আমরা আজকাল হরহামেশাই একটি উপদেশ শুনি- “বাচ্চার খাবারে চিনি, লবণ কিংবা মধু দিবেন না”। এই কথাগুলোর যৌক্তিকতা কতটুকু?
আমরা অনেকেই কথাগুলো পাত্তা দেইনা- কিছু মা এর মন্তব্য “ আমি আমার বাচ্চাকে এগুলো সবই দিয়েছি এক বছর বয়সের আগেই- কই কিছু তো হয়নি” , “আরে কিছু হবেনা, এগুলো বাড়াবাড়ি, ডাক্তাররা কত কথাই বলে” কিংবা “গুগল কত কিছুই বলবে”।
এই মন্তব্যকারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই,শরীরের সব ক্ষতি সবসময় দৃষ্টিগোচর হয়না। কিছু ক্ষতির ফল সুদূরপ্রসারী, তাৎক্ষনিকভাবে তা বোঝা যায়না, আবার কিছু তাৎক্ষনিক রিঅ্যাকশন কারো হয়, কারো হয়না। যেমন- একজন ধূমপায়ী বলতেই পারেন “আমি গত ৩০ বছর ধরে ধূমপান করি কিন্তু আমার কোন ভয়াবহ অসুখ নেই”। ধূমপায়ীরএই মন্তব্য কখনোই ধূমপানের অপকারিতা ধুয়ে ফেলতে পারেনা কিংবা একে ক্ষতিকারক নয় প্রমাণ করেনা।
কারো কারো সমস্যা না হলেই যে ব্যাপারটি ঠিক- তা কিন্তু না। তাই কেন এ জিনিসগুলো আপাত দৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে না হলেও বাচ্চাদের খাবারে দেয়া থেকে এবং ভুল উপদেশ দেয়া থেকে বিরত থাকবেন তা জেনে নিন।
মধু
মধু সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক অসাধারণ খাবার হলেও মধুতে থাকা ক্লাস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম নামক ব্যাকটেরিয়া কখনও কখনও শিশুদের নাজুক পাকস্থলীতে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে।কারণ এই ধরনের উপাদানের সঙ্গে লড়াই করার মতো শক্তি ছোট শিশুদের শরীরে তৈরি হয় না। এই রোগকে বটুলিজম বলে।
একটু বড় শিশু কিংবা বয়স্কদের, মধুতে থাকা এই ব্যাকটেরিয়া ক্ষতি করতে পারে না কারণ তাদের হজম পদ্ধতি ছোট শিশুদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তাই এই রোগেটি গুটিকয় বাচ্চার ক্ষেত্রে ঘটে থাকলেও এ মারাত্মক ঝুঁকি নেয়া কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
লবণ
“লবণ ছাড়া আবার খাবার খাওয়া যায় নাকি?” এমনটা ভেবে যারা বাচ্চার খাবারে লবণ ব্যাবহার করেন কিংবা ফাস্টফুড শপে গিয়ে লবণসমৃদ্ধ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বাচ্চাকে অফার করেন- তাদের জন্য বিষয়টি জানা জরুরী।
প্রথমত, লবণ সমৃদ্ধ খাবার সুস্বাদু, কিন্তু বাচ্চা এই স্বাদ সম্পর্কে অবহিত নয়। ছয় মাস হবার আগ পর্যন্ত সে মায়ের দুধ কিংবা ফর্মুলা খেয়ে এসেছে যেগুলো লবণাক্ত ছিলনা। তাই ছোটবেলা থেকে লবণযুক্ত খাবার খেলে পরবর্তীতে তার এ ধরণের খাবারের প্রতি আসক্তি বেড়ে যায়।
এক বছরের নীচের বাচ্চাদের অপরিণত কিডনির জন্য অতিরিক্ত লবণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ধরণের ক্ষতিগুলো সাধারণত খালি চোখে বোঝা যায়না,কিন্তু পরবর্তীতে পরিণত বয়সে তার বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মনে রাখবেন, মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ বাচ্চারা মায়ের দুধ থেকেই পেয়ে থাকে। তাই অতিরিক্ত লবণ যুক্ত করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন।
চিনি
বলার অপেক্ষা রাখেনা, বর্তমান যুগে সবচেয়ে ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচ্য খাবারের একটি হলো চিনি। শুধু বাচ্চা কেন, বয়স্কদেরও এই “সাদা বিষ” খেতে সম্পূর্ণভাবে মানা করা হচ্ছে এখন। প্রথম সলিড শুরু করার সময় বাচ্চার যেহেতু মিষ্টি নিয়ে কোন বায়না থাকেনা, তখন থেকেই চিনিমুক্ত খাবার দেয়া শুরু করা উচিত।
আর বেশিরভাগ মিষ্টি জাতীয় খাবারেই যেহেতু চিনি ব্যাবহার করতে হয় তাই সবসময় সম্ভব না হলেও অন্তত ১২ মাস হওয়া পর্যন্ত বাচ্চার খাবারে চিনি ব্যাবহারে সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত। বাজারের বেশিরভাগ টিনজাত শিশু খাদ্যে চিনি ব্যাবহার করা হয় যদিও তা সবসময় টিনের গায়ে উল্লেখ করা থাকেনা।
মনে রাখবেন, ৬ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ থেকেই শরীরের বেশিরভাগ পুষ্টি নিশ্চিত হয়, বাকি যেটুকু সলিড খাবার থেকে প্রয়োজন তা খুব অল্প পরিমাণ সুষম খাবারেই মেটে। খুব সুস্বাদু করে লবণ, চিনি ব্যাবহার করে বিভিন্ন খাবার অফার করলেই বরং পরবর্তীতে খাবার নিয়ে বায়না করার সম্ভাবনা বাড়ে এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে।
তাই যারা “ আমার বাচ্চা বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিংবা চিপস, চকলেট এগুলো ছাড়া কিছুই খায়না” জাতীয় সমস্যায় জর্জরিত , তাদের প্রতি একটাই প্রশ্ন, এ জাতীয় খাবার অস্বাস্থ্যকর জেনেও আমরা কেন অবুঝ বাচ্চাদের এগুলো একবার হলেও খাওয়াই এবং তাদের এ স্বাদের সাথে পরিচিত করাই?
বাচ্চার স্বাদ এবং রুচি শুরুতেই কিন্তু বড়দের মত হয়না। তাই তার জন্য রান্না করা খাবার আমাদের একটু বিস্বাদ লাগলেও এ ক্ষতিকর উপাদান দুটো (লবণ ওচিনি) ব্যাবহার না করাই শ্রেয়।
সবার জন্য শুভকামনা।