শিশুর বেড়ে ওঠা । নবম মাস
নয় মাস বয়সে বাচ্চারা হামাগুড়ি / ক্রলিং করে এবং বেশিরভাগ বাচ্চাই মোটামুটি স্বাধীনভাবে উঠে বসতে পারে। তবে, অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটা শুরু করতে আরো এক দু- মাস কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশিদিন লাগতে পারে। এ সময় শক্ত কিছু ধরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করার প্রবণতা দেখা যায়, কিংবা আপনার হাত ধরে ‘হাঁটি হাঁটি –পা পা’ করতে খুব পছন্দ করে।
অনেক সময় নিচু হয়ে বাচ্চাকে হাঁটানো আমাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে যায়, কিন্তু বাচ্চাদের এই নতুন কর্মকাণ্ডে সীমাহীন আগ্রহের কোনো সীমা থাকে না। তাই, অনেকে ওয়াকার কিনে থাকেন, গোলাকার ওয়াকার বাচ্চার শারীরিক বিকাশের জন্য তেমন উপযুক্ত নয়। তাই ঠেলে চালানো যায় এরকম কিছু ওয়াকার পাওয়া যায়, যেগুলো বাচ্চার হাঁটতে শেখার দিনগুলোতে বেশ সাহায্য করে। কোন কোন সময় প্লাস্টিকের টুল দিয়েও এ কাজটি করা যায়।
ঘর এবং মেঝে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা উচিৎ কারণ হাঁটতে শেখার প্রথম পাঠ খালি পায়েই নেয়াই ভালো। শক্ত সোলের জুতা পরিহার করা উচিৎ, অন্ততঃ যতদিন শিশু নিজে হাঁটতে না শেখে। নরম সোলের জুতা এবং গ্রিপ-ওয়ালা মোজা এসময় খুব কাজে লাগে, বিশেষ করে শীতের সময়।
নয় মাস বয়সী বাচ্চার বাবা-মা-ই সাধারণত তার সবচেয়ে প্রিয় খেলার সাথি হয়। তার বুদ্ধিমত্ত্বার বিকাশ ঘটে, নিত্যনতুন বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ পায়। এই ক্ষুদে মানুষের নতুন নতুন কর্মকাণ্ড আপনাকে যেমন আনন্দিত করে ও নির্মল বিনোদন দেয়, ঠিক তেমনিভাবে বিচলিতও করে। এসময় ঘরের আসবাব ও শিশুর আশেপাশের পরিবেশ ঝুঁকিমুক্ত রাখার প্রতি বিশেষ সচেতন হতে হয়। এ ব্যাপারে শিশুর বৃদ্ধির পুর্ববর্তী মাসগুলোতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আপনার বাচ্চা যদি এখনো চুষনি কিংবা প্যাসিফায়ার ব্যাবহার করে, তাহলে আস্তে আস্তে কমিয়ে আনুন। কিছু নির্দিষ্ট সময় ছাড়া , অন্য সময় তাকে খেলা ও অন্য কর্মকাণ্ডে ব্যাস্ত রাখুন, নতুবা, এটি বদ-অভ্যাসে পরিণত হবে, এবং অনেক বড় হওয়া পর্যন্ত এ বস্তুটি ছাড়া সে অসহায় বোধ করবে।
এ বয়সী বাচ্চার সাথে কথা বলুন, এবং তাকেও তার নিজস্ব ভাষায় মত প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ করুন। শিশুর কথা বলা কিংবা অন্যান্য বিকাশে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ব্যাবহারে ক্ষতি বই কোন লাভ হয় না। সুরতাং এগুলো থেকে বাচ্চাকে দূরে রাখুন।
শিশুর নিরাপত্তাহীনতা বা সেপারেশন অ্যাংযাইটি
মা –বাবা কে ছাড়তে না চাওয়া , বাবা মা বাইরে গেলে কিংবা নতুন কাউকে দেখলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার (সেপ্যার্যাশান অ্যাংযাইটি) ব্যাপারটি এসময় বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এটি শিশুর বৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
এসময় যথাসম্ভব ধৈর্য ও আন্তরিকতার সাথে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হয়। সাধারণত দু- বছর পর্যন্ত এই অ্যাংযাইটি কম বেশী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েদের বাচ্চাদের।
শিশুর খেলা
শিশুকে এসময় বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি টয় দেয়া শুরু করা যায়, যেমন নমনীয়, চোখা কিংবা ধারালো কোনা-বিহীন খেলনা, ব্লক, শব্দযুক্ত বোর্ড বুক (মোটা ভারি পাতার বই, যাতে বাচ্চারা হাত বা মুখের সাহায্যে টেনে ছিঁড়তে না পারে) কিংবা একটি রিঙের উপর অন্যটি সাজানো যায় এমন খেলনা (স্টকিং টয়), ছুড়ে মারার জন্য হালকা বল ইত্যাদি।
গোসলের সময়টি সে এসময় অনেক উপভোগ করবে। এসময় তাকে বিভিন্ন বাথ টয় বা পানিতে খেলার উপযোগী খেলনা দিয়ে অনেক আনন্দ দেয়া যায় । তবে, বাথ টাব, গামলা কিংবা বাচ্চাদের পুলে খেলার সময় অবশ্যই বাচ্চাকে বড়দের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে। অনেক সময় কয়েক মিনিটের অসর্তকায় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
বাচ্চার ভ্রমন
খুব দীর্ঘ ভ্রমনের জন্য আপনার বাচ্চা এখন ঠিক সেভাবে প্রস্তুত নয়। তবে নিতান্ত যেতেই হতে, আগে থেকে কিছু প্রয়োজনীয় প্ল্যানিং করে রাখুন। যাত্রাপথে এ বয়সী বাচ্চারা সবকিছুকে ঠিক আরাম বা নিরাপদ মনে নাও করতে পারে, এবং কান্নাকাটি ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে, এ বিষয়গুলো আগে থেকে মাথায় রেখে ভ্রমনের পরিকল্পনা করা উচিৎ।
ভ্রমণের সময় বাচ্চাকে ভোলানোর জন্য তার প্রিয় খেলনা সাথে রাখুন। তার নিজের কম্বল বা পছন্দের খেলনা সঙ্গে রাখতে পারলে সে হয়তো শান্ত থাকবে, যাতে তার মনে হবে বাইরে বেরোলেও বাড়ির একটা টুকরো তার সঙ্গেই রয়েছে। শোরগোল আর অচেনা লোকজনের থেকে দূরে চুপচাপ থাকতে পারলেও বাচ্চার মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে।
বাচ্চার খাবার
এসময় থেকে বাচ্চাকে একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে সলিড খাবার দিন, যাতে সে ক্ষুধা অনুভব করে। এই বিরতি ২ থেকে ৪ ঘণ্টা হতে পারে, এটি নির্ভর করবে শিশুর অ্যাক্টিভিটি , দৈহিক প্রয়োজন, খাবারের ধরন কিংবা পরিমানের উপর। এই বিরতির মাঝে তাকে দুধ , কিংবা তরল খাবার কিংবা ফলের রস ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। মায়ের দুধের ঘাটতি দেখা দিলে এসময় প্রয়োজন অনুযায়ি ফর্মুলা দুধ দিতে পারেন। এতে দুধ ও পানির বাড়তি চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হয়।
আর এতদিন যদি বাচ্চাকে সেমি সলিড খাবার খাওয়ান, এখন থেকে কিছু কিছু সলিড দিতে শুরু করতে পারেন। বাচ্চাকে নিজে খেতে দিন। তবে , বাচ্চার হাতে বিস্কিট , আপেল কিংবা শক্ত কিছু টুকরো না দেয়াই ভালো। ফলমূল হলে হালকা ম্যাশ করে দিতে পারেন। আপনি যেভাবেই দিন না কেন, এ বয়সী বাচ্চার খাবার সময় পুরোটা সময় তার দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ। কারণ খাবারের টুকরো কিংবা চামচ ইত্যাদি থেকে অনেক সময় বিপদ ঘটতে পারে।
বাচ্চার স্মৃতিশক্তি
এতদিনে আপনার বাচ্চা মনে রাখতে শিখেছে, যেমন তার খেলনাপাতি কোথায় থাকে। দু সপ্তাহ আগে দেখা কোন কাজও সে নকল করতে পারে। কিন্তু এখনও সে সব কিছু মনে রাখতে পারবে না। দু থেকে তিন বছরের আগে আপনার বাচ্চার দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি তৈরি না-ও হতে পারে।
বাচ্চার বুলি
আপনার বাচ্চার আধো আধো শব্দগুলো এখন সত্যিকারের কথার মত শোনাতে আরম্ভ করতে পারে। তার আধো আধো বুলিগুলো আপনার কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে, কিন্তু মনোবিদদের মতে সে আসলে আপনার সাথে কথা বলছে, যদিও এই মুহূর্তে আপনি তা বুঝতে পারছেন না।
তোমার বাচ্চা ভাবছে সে কিছু বলছে, কাজেই সেই ভাবেই তার কথায় সাড়া দিন! তার সঙ্গে আপনার কথা বলা আর তার দিকে তাকানো থেকে সে কথাবার্তা আর মুখের ভাবভঙ্গি শিখবে। আপনার বাচ্চা এখনও আপনার কথার চেয়ে স্বরের ওঠানামা থেকেই বেশি বোঝে। সে জানে কখন সে আপনাকে খুশি করেছে, তাই তখন খুব করে প্রশংসা করুন।
বাচ্চার ব্যাক্তিত্ত্ব
আপনার বাচ্চার স্বভাব এখন পুরোপুরি ফুটে উঠতে শুরু করবে। সে হয়তো খুব মিশুকে হতে পারে, যাকে দেখে তার দিকেই তাকিয়ে হাসে অথবা খুব লাজুক, মুখ ঢেকে ফেলে। আপনার বাচ্চা এখন আপনার নজর কাড়তে জানে, আর আপনাকে দরজার দিকে যেতে দেখলে হয়তো হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাতে পারে
শিশুর পেটের সমস্যা হচ্ছে?
যদি আপনার শিশুর পেটের গোলমাল হয় তাহলে তার শরীর থেকে যে তরল বের হয়ে যাচ্ছে সেটার অভাবপূরণ করা দরকার, তা না হলে তার শরীরে পানিশূন্যতা হবে৷ তাকে বার বার বুকের দুধ খেতে দিন এবং যতবার চাইবে ততবার তাকে খাওয়ান৷
যদি বাচ্চার বয়স ৬ মাসের কম হয়, তার পানির প্রয়োজন নেই৷ বুকের দুধ তার সব প্রয়োজন পূরণ করবে৷ তবে তাকে আরো বেশি করে বুকের দুধ খেতে দিন৷ তার হয়ত একবারে খাওয়ার শক্তি থাকেনা, তাই আরো বেশি করে ওকে খাওয়ানো দরকার৷
যদি বাচ্চার বয়স ৬ মাসের বেশি হয়, বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়াও মাঝেমধ্যে তাকে অল্প অল্প করে চুমুক দিয়ে পরিষ্কার, সুরক্ষিত (ফুটিয়ে ঠান্ডা করা) পানি খাইয়ে দিন৷ সম্ভব হলে, তাকে প্রতি ঘন্টায় কয়েক বার চুমুক দিয়ে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস) খাওয়ানোর চেষ্টা করুন৷ ওআরএস এক প্রকারের পাউডার, যা এক লিটার পরিষ্কার, ফুটিয়ে ঠান্ডা করা পানিতে গুলে নিতে হয়৷ আপনি এটা তৈরী করে রেখে দিতে পারেন এবং ৮-১২ ঘন্টার মধ্যে ব্যবহার করে নিতে পারেন৷ প্রত্যেকবার পাতলা পায়খানার পরে আপনার শিশুকে ১৫-২০ চা-চামচ ওআরএস খাইয়ে দিন৷ যদি আপনার শিশু ওআরএস না খেতে চায়, তাহলে আপনি লবন চিনি দিয়ে লেবুর পানি, ডাল বা ভাতের মাড় বা ডাবের পানি দিতে পারেন৷
তাকে চিনি মেশানো ফলের রস, কোলা বা চিনিসহ পানীয় দেবেন না৷ এতে পেটের গোলমাল বেড়ে যেতে পারে৷
যত দ্রুত সম্ভব আপনার শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান যদি:
- ১ দিনের বেশি তার পেটের পাতলা পায়খানা থাকে
- তার ত্বক বা ঠোঁট শুকিয়ে যায়
- তার প্রস্রাবের রং গাঢ় হলুদ দেখায় ও কম ঘন ঘন প্রস্রাব হয়
- কোনো পানীয় খেতে না চায়, পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়ে বা পেট ফুলে যায়
- এক দিনের বেশি সময় ধরে বমি হয়, বা এক দিনের বেশি জ্বর থাকে
শিশুর মাইলস্টোনঃ নবম মাস
- হামাগুড়ি দিবে, নিজে নিজে বসতে শিখবে
- দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে এবং সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতে পারবে।
- কোন জিনিষ হতবদল করতে পারবে।
- হাত থেকে কিছু পড়ে গেলে তা খোঁজার চেষ্টা করবে।
- হাত থেকে খেলনা নিয়ে নিলে প্রতিবাদ জানাবে।
- কোন জিনিষের দিকে নির্দেশ করতে পারবে।
- খেলনা নাগালের বাইরে থাকলে তার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে।
- দু আঙ্গুলের সাহায্যে কিছু তুলতে পারবে।
- ছোট ছোট শব্দ বলার চেস্টা করবে যেমন দাদা, বাবা, মা ।
- নিজের মতামত দিতে চেস্টা করবে- যেমন কি চায় বা কি চায় না ।
- নিজে নিজে খাবার খাওয়ার চেস্টা করবে।
- বড়দের অনুকরণ করতে শিখবে যেমন: মোবাইলে কথা বলা বা চিরুনি দিয়ে মাথা আচঁড়ানো।
- হাত নেড়ে বিদায় জানাতে পারবে।
- নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিতে পারবে বা ফিরে তাকাবে।
- “না” বললে বুঝতে পারবে। যদিও সবসময় তা পালন করবে না।
বিপদচিহ্ন
- জড়সড় বা নিস্তেজ থাকা।
- চলন্ত কিছুর দিকে দৃস্টি না দেয়া।
- মাথার ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারা
- কারও দিকে তাকিয়ে না হাঁসা।
- আকর্ষনীয় কিছু দেখলে আগ্রহী না হওয়া
- কোন ধরনের শব্দ না করা
- দাঁর করিয়ে দিলে পায়ে ভর দিতে না পারা।
- কোন কিছু হাত দিয়ে মুখের কাছে আনতে না পারা
- যিনি সর্বাধিক যত্ন নেন (খাবার খেতে দেন) তার প্রতি কোন আগ্রহ না দেখানো
- কোন শব্দে প্রতিক্রিয়া না দেখানো।
- কোন দিকে গড়াগড়ি দিতে না পারা।
- কোন কিছু মতামত দিতে না পারা যেমন পছন্দ বা অপছন্দ
এ সময় কি কি মাইলস্টোন আপনার শিশু অর্জন করতে যাচ্ছে তা জানার সাথে সাথে ভুলে যাবেন না যে এট শুধু মাত্র একটা গাইডলাইন। প্রতিটি শিশুই ইউনিক ( স্বকীয় ) এবং তার বেড়ে ওঠার গতিও ভিন্ন।যে শিশুটি অন্যদের থেকে প্রথমে বসতে শিখেছে সে হয়ত সবার শেষে হামাগুড়ি দিতে শিখবে। অথবা ১৮ মাস বয়সী যে শিশুটি শব্দ ও অঙ্গাভঙ্গির মাধ্যমে এখনো ভাবের আদান প্রদান করছে সে হটাৎ করেই দুই বছর বয়সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্য বলা শুরু করতে পারে।
এই টাইমলাইন সিরিজ যেন আপনার কোন রকম দুঃশ্চিন্তার কারন না হয় খেয়াল রাখবেন। প্রতিটি টাইমলাইনকে একটি গাইড হিসেবে ধরে নিতে হবে ।নবজাতক এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আশঙ্কা বা জিজ্ঞাসা থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।