স্লীপ ওয়াকিং বা ঘুমের ঘোরে হাঁটা কি?
কম বয়সের বাচ্চাদের জন্য স্লীপ ওয়াকিং বা ঘুমের ঘোরে হাঁটা খুব সাধারণ একটি বিষয় । কৈশোর বয়সে (১৩ বছর বয়স থেকে শুরু) পদার্পণের পর থেকে স্লীপ ওয়াকিং এর সমস্যা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।
সাধারণত, দেখা যায় বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ার এক-দু’ঘন্টার মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য (কয়েক সেকেন্ড থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে) এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাফেরা করছে। ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটছে তেমন কাউকে জাগানো সত্যি ভীষণ কষ্টসাধ্য। জেগে ওঠার পর পর সে কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে থাকে।
স্লীপ ওয়াকিং (somnambulism নামেও পরিচিত) এর সাথে ঘুমে হাঁটার পাশাপাশি আরো কিছু উপসর্গ থাকতে পারে। যেমন:
- ঘুমের ঘোরে উঠে বসে থাকা।
- ঘুমের ঘোরেই হঠাৎ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়া।
- দরজা খুলে বাইরে চলে যাওয়া।
- ঘুমের ঘোরেই কথা বলতে শুরু করা (somniloquy)।
- ঘুমের ঘোরেই হাসাহাসি, কান্নাকাটি কিংবা চেঁচামেচি করা।
- সাময়িক কিংবা দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিভ্রম।
- শিশুদের মধ্যে মারামারি করবার প্রবণতা।
- অধিক গুরুতর ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যেই মলমূত্র ত্যাগ করে দেয়া।
তবে ঘুমের ঘোরে বাচ্চা যায় করুক না কেন, সাধারণত এই সব কাজ তার মনে থাকেনা।
প্রথমদিকে এই ধরনের আচরণকে অভিভাবকেরা খুব গুরুত্বের সাথে না নিলেও পরবর্তীতে ঠিক এই বিষয়গুলোয় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে পারে। তাই, ঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
স্লীপ ওয়াকিং এর কারণ সমূহ কি কি?
গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমে হাঁটা এই ধরনের সমস্যা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের মাঝে বেশি দেখা যায়। পরিবারের অন্য কোন সদস্য বা বাবা-মায়ের যদি স্লীপ ওয়াকিং এর অভ্যাস থাকে তবে শিশু এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বিভিন্ন কারণে এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যেমন:
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
- অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচী
- অসুস্থতা বা জ্বর
- কিছু কিছু ওষুধের কারণে
- স্ট্রেস এর কারণে
- কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত থাকলে।
- উত্তেজনা, ভয়, মানসিক অস্থিরতা থাকলে।
- স্লিপ অ্যাপানিয়া বা ঘুমের সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত কোনো জটিলতা থাকলে।
স্লীপ ওয়াকিং এর সময় ঠিক কি ঘটে?
ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা ছেড়ে উঠে ঘোরাঘুরি করা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। এছাড়াও স্লীপ ওয়াকাররা আরও কিছু কাজ করতে পারে, যেমন-
- ঘুমের ঘোরে কথা বলা
- ঘুম থেকে সহজে জাগাতে না পারা
- বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকা
- নড়বড়ে অবস্থায় থাকা
- কিছু বললে সারা না দেয়া
- বিছানায় উঠে বসা এবং অনবরত কিছু একটা করতে থাকা, যেমন- চোখ কচলানো, নিজের জামা টানতে থাকা ইত্যাদি।
যেসব বাচ্চার সমনামবুলিজমের সমস্যা আছে তারা আর সকলের মতোই ঘুমাতে যায় বিছানায়, ঘুমিয়ে পড়ে ঠিকমতোই। কয়েক ঘন্টার মাঝেই তারা কথা বলা শুরু করে আপন মনে, হয়তো কাঁদে বা চিৎকার করে, উঠে পড়ে ঘুম থেকে। চোখ খুলে তাকায়, কিন্তু চেহারা থাকে ভাবলেশহীন, অভিব্যক্তিহীন। কারণ তারা তো আসলে জেগে নেই, চোখ খোলা ঠিকই কিন্তু তার মস্তিস্ক রয়ে গেছে ঘুমের রাজ্যে। হয়তো ঘরের মাঝে হাঁটছে সে, দরজা খুলে যাইরে চলে যাচ্ছে, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ছে নিজের অগোচরে, পোশাক পরছে বা খুলছে, প্রাত্যহিক অন্যান্য কাজও করছে; সবই সেই ঘুমের মাঝেই।
এমন সময় তাদেরকে সজাগ করতে গেলে হয়তো অনেকে প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত আচরণ করে, চিৎকার করে, ধাতস্থ হতে সময় লাগে তাদের। তবে সকলের মাঝে একটা বিষয়ে মিল থাকে যে, তারা ঘুম ভেঙ্গে আর মনে করতে পারে না ঘুমের মাঝে কী কী করেছে বা বলেছে।
কখনো কখনো ঘুমের ঘোরে হাঁটার সাথে সাথে নীচের উপসর্গগুলো দেখা যেতে পারে-
- স্লীপ অ্যাপ্নিয়া
- বিছানা ভিজিয়ে ফেলা
- নাইট টেরর
স্লিপওয়াকিং কি ক্ষতিকর?
আপাতদৃষ্টিতে ঘুমের ঘোরে হাঁটাকে ক্ষতিকারক হিসেবে গন্য করা হয় না। তবে, স্লীপ ওয়াকিং সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ, যে সব বাচ্চাদের এই সমস্যা রয়েছে তারা দেখা যাচ্ছে নিজের অজান্তেই ঘরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করছে বা দরজা-জানালা খুলে দিচ্ছে যা সত্যি ভীষণ বিপদজনক।
তবে এটা ভাবার কারণ নেই যে স্লীপ ওয়াকারদের মানসিক কোন সমস্যা রয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর রাতে করা এই ধরনের উদ্ভুত আচরণের কিছুই তাদের মনে থাকেনা।
কিভাবে ঘুমের ঘোরে হাঁটা শিশুদের নিরাপদ রাখবেন?
সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া, দরজা খুলে রাস্তায় চলে যাওয়ার মতো বিপদজনক পরিস্থিতিতে থেকে স্লীপ ওয়াকারদের নিরাপদ রাখতে চাইলে তাদের পরিবার কিছু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে।
যেমন:
১। ঘুমের ঘোরে হাঁটার সময় বাচ্চাকে জাগানোর চেষ্টা করবেন না। এতে তারা আতঙ্কিত বোধ করতে পারে। তাকে না জাগিয়ে বরং হাত ধরে আবার তার বিছানায় নিয়ে আসুন।
২। যদি পরিবারের কারো এই সমস্যা থাকে তবে ঘুমানোর আগে দরজা জানালা বন্ধ করে দিবেন। প্রয়োজনে তালা লাগিয়ে চাবি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখতে হবে।
৩। এই রোগাক্রান্ত শিশুকে কখনো বহুতল বিছানায় শুতে দেবেন না। ফলে, বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া থেকে শিশু সুরক্ষিত থাকবে।
৪। ধারালো, সহজে ভেঙ্গে যায় বা বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সরঞ্জামাদি সর্বদা শিশুর কক্ষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন।
৫। শিশুর রুমে বা ঘরে এমন কিছু রাখবেনা না যাতে শিশু হোঁচট খেতে পারে।
৬। শিশুর রুমের বাইরে এবং সিঁড়িতে অতিরিক্ত গেইট লাগাতে পারেন।
কখন চিকিৎসকের শরনাপন্ন হওয়া উচিত?
ঘুমের ঘোরে হাঁটা বা স্লীপ ওয়াকিং এর ক্ষেত্রে সাধারণত তেমন কোন চিকিৎসার প্রয়োজন পরেনা। তবে বাচ্চার মধ্যে নীচের উপসর্গগুলো দেখা গেলে ডাক্তারকে জানানো উচিত-
- খুব ঘন ঘন ঘুমের ঘোরে হাঁটলে
- বাচ্চার যদি সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকে
- যদি স্লীপ ওয়াকিং এর সময় বিপদজনক কোন আচরণ করতে থাকে।
এছাড়াও যদি স্লীপ ওয়াকিং এর কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং বাচ্চার কৈশোরের শুরুর দিকে এই সমস্যা কমে না আসে তবে ডাক্তারকে জানান।
যেসব শিশু প্রায়শই ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটে তাদের ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা “শিডিউল এওয়েক্যানিং” নামে একটি চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মানে, যে সময়ে আপনার সন্তান স্লিপওয়াক করে তার একটু আগে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবেন। কিছুক্ষণ পর আবার বিছানায় শুইয়ে দেবেন। এই পদ্ধতি ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটা বন্ধে বেশ কার্যকরী। খুব কম সময় চিকিৎসকেরা এই রোগের জন্য ঔষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
স্লিপওয়াকিং সম্পর্কে আর কি জানা উচিত?
ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটা প্রতিরোধ করতে:
- ঘুমানোর সময় আপনার বাচ্চাকে তার পছন্দের কোন গান বা গল্প শোনাতে পারেন যা তাকে শান্ত করবে।
- রাতে ঘুমাতে যাওয়ার ও ঘুম থেকে উঠার একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিন।
- রাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার ঘুমের অভ্যাস তৈরি করুন।
- সন্ধ্যার পর থেকে বাচ্চাকে পানি কম খাওয়াবেন এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে যেন অবশ্যই বাথরুম সেরে নেই। ( ব্লাডার পরিপূর্ণ থাকার সাথে স্লীপ ওয়াকিং এর কিছু সম্পর্ক থাকতে পারে। )
- ঘুমানোর কাছাকাছি সময় ক্যাফেইন জাতীয় কিছু বাচ্চাকে খাওয়াবেন না।
- আপনার সন্তানের শোবার ঘরের পরিবেশ শান্ত, ঘুমের জন্য আরামদায়ক কিনা তা নিশিত করুন। বাচ্চার ঘুমের সময় যথাসম্ভব শব্দ যাতে কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
আপনার শিশু বা অন্য কোন সদস্যের স্লীপ ওয়াকিং এর সমস্যা থাকলে আতঙ্কিত না হয়ে চেষ্টা করবেন তাদের সুরক্ষিত রাখতে।
সবার জন্য শুভকামনা।