড় যেখানে বা যেখানে অনেক লোকের জনসমাগম হয় সেখানে অনেক লোকের সংক্রমণ রয়েছে, সেটা সেই মায়ের গায়ে চলে আসতে পারে।
সেজন্য মাকে সাবধানে থাকতে হবে।আর তাঁর ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবে। এ ছাড়া সামান্য লক্ষ্মণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে । এ ছাড়া আপনি যখন বাইরে যাবেন, বাইরের খাবার খাবেন না। বিশেষ করে যে খাবারগুলোতে পানি ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকে পানিবাহিত রোগ চলে আসতে পারে। এ থেকে মায়ের ডায়রিয়া হতে পারে।
কিছু কিছু বিষয় যদি মা একটু খেয়াল রাখেন, সচেতন থাকেন, সাবধান থাকেন তাহলে গর্ভাবস্থায় মায়ের যে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো আছে সেগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সুস্থ বাচ্চা জন্ম হতে পারে এবং মা সুস্থ থাকতে পারেন।
সবার জন্য শুভকামনা