শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প নেই।শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধই তার জন্য যথেষ্ট। আর কোনো খাবারের প্রয়োজন নেই। একজন শিশু জন্মের পর প্রথম যে খাবারটি মুখে নেয়, সেটিই হল মায়ের বুকের দুধ। আর এই বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে মায়েদের মনে আসে নানা প্রশ্ন। প্রায় সব মায়েদের মনে প্রথম যে সন্দেহটি কাজ করে তা হল, তার শিশু ঠিকমত বুকের দুধ পাচ্ছে তো?
সাধারণত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম তিন দিন বুকের দুধ আসে না। এজন্য চিন্তিত হবেন না। এ সময় মায়ের বুকে যতটুকু শাল দুধ আসে ততটুকু দুধ শিশুর জন্য যথেষ্ট। শিশুকে শাল দুধ খাওয়াতে কখনোই ভুল করবেন না। তিন দিন পর যখন মায়ের বুকে দুধ আসবে তখন বার বার শিশুকে দুধ খাওয়ান।
শিশু ঠিকমত বুকের দুধ পাচ্ছে কিনা কিভাবে বুঝবেন?
আপনার শিশু ঠিকমত বুকের দুধ পাচ্ছে কিনা সেটি বুঝিয়ে দেবে আপনার সন্তান নিজেই। কিছু লক্ষণ আছে যা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার শিশুটি পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ পাচ্ছে কিনা। আজ এমনি কিছু লক্ষণের কথা আপানদেরকে জানাবো।
ঢোক গিলে খাওয়া
শিশু জন্মের পর দুধ টেনে খাওয়ার ক্ষমতা বেশি থাকে। যখন শিশুটি ঘন ঘন স্তন টান দেবে, এতে জমাট বাঁধা দুধ সহজেই শিশুর মুখে চলে আসবে। শিশু যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ পাবে, তখন সে ঘন ঘন ঢোক গিলবে দুধ পান করার জন্য।
পর্যাপ্ত পরিমান দুধ যদি শিশু না পায়, তবে বার বার স্তন টান দিবে কিন্তু ঢোক গিলবে না। দীর্ঘসময় ধরে সে স্তন মুখে নিয়ে রাখবে। অনেক সময় শিশু ক্লান্ত হয়ে স্তন মুখে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
শিশুটি সন্তুষ্ট
আপনার শিশু দুধ পান করে সন্তুষ্ট হলে তাকে খুশি খুশি দেখাবে। তবে যদি শিশু অনাবরত কান্না করতে থাকে এর অর্থ সবসময় এই নয় যে সে পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ পাচ্ছে না। প্রথম ছয় মাস সে ২-৩ ঘন্টা পর পর খেতে চাইবে। যদি এক ঘন্টা অথবা তারচেয়ে কম সময়ে আবার খেতে চায়, তবে বুঝতে হবে শিশু ঠিকমত বুকের দুধ পাচ্ছে না।
শিশুর প্রস্রাবের পরিমাণ
একজন শিশু চব্বিশ ঘণ্টায় ছয়বার প্রস্রাব করে থাকে। যদি এর চেয়ে কম প্রস্রাব করে, তবে বুঝতে পারবেন শিশুটি দুধ পানে সন্তুষ্ট নয়। শুধুমাত্র প্রস্রাব নয় পায়খানার রংও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত একজন সুস্থ শিশু দিনে চারবার পায়খানা করে থাকে। প্রথমদিন কিছুটা কালো আঠালো পায়খানা করে। তৃতীয় অথবা চুর্থতদিন পর পায়খানার রং সবুজ এবং পঞ্চম দিনে সেটি হলুদ রং ধারণ করে থাকে।
[ আরও পড়ুনঃ নবজাতকের পায়খানা : কখন স্বাভাবিক, কখন নয় ]
ওজন বৃদ্ধি
প্রতিটি মাই সন্তানের ওজন নিয়ে চিন্তিত থাকেন। প্রথম সপ্তাহ শিশুর ওজন উঠানামা করাটা স্বাভাবিক। নবজাতক শিশু জন্মের পরে তৃতীয় চুর্থত দিনে ৫% থেকে ৭% পর্যন্ত ওজন হ্রাস করতে পারে। তাই বলে ভয় পাবেন না। জন্মের প্রথম কয়দিন ওজন কমলেও, ১০ দিনের মধ্যে শিশুর ওজন বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। কিন্তু যদি ওজন হ্রাসের পরিমাণ ১০% অথবা তার বেশি হয়, তবে তা চিন্তার বিষয়।
এছারাও বাচ্চা যদি দিনে অন্তত ৬ থেকে ৮ বার বুকের দুধ খায়, বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করার পর যদি স্তনের বা নিপলের ব্যাথা কমে যায়, দুধ খাওয়ানোর পর স্তন হালকা এবং নরমবোধ হয় , বাচ্চার গায়ের রঙ যদি পরিষ্কার থাকে এবং বাচ্চার শরীরের কোন অংশে চাপ দিলে তা দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসলে বুঝতে পারবেন আপনার শিশু ঠিকমত বুকের দুধ পাচ্ছে।
অনেকে মা আছেন শিশু কান্না করলে মনে করেন শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ পাচ্ছে না। এই ধারণা ঠিক নয়। অনেক সময় মা বুকে আদর করে জড়িয়ে ধরলে শিশুর কান্না বন্ধ হয়ে যায়। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় লক্ষ্য রাখবেন, শিশুটি স্তনের বোঁটা এবং কালো অংশ বড় হা করে ধরছে কিনা।
[ আরও পড়ুনঃ বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধির চার্ট । ০-১২ মাস ]
আমার শিশু দিনে কয়বার খেতে চাইতে পারে?
সব শিশুর ক্ষেত্রেই এটি আলাদা, এবং শিশু কীভাবে জন্ম নিয়েছে তার উপরও এটি নির্ভর করে। জন্মের পর প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে একবার দুধ খেয়ে তার শুভসূচনা করার কথা। এরপর শিশুরা ঘুমিয়ে পড়তে পারে, এবং পরে আবার খেতে চাইলে আপনাকে বিভিন্নভাবে সংকেত দেয়ার চেষ্টা করবে। এই সংকেতগুলো হচ্ছেঃ
১। ঘুম থেকে উঠে নড়াচড়া করা শুরু করবে
২। চারপাশে মাথা ঘোরাবে
৩। কোন একটা কিছু (বেশীরভাগ সময়ই আঙ্গুল) নিয়ে চোষা শুরু করবে
নার্স শিশুকে নিয়ে আসার সাথে সাথে তাকে এমন ভাবে বুকে নিন যাতে আপনার ত্বক তার শরীরের ত্বকের সংস্পর্শে আসে। এতে সে শান্ত হয়ে আসে। যতক্ষন না সে খেতে চাইছে তাকে ওইভাবে বুকের সাথে ধরে রাখুন।
প্রথম ছয় মাস সে ২-৩ ঘণ্টা পর পর দিনে ৮-১০ বার করে খেতে চাইবে। কিন্তু জন্মের ৩য় ও ৬ষ্ঠ সপ্তাহে এবং ৩য় মাসে সে দিনে ১০-১২ বার করে খেতে চাইবে কারণ এ সময়গুলোতে তাদের বৃদ্ধির হার বেশি থাকে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ মাসে শিশু দিনে ৪-৫ বার করে খেতে চাইবে।
নবজাতকের পাকস্থলী একটা মার্বেলের সমান হয়, তাই তাদেরকে ‘অল্প করে বার বার’ খেতে হয়। এ কারণে বাচ্চা খেতে চাইলেই তাকে খেতে দেয়াটা জরুরি। আপনার শিশু একবার ভাল করে খাওয়ার একটু পরেই আবার ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তে পারে।
শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্নভাবে খাওয়ার প্রবণতা দেখায়। তারা যখনই খেতে চায় তখনই তাদেরকে খেতে দিলে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী পুষ্টির সরবরাহ করা নিশ্চিত হয়।
কতদিন পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত:
জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এই ছয় মাস অন্যকোন খাবার শিশুকে দেওয়া উচিত নয়। ছয়মাস পর বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুকে অন্যান্য খাবার খেতে দেওয়া হয়। সাধারণত দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।
শিশুকে যত বেশি সময় ধরে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন ততই আপনার শিশুর জন্য ভাল। বুকের দুধে মিনারেল, আয়রনসহ সব রকমের ভিটামিন রয়েছে যা আপনার শিশুর চাহিদা পূরণ করে থাকে। তবে হ্যাঁ দুই বছর বয়স হয়ে গেলে বুকের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
আমার বাচ্চা বুকের দুধ খাচ্ছে না, আমি কী করতে পারি?
জন্মের ঠিক পর পর বেশিরভাগ বাবা-মা এই প্রশ্নটি করেন। এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আপনার শিশু যথা সময়ে খাওয়া শুরু করবে। পুরোটা সময় মায়ের শরীরের সাথে তার শরীর লাগিয়ে রাখুন। শিশুকে আপনার কাছে রাখুন এবং সে যখন প্রস্তুত হবে তখন সে চুষে খাওয়া শুরু করবে। কোনমতেই জোর করবেন না।
জন্মের ১২-২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও শিশু খাওয়া শুরু না করলে তা মায়ের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসময় ফিডারে করে খাওয়ানোর বদলে স্তন থেকে শালদুধ (কলোস্ট্রাম; colostrum) চেপে বের করে আঙ্গুলে নিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
যদি আপনার শিশু বেশিক্ষণ ধরে দুধ না খায়, কিন্তু নিয়মিত প্রস্রাব-পায়খানা করে তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এসময় ফর্মুলা মিল্ক বা চিনি মেশানো পানি খাওয়ানো শুরু করবেন না। এগুলোর কোন দরকার নেই এবং এতে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি বেশি হয়।
একজন শিশুর জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হল মায়ের বুকের দুধ। কিছুটা সর্তকতা অবলম্বন করলে একজন শিশু পরিপূর্ণভাবে পেতে পারে এই অমূল্য খাবারে স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ।
সবার জন্য শুভকামনা।