এক্লাম্পশিয়া বা গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি কি?
এক্লাম্পশিয়া মূলত প্রি-এক্লাম্পশিয়ার গুরুতর অবস্থা৷ সাধারণত গর্ভধারণের ৬ মাস পর অথবা প্রসবের সময় অথবা প্রসবের কিছু সময় পর এটি হয়ে থাকে৷ তবে সহজভাবে বলা যায় যে প্রি-এক্লাম্পশিয়া রোগীদের যখন খিঁচুনি দেখা যায় তখন তাকে এক্লাম্পশিয়া বলে৷।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রসবের কাছাকাছি সময়ে এ রোগ দেখা দেয়। যেসব মায়ের আগে একবার একলাম্পশিয়া হয়েছে তাদের পরবর্তী প্রসবের সময় আবারো একলাম্পশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ পর যদি কোনো নারীর রক্তচাপ ১৪০/৯০ বা তার বেশি হয় এবং প্রস্রাবের সঙ্গে আমিষ নির্গত হয়, তবে তাকে প্রি-এক্লাম্পসিয়া বলে। পরে সমস্যাটি গর্ভাবস্থার খিঁচুনি হিসেবেও দেখা দিতে পারে।সমস্যাটি মৃদু বা প্রকট দুই ধরনেরই হতে পারে।
রক্তচাপ যদি ১৪০/৯০-এর বেশি কিন্তু ১৬০/১১০-এর কম হয়, তবে সমস্যাটি মৃদু।আর সিস্টোলিক প্রেশার (রক্তের সংকোচন চাপ) যখন ১৬০ বা তার বেশি, ডায়াস্টোলিক (প্রসারণ চাপ) প্রেশার ১১০-এর বেশি হলে সমস্যাটি প্রকট হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর জন্য যে পাঁচটি প্রধান কারণ রয়েছে তার মধ্যে এক্লাম্পশিয়া অন্যতম। বাংলাদেশে মোট প্রসূতি মৃত্যুর ১১% ঘটে এক্লাম্পশিয়ার কারণে অর্থাৎ প্রতি এক হাজার প্রসূতি মৃত্যুর মধ্যে এক্লাম্পশিয়ায় মারা যান ১১০ জন নারী। তবে সময়মত প্রসূতির স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলে অত্যন্ত উদ্ধেগজনক এই সংখ্যাটিকে শূণ্যের কাছকাছি নামিয়ে আনা সম্ভব।
গর্ভধারণ ও প্রসব সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভধারণের শুরু থেকে প্রসবের পরের ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সাবধান ও সচেতন থাকলে প্রসূতি মৃত্যু এবং শিশু মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। তাই অধিক প্রসূতি মৃত্যু হারের এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় এক্লাম্পশিয়া সম্পর্কে জানা ও বোঝা সবার জন্য জরুরী।
গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি হওয়ার কারণ
সাধারণত প্রথম বার মা হওয়ার সময়, ওজন বেশি হলে, ২০ বছরের কম বয়সে প্রেগনেন্ট হলে বা বয়স ৪০ এর বেশি হয়ে যাওয়ার পর প্রেগনেন্ট হলে, উচ্চ রক্ত চাপের সমস্যায় ভুগলে, গর্ভে একের অধিক সন্তান থাকলে, ডায়াবেটিস বা কিডনির সমস্যা থাকলে এবং পরিবারের কারো একলাম্পসিয়া হয়ে থাকলে একলাম্পসিয়া হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
প্রায় ৫ শতাংশ প্রেগন্যান্ট নারীই প্রিএকলাম্পসিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। দুর্ভাগ্যবশত এর তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়না। আপনি যদি সুস্থ অনুভব করেন তারপর ও তা আপনার ও আপনার বেবির জন্য বিপদজনক হতে পারে। এজন্য প্রতিবার ডাক্তারের সাথে দেখা করার সময় আপনার রক্তচাপ মাপা এবং প্রস্রাবের প্রোটিন পরীক্ষা করানো জরুরী।
গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহ পরে প্রিএকলাম্পসিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এটি গর্ভাবস্থার দ্বিতীয়ার্ধে যে কোন সময়, প্রসবের সময়, এমনকি প্রসবের পরেও হতে পারে – বিশেষ করে প্রসবের পরের প্রথম ৪৮ ঘন্টায়। এটি মাঝারি থেকে তীব্র আকার ধারণ করতে পারে এবং আস্তে আস্তে বা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় হওয়া খিঁচুনি কেন বিপদজনক
খিঁচুনি বা এক্লাম্পশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রেগনেন্সির সাধারণ সমস্যার মত মনে হতে পারে বলে তা বোঝা সম্ভব হয়না। এজন্য চিকিৎসকের সাহায্য প্রয়োজন। চিকিৎসক ব্লাড প্রেশার মাপবেন এবং ইউরিন টেস্ট করতে দেবেন। যদি ব্লাড প্রেশার বেশি দেখা যায় এবং প্রস্রাবে প্রোটিনের উপস্থিতি দেখা যায় তাহলে আপনার প্রিএকলাম্পসিয়া নির্নয় হবে।
যদি আপনার সিস্টোলিক রক্ত চাপ ১৪০ বা তার বেশি হয় এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৯০ বা এর বেশি হয় তাহলে ডাক্তার আরো কিছু পরীক্ষা করাতে দেবেন। গর্ভাবস্থায় ব্লাড প্রেশার উঠানামা করতে পারে বলে ব্লাড প্রেশার শুধু একবার মাপাই যথেষ্ট নয়।
কিছু নারীর ক্ষেত্রে খিঁচুনির আরো কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে যাকে HELP সিনড্রোম বলে। এতে লাল রক্ত কণিকা ভেঙ্গে যায় যাকে হেমোলাইসিস বলে। যকৃতের এনজাইম বৃদ্ধি পায় এবং প্লাটিলেট কমে যায়, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
একবার খিঁচুনির লক্ষণ দেখা গেলে পর্যায়ক্রমে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
খিঁচুনির লক্ষণগুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে যে একলাম্পসিয়া আসন্ন। এমন অবস্থায় হঠাৎ করেই খিঁচুনি আসতে পারে যা মা ও গর্ভের শিশু উভয়ের জন্যই মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। এ সময় যদি সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা না হয় তাহলে মৃত্যু প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তাই বিপদ জনক উপসর্গ দেখা দেয়া মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণের ঔষধ সেবন করতে পরামর্শ দেবেন ডাক্তার।
একলামম্পসিয়ার রোগীর সন্তানের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। কারণ বার বার খিঁচুনি হলে গর্ভস্থ শিশুর দেহে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছায় না বলে অক্সিজেনের ঘাটতিতে ভোগে শিশু। এছাড়াও খিঁচুনি বন্ধ করার জন্য যে সব ঔষধ দেয়া হয় তার জন্যও শিশুর মৃত্যু হতে পারে।
গর্ভাবস্থার খিঁচুনি হবার আগের ৫ টি লক্ষণ
শরীরে পানি আসা
সাধারণত শরীরে পানি আসাই হচ্ছে খিঁচুনি সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। যদি আপনার মুখ ও চোখের নীচে ফোলা দেখতে পান, হাত যদি সামান্য ফুলে যায় বা আপনার পায়ের পাতা ও গোড়ালি যদি হঠাৎ করেই ফুলে যায় তাহলে আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
শরীরে পানি জমে যাওয়ার কারণেই এমন হয় বলে ওজন ও বৃদ্ধি পায়। যদি আপনার ওজন সপ্তাহে ৪ পাউন্ডের বেশি বৃদ্ধি পায় তাহলে তাও জানাতে হবে চিকিৎসককে। তবে মনে রাখবেন সব প্রেগন্যান্ট নারীরই প্রিএকলাম্পসিয়া হলে শরীরে ফুলে যায়না বা ওজন বৃদ্ধি পায়না।
তীব্র মাথাব্যথা হওয়া
খিঁচুনি ক্ষেত্রে গর্ভবতী মা তীব্র মাথাব্যথার সমস্যায় ভুগতে পারেন। ঘন ঘন মাথা ব্যথায় ভুগতে পারেন গর্ভবতী নারী।
দৃষ্টি শক্তির সমস্যা
দৃষ্টি শক্তির সমস্যা হলে যেমন- দ্বৈত দৃষ্টির সমস্যা, ঝাপসা দেখলে, চোখের সামনে কোন দাগ দেখা যায় বলে মনে হলে বা আলোর ঝলকানি দেখা দিলে, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা দেখা গেলে এবং অস্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে তা প্রিএকলাম্পসিয়াকে নির্দেশ করে।
পেটে ব্যথা
খিঁচুনি আক্রান্তদের উপরের পেটে তীব্র ব্যথা হতে পারে।
বমি হওয়া
গর্ভবতী নারী খিঁচুনি আক্রান্ত হলে বমি বমি ভাব ও বমি হতে দেখা যায়।
এছাড়াও অন্যান্য লক্ষণগুলো হোল-
- রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া৷ রক্তচাপ সাধারণত ১৪০/ঌ০ (মিলিমিটার পারদ চাপ) এর বেশি থাকে৷
- অনিদ্রা।
- অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে (প্রসবের সময়, আগে এবং পরে)।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া।
- পেটের উপর দিকে অসহ্য ব্যথা।
- শরীরে ওজন বাড়তে থাকে।
এক্লাম্পশিয়া রোধ করা যায় যেভাবে
এক্লাম্পশিয়া রোধে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাপনা সমূহ গ্রহণ করতে হয়:
- গর্ভকালীন সময়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করানো।
- রক্তচাপ ঠিক আছে কি না, তা সব সময় পরীক্ষা করাতে হবে,
- মা এর ওজন স্বাভাবিক হারে বাড়ছে কি না, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
- সন্তান জন্মদানের পর মা-এর মাথাব্যথা, বমি ভাব বা শরীর ফুলে যাচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে।
- প্রশিক্ষিত ব্যক্তি (প্রশিক্ষিত দাই, এসবিএ, এফডাব্লিউভি, এফডাব্লিউএ বা চিকিৎসক) দ্বারা প্রসব করানো।
- গর্ভকালীন ও প্রসবোত্তর পুষ্টি, বিশ্রাম ও মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করা।
- গর্ভধারণের পূর্বে, গর্ভকালীন এবং প্রসবোত্তর সময়ে উচ্চ রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- খিঁচুনী দেখা দেয়ার সাথে সাথে কোন বিলম্ব না করে রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা।
- খিচুনী দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিশ্চিত করা যেমন: এক্লাম্পশিয়ার চিকিৎসা পাওয়া যায় কাছাকাছি এমন হাসপাতালের সন্ধান রাখা এবং যানবাহন ও টাকার ব্যবস্থা রাখা।
- প্রি-এক্লাম্পশিয়া ও এক্লাম্পশিয়ার লক্ষণগুলো জানা এবং বোঝা ও যথাসময়ে চিকিৎসা নেয়া।
খিঁচুনি বা এর পূর্ব লক্ষণ দেখা দিলে যা করার পরামর্শ দেয়া হয় :
গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহে বা এর পরে যদি হালকা প্রিএকলাম্পসিয়া দেখা যায় এবং আপনার ও আপনার গর্ভের শিশুর অবস্থা যদি খারাপ মনে হয় তাহলে সিজার করার পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক।
আর যদি ৩৭ সপ্তাহ না হয় এবং আপনার ও সন্তানের অবস্থাও স্থিতিশীল থাকে তাহলে আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেবেন চিকিৎসক নাহয় বাসায় থাকলেও সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকার পরামর্শ দেবেন এবং নিয়মিত ব্লাড প্রেশার মাপার নির্দেশনা দেবেন। আপনাকে সনোগ্রাম করানোর পরামর্শ দেয়া হবে এবং শিশুর নড়াচড়া গণনা করার ও নির্দেশনা দেয়া হবে। যদি ব্লাড প্রেশার বৃদ্ধি পায় ও শিশুর নড়াচড়া কমে যায় তাহলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে এবং ডেলিভারি করানোর প্রয়োজন হবে।
যদি আপনার তীব্র খিঁচুনি লক্ষণ দেখা যায় তাহলে আপনাকে হাসপাতালেই ভর্তি হয়ে থাকতে হবে এবং হাই-রিস্ক প্রেগনেন্সি স্পেশিয়ালিস্ট আপনাকে পর্যবেক্ষণে রাখবেন। আপনার শিরায় ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ইনজেকশন দেয়া হবে খিঁচুনি প্রতিরোধের জন্য। সেই সাথে উচ্চ রক্ত চাপ যদি অনেক বেশি থাকে তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ও ঔষধ সেবন করতে দেবেন।
ডেলিভারির পরে ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি ব্লাড প্রেশার বেশি থাকে তাহলে আপনার শিরায় ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ইনজেকশন দেয়া হবে খিঁচুনি প্রতিরোধের জন্য। আপনাকে বাসায় এসেও বেশ কিছুদিন হাই ব্লাড প্রেশারের ঔষধ সেবন করার পরামর্শ দেয়া হবে।
এক্লাম্পশিয়া একটি মারাত্মক সমস্যা। তাই পরিবারের সবাইকে এই রোগের ব্যাপারে সচেতন করুন এবং আপনার পাশের বাড়ীর লোকজনদের কেও আগে ভাগেই জানিয়ে রাখুন এক্লাম্পসিয়া’র ব্যাপারে, যদি সেই পরিবারে কেও গর্ভবতী হয়ে থাকে।
সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সবার জন্য শুভকামনা।