শিশুর এটেনশন ডেফিসিট হাইপারএক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি)

Spread the love

চারপাশের পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে এবং কি করতে হবে, কতটুকু করতে হবে – এই বিষয়গুলো যখন কোন শিশুর পক্ষে নিজে নিজে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে – এই অবস্থাকে এটেনশন ডেফিসিট হাইপারএক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি) বলা হয়।

শিশুর এডিএইচডি হলে অস্থিরতা বেড়ে যায়, কোন কাজ করার সময় একটানা মনযোগ ধরে রাখা তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ে। একদম শিশু বয়স থেকেই এই ডিজঅর্ডার দেখা যেতে পারে এবং তা কৈশোর এমনকি পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, শিশুর বয়স ৪ বছর হওয়ার আগে এডিএইচডি আছে কিনা তা শনাক্ত করা কঠিন তো বটেই, একপ্রকার অসম্ভবও। কারণ, এই বয়সে একটু চঞ্চল শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অস্থির থাকে এবং এই বয়সে শিশুদের শারিরীক বৃদ্ধির সাথে সাথে মানসিক পরিবর্তনটাও খুব দ্রুত হয়।

তবে বেশ অল্পবয়স থেকেই কিন্তু শিশুর মধ্যে এডিএইচডির উপসর্গগুলো দেখা যেতে পারে, তাই সচেতন অভিভাবকেরা একটু সচেতন হলে, একদম শিশু বয়সেই উপসর্গগুলো ধরতে সক্ষম হবেন।

এডিএইচডি’উপসর্গগুলো কি?

শিশুভেদে এডিএইচডির উপসর্গও একেক রকম হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মূলত তিন ধরণের এডিএইচডি চিহ্নিত করেছেন:

  • ইনএটেনটিভ এডিএইচডি (Inattentive ADHD),
  • হাইপারএক্টিভ- ইমপালসিভ এডিএইচডি (Hyperactive- Impulsive ADHD),
  • এবং কমবাইন্ড এডিএইচডি (Combined ADHD)।

কমবাইন্ড এডিএইচডি হলে শিশুর মধ্যে ইনএটেনটিভ এবং হাইপারএক্টিভ- দুই ধরণের এডিএইচডির উপসর্গই দেখা দিতে পারে।

এডিএইচডি আছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্যে ডাক্তার ছয়মাসের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন অবস্থায় শিশুর মধ্যে নিম্নোক্ত আচরণগুলো লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিনা তা দেখেন। এই আচরণগুলো শিশুর বাসায়, স্কুলে এমনকি সামাজিক পরিস্থিতিতে তার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

ইনএটেনশন বা অমনোযোগীতার লক্ষণ

  • আকাশকুসুম চিন্তা করা, কোন কিছুতে মনযোগ দিতে কষ্ট হওয়া
  • শিশুকে কিছু বললে সেটা শুনতে না পাওয়া অর্থাৎ তাতে পাত্তা না দেওয়া
  • শিশু যখন খেলবে কিংবা কোন কাজ করবে, কিছুক্ষণ পরই ভুলে যাওয়া যে সে কি কাজ করছিলো
  • শিশুকে যেভাবে নির্দেশ করবেন, সে অনুযায়ী কাজ না করা
  • অগোছালো হয়ে থাকা
  • তার প্রিয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো হারিয়ে ফেলা
  • ভুলে যাওয়া
  • মানসিক শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, এমন কাজ করতে আগ্রহী না হওয়া
  • তাকে কোন কিছু বললে কিংবা কোন তথ্য জানালে তা দ্রুত কিংবা ঠিকঠাক বুঝতে না পারা

হাইপারএক্টিভিটি বা অতিক্রিয়তার লক্ষণ

  • সবসময় উসখুস করবে, অস্বাভাবিক লাজুক কিংবা বিব্রতকর দেহভঙ্গি করবে  এবং সবসময় পায়চারি করবে।
  • প্রচুর কথা বলবে
  • চুপচাপ, শান্ত হয়ে খেলতে অসুবিধা হবে
  • পরিস্থিতি না বুঝেই প্রচুর দৌড়াদৌড়ি করবে, কোন কিছু বেয়ে উঠতে চাইবে

ইমপালসিভিটি বা অত্যাধিক আবেগপ্রবণতার লক্ষণ

  • উত্তেজনার বশে উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলা কিংবা তাকে প্রশ্ন করা হলে প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর দিয়ে ফেলা
  • অপেক্ষা করতে না পারা
  • লাইনে দাড়াতে অসুবিধা হওয়া, নিজের সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করতে না পারা
  • চিন্তাভাবনা না করেই কাজ করে ফেলা
  • আবেগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা
  • অন্যের অসুবিধা হয় এমন কাজ করা

আপনার ৪/৫ বছর বয়সী শিশুর মধ্যে আপনি স্বাভাবিকভাবেই উপরোক্ত উপসর্গের কিছু কিছু দেখতে পাবেন। এই বয়সে শিশুরা সবসময়ই কিছুটা উত্তেজিত কিংবা অস্থির থাকতে পারে। কিন্তু শিশুকে ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, অন্য শিশুদের তুলনায় তার অস্থিরতা কিংবা উত্তেজনার মাত্রা যদি মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয়ে থাকে বলে আপনি আশংকা করে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার ডাক্তারের সাথে এ বিষয়ে কথা বলুন।

অন্য কোন সমস্যার কারণে কি শিশুর মধ্যে এই আচরণগুলো দেখা যেতে পারে?

হ্যা। দৃষ্টিশক্তি কিংবা শ্রবণশক্তি জনিত কোন সমস্যার কারণে, শেখার কোন সমস্যার কারণেও শিশুর মধ্যে মনযোগের ঘাটতি দেখা যেতে পারে। আবার আবেগঘন কোন ঘটনা যেমন কারো মৃত্যু কিংবা পরিবারে বিবাহবিচ্ছেদ প্রভৃতির কারণে তা শিশুর মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে এবং মনযোগের ব্যাঘাত ঘটায়।

অথবা এমনও হতে পারে যে, তার দৌড়াদৌড়ি লাফালাফির জন্যে একটু প্রশস্ত যায়গা লাগবে। এখন আপনি যদি শিশুর অবস্থা নিয়ে বেশিই চিন্তিত হয়ে পড়েন, ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।

শিশুর বয়স যদি খুব বেশী না হয়, সেক্ষেত্রে ডাক্তার হয়তো আপনাকে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে বলতে পারেন, আবার ডাক্তার প্রয়োজনবোধ করলে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দিতে পারেন।

এডিএইচডি কতটা প্রচলিত রোগ?

আমেরিকান একাডেমি অফ পিডিয়াট্রিক্স (AAP) এর হিসেব অনুযায়ী, আমেরিকার ৪% থেকে ১২% পর্যন্ত স্কুলপড়ুয়া শিশুরা এই সমস্যায় আক্রান্ত। ৭ বছরের আগেই এই লক্ষণগুলো শিশুর মধ্যে দেখা দেওয়া শুরু করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েদের তুলনায় তিনগুণ বেশী ছেলেদের মধ্যে এই অসুখটা লক্ষ্য করা যায় এবং পরিবারের পূর্বে কারো হলে সেটা পরবর্তী প্রজন্মও বহন করে।

এডিএইচডি কেন হয়?

এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমন একটি ক্ষেত্র, যার অনেক কিছুই অজানা এবং এ বিষয়ে এখনো প্রচুর গবেষণার সুযোগ রয়েছে। গবেষকেরা বলে থাকেন, এডিএইচডি অনেকটা জেনেটিকের কারণেই হয়ে থাকে।

কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কোন মায়ের একজন শিশুর এডিএইচডি হয়, তাহলে অন্যান্য শিশুদের তুলনায় ওই মায়ের পরের সন্তানেরও এডিএইচডি হওয়ার সম্ভাবনা ২০% থেকে ২৫% পর্যন্ত হতে পারে।

অন্য একটি রিসার্চের মতে, এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুদের জিনগত কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়- মস্তিষ্কের যে অংশ ‘মনযোগ’এর কাজ করে, সেখানে পাতলা এক টিস্যু লক্ষ্য করা যায়। তবে যা-ই হোক, ব্রেইন টিস্যুর এই তারতম্য স্থায়ী কিছু নয়, বরং শিশু যখন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে, টিস্যু মোটা হতে থাকে এবং এডিএইচডির লক্ষণসূচক আচরণেও উন্নতি দেখা দেয়।

স্নায়তাত্বিক দিক দিয়েও ব্যাপারটিকে মূল্যায়ন করা যায়। ধারণা করা হয় যে, এডিএইচডি আক্রান্ত মানুষেরা ডোপামিন এবং নেরোপাইনেফ্রিনের মতো মস্তিষ্কের কেমিক্যালের মাত্রা ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণে বংশানুক্রমিকভাবেই কিছুটা অসমর্থ হয়ে থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুদের মস্তিষ্কজুড়ে ভল্যুম প্রায় ৩% থেকে ৪% পর্যন্ত কম হতে পারে। মস্তিষ্কজুড়ে সংযোগকারী হিসেবে হোয়াইট ম্যাটার নামক যে ফাইবার থাকে, এডিএইচডি রোগীদের মধ্যে সেই ফাইবারের পরিমানও কম থাকে।

যদিও গবেষকেরা এখনো নিশ্চিত না যে এই স্নায়বিক পরিবর্তনটির সাথে সরাসরি এডিএইচডির কোন সম্পর্ক আছে কিনা নাকি এটা কেবলই ভিন্ন এক রকম।

একটা সময় পর্যন্ত গবেষকদের ধারণা ছিল যে, মাথায় ছোটখাটো আঘাত কিংবা মস্তিষ্কের ক্ষয়ক্ষতির  কারণেই মনযোগ সংক্রান্ত ব্যাধিগুলো হয়ে থাকে। এমনকি কয়েক বছর আগেও এডিএইচডিকে ‘মিনিমাল ব্রেইন ড্যামেজ’ বা ‘মিনিমাল ব্রেইন ডিসফাংশন’ বলে ডাকা হতো।

কিন্তু সম্প্রতি কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, মস্তিষ্কে বড়সড় আঘাত পেয়ে অনেকের মধ্যেই এডিএইচডির  লক্ষণ দেখা গেলেও আবার যাদের মধ্যে এডিএইচডির লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে, তাদের সাথেও মাথায় বড় কোন আঘাতের ঘটনা ঘটেনি বা মস্তিষ্কের কোন ক্ষতি হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

গবেষণায় উঠে এসেছে, খাবারে কৃত্রিম রঙয়ের ব্যবহার এবং প্রিজারভেটিভের কারণে শিশুর মধ্যে হাইপারএক্টিভিটি বা অতিক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মায়ের ধূমপান এবং এলকোহল সেবনের কারণেও শিশুর সাথে এমনটি হতে পারে।

কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন, সচরাচর এডিএইচডির কারণ হিসেবে যেগুলো বেশী শোনা যায়, যেমন পরিশোধিত চিনি এবং টিকা- এগুলোর সাথে এডিএইচডির কোন সম্পর্কই নেই। মা বাবার সঠিক যত্নের অভাব, পারিবারিক সমস্যা, খারাপ শিক্ষক কিংবা স্কুল এমনকি প্রচুর পরিমাণ টিভি – এর কোনোটার সাথেই এডিএইচডির কোন সম্পর্ক নেই।

তবে হ্যা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এডিএইচডির সমস্যাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করতে পারে এবং এডিএইচডি শিশুর পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার বড় অন্তরায় হিসেবেও দাড়াতে পারে। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা কোনভাবেই এডিএইচডির কারণ হতে পারে না।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কি শিশু এডিএইচডি মুক্ত হয়ে যাবে?

খুব সম্ভবত- না! বড় হয়ে যাওয়া পর্যন্তও অনেক শিশু এডিএইচডির লক্ষণগুলো বয়ে বেড়ায়। যেসব শিশুরা এডিএইচডি চিকিৎসা নেয়, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশুরা টিনএজ বয়সে এসেও ঔষধের উপর নির্ভর করে আবার তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশী শিশু পূর্ণবয়স্ক হয়ে গেলেও এডিএইচডির চিকিৎসা ছাড়তে পারে না।

তবে হ্যা, পূর্ণবয়স্ক হয়ে গেলে এদের মধ্যে অনেকেই এডিএইচডির লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা শিখে যায় ফলে তাদের সার্বিকভাবে উন্নতি সাধিত হয়।

এডিএইচডি নিয়ে নাকি অনেক বিতর্ক রয়েছে?

হ্যা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো বিতর্ক রয়েছেই, কারণ বিশেষজ্ঞরা এখনও এডিএইচডির প্রকৃত কারণটা বের করতে পারেন নি, আবার শিশুর স্বাভাবিক আচরণের সাথে এডিএইচডির উপসর্গগুলোর অনেকটা মিল থাকায় এই রোগ শিশুর মধ্যে আছে কিনা শনাক্ত করাও বেশ কঠিন।

বিজ্ঞাপণ

এডিএইচডির চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। অনেক ডাক্তার, গবেষক, অভিভাবকেরা এডিএইচডির চিকিৎসায় ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষত ৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ঔষধ ব্যাবহারের ক্ষেত্রে বেশ কঠোর অবস্থান নেন। (উল্লেখ্য,  এডিএইচডির চিকিৎসার জন্যে এএপির ব্যবস্থাপনাপত্র কেবল ৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের জন্যে প্রযোজ্য।)

অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই এডিএইচডির চিকিৎসায় ব্যাবহৃত রিটালিন কিংবা এ ধরনের উত্তেজক ঔষধের বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যেমন রাগ বেড়ে যাওয়া, বিরক্তভাব, পেটে ব্যাথা, মাথাব্যথা, খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া, ঘুম কম হওয়া প্রভৃতি।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, শিশুর বৃদ্ধির গতি হ্রাস পাওয়া, ওজন কমে যাওয়া প্রভৃতিও দেখা যায়। আপনার শিশু যদি এডিএইচডির চিকিৎসা নেওয়া শুরু করে, তাহলে সে নিয়মিত ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকবে।

ডাক্তার কিভাবে শিশুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন?

শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে প্রথমে ডাক্তার শিশুকে ভালোমতো চেকআপ করবেন, তার ঔষুধের বিবরণী এবং সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হবেন। এছাড়া ডাক্তার মায়ের গর্ভকালীন সময়ের খুঁটিনাটি, পূর্বে পরিবারের কারো এডিএইচডি ছিল কিনা, এবং শিশু কোন মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গিয়েছে কিনা বা সেরকম কোন ঘটনা তার সাথে ঘটেছে কিনা সেগুলো সম্বন্ধে জানতে চাইবেন। এসব ছাড়াও, শিশুর চোখে দেখা বা কানে শোনার ক্ষমতা ঠিকঠাক আছে কিনা, তা জানতে কিছু টেস্টও করাতে পারেন।

আপনার ডাক্তার হয়তো আপনাকে কোন ভালো মনোবিদ কিংবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে বলতে পারেন যিনি শিশুর মানসিক ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং কথা শোনার ক্ষমতা কেমন- তা জানার জন্যে বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে বলবেন৷

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারটি হয়তো আপনাকে কিংবা আপনার শিশুর পরিচারিকাকে বিভিন্ন প্রশ্ন সম্বলিত একটি ফর্ম পূরণ করতে দিতে পারেন, যেখানে “দিনে শিশু কতক্ষণ অস্থির থাকে?”- এইরকম প্রশ্ন থাকবে এবং উত্তরের যায়গায় ‘কখনোই না’ থেকে ‘সবসময়ই’ পর্যন্ত অপশন দেওয়া থাকবে। শিশুর অবস্থা বুঝে আপনি অথবা আপনার পরিচারিকা উত্তরে টিক চিহ্ন দেবেন।

এছাড়াও আপনার শিশুর মধ্যে এডিএইচডির কি কি উপসর্গ আছে তা বের করতে ডাক্তার বিভিন্ন পন্থার অবলম্বন করতে পারেন৷ ডাক্তার হয়তো আপনার পরিচারিকা থেকে একটি চিঠি চাইতে পারেন যেখানে আপনার পরিচারিকা ‘শিশু সারাদিন কেমন ব্যাবহার করে’ সে সম্পর্কিত খুটিনাটি ডাক্তারকে লিখে জানাবেন – কারণ অতি দুরন্ত, দুষ্টু শিশুটিও ডাক্তারের গাছে গিয়ে বেশ শান্ত ও পরিপাটি রূপ ধারণ করতে পারে। আপনার ডাক্তার, মনোবিদ দুজন মিলেই আপনার শিশুর সঠিক মানসিক অবস্থা নিরূপণ করতে সক্ষম হবেন।

এডিএইচডির চিকিৎসা কি?

এডিএইচডির চিকিৎসা তিন প্রকারের হয়ে থাকে: ফ্যামিলি থেরাপি, বিহেভিয়ারেল থেরাপি, মেডিকেশন। অধিকাংশ মেডিকেল এক্সপার্টদের মতে, শিশুর এডিএইচডির চিকিৎসার জন্যে ফ্যামিলি এবং বিহেভিয়ারেল থেরাপিই যথেষ্ট।

ফ্যামিলি থেরাপি: শিশুর এডিএইচডি মোকাবেলায় অন্যতম সেরা উপায় হলো ফ্যামিলি থেরাপি, যাকে পেরেন্টস ট্রেইনিংও ডাকা হয়ে থাকে। এই থেরাপির মাধ্যমে শিশুর অভিভাবকদের নিম্নোক্ত ব্যাপারগুলো শেখানো হয়:

  • শিশুর ব্যাবহারের কারণে অভিভাবকদের মধ্যে জন্ম নেওয়া হতাশাগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়,
  • কিভাবে ধারাবাহিক এবং ইতিবাচকভাবে শিশুর যত্নআত্তি করতে হবে,
  • কিভাবে নিজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মেলবন্ধন ঘটানো সম্ভব।

বিহেভিয়ারেল থেরাপি: এই থেরাপির মাধ্যমে শেখানো হয়:

  • কিভাবে স্কুলে এবং বাসায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, যাতে শিশু অযথা উত্তেজিত না হয়ে যায় কিংবা মনযোগ না হারায়
  • কিভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ মোকাবেলায় বিভিন্ন স্ট্রাটেজি ব্যাবহার করতে হয় এবং তাতে সফল হলে পরবর্তীতে তা চালু রাখা যায়।

মেডিকেশন : ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্যে এডিএইচডির ঔষধ ব্যবহার না করারই পরামর্শ দেয় ঔষধ প্রস্ততকারকেরা। তবে নতুন গবেষনায় উঠে এসেছে, শিশুর বয়স ৪ বছর হলেও, এডিএইচডির ঔষধ বেশ ভালো কাজ করে।

মিথাইলফেনিডেট (রিটালিন) এবং ডেক্সট্রোএম্ফেটামিন (ডেক্সেড্রিন) ধরণের উত্তেজক ঔষধই ডাক্তারেরা প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকেন। গবেষকেরা বিশ্বাস করেন যে, এই ঔষধগুলো মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের লেভেল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ঔষধগুলো স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি তিন প্রকারেরই হয়ে থাকে।

এডিএইচডি চিকিৎসা বিজ্ঞানের মোটামুটি নতুন একটি বিষয় কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়া কাভারেজের কারণে এই ডিজঅর্ডার মানুষের মুখে মুখে বেশ প্রচলিত। এডিএইচডি নিয়ন্ত্রণ কিংবা দূর করার উপায় বের করতে গবেষকেরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন, আর তাইতো অনেকেই অনেক থিওরি দিচ্ছেন, নিত্যনতুন তথ্য জানাচ্ছেন- আবার সেগুলো মিডিয়ার কল্যাণে দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছেও যাচ্ছে।

এর ফলে হয়তো আপনি আপনার পরিবারের সদস্য কিংবা বন্ধুবান্ধবদের থেকে নতুন নতুন অনেক উপদেশই পাবেন যে এটা করা উচিত, এটা করা উচিত না। এসবে রাগান্বিত, বিভ্রান্ত কিংবা বিচলিত হবেন না। আপনার শিশুর ভালোর জন্যে কেবল আপনার ডাক্তার এবং থেরাপিস্টের সাথেই কথা বলুন, নিয়মিত আলাপ আলোচনা করুন কিভাবে শিশুকে সুস্থ করে তোলা যায়।

শিশুর ভালোর জন্যে আমি বাসায় কি কি করতে পারি?

প্রথমে আপনার যে কাজটা করা সবচেয়ে জরুরি, তা হলো – আপনার শিশু যে আচরণ সংক্রান্ত ডিজঅর্ডারে ভুগছে তা মেনে নেওয়া। মেনে নিন এবং তার প্রতি আপনার প্রত্যাশার মাত্রাটা যেন তার সক্ষমতা অনুযায়ীই হয়ে থাকে সেটা নিশ্চিত হোন।

এডিএইচডি হওয়া অনেক শিশুই বেশ মেধাবী এবং সৃজনশীল হতে পারে – ঠিকঠাক বেড়ে উঠলে সে হয়তো বিখ্যাত বিজ্ঞানী কিংবা চলচ্চিত্র পরিচালকও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা নির্ভর করে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্যে তাকে কেমন পরিবেশ উপহার দিচ্ছেন সেটার উপর। শিশুর অনুকূলের পরিবেশটা শুরু হতে পারে এভাবে:

সবাইকে জানান: আপনার ডাক্তার যদি আপনাকে নিশ্চিত করে যে, আপনার শিশুর এডিএইচডি রয়েছে, তাহলে সেটা প্রথমে পরিবারের সবাইকে জানান, অন্ততপক্ষে যাদের সাথে শিশু সারাদিন বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটায়। তার কাছের বন্ধুদের, স্কুলের শিক্ষক, ট্রেইনার অর্থাৎ শিশুর দৈনন্দিন জীবনের অংশ যারা এবং যারা শিশুকে সহায়তা করতে পারবে এমন।

লোকে শুনলে খারাপ বলতে পারে, এটা ভেবে অনেক এডিএইচডি আক্রান্ত মা-বাবাই কাওকে শিশুর ডিজঅর্ডার সম্বন্ধে জানাতে চান না। কিন্তু আপনার শিশুর অস্বাভাবিক আচরণগুলো যে একটা অসুখ এবং এর একটি নাম আছে, এই ব্যাপারটা আপনাকে কিছুটা হলেও রিল্যাক্স করবে।

আপনার শিশুর শিক্ষক কিংবা ট্রেনাররা যখন এটা জানবে যে, শিশুর ক্লাসরুম কিংবা খেলার মাঠে যে কোন সমস্যায় আপনি নিবিড়ভাবে পাশে আছেন, তখন তারাও শিশুকে সহায়তা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

বিজ্ঞাপণ

শিশুর ব্যাপারে সবাইকে জানানো এবং সচেতন করে দেওয়ার মাধ্যমে শিশুর জন্যে যে সহায়তার নেটওয়ার্ক আপনি তৈরি করে ফেলবেন, তা শিশুকে সামনের দিনগুলোতে কিংবা বছরগুলোতেও চাহিদা মাফিক সহায়তা পেতে সাহায্য করবে।

আশপাশের পরিস্থিতি অনুকূলে আনুন: অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে যাবে কিংবা মনযোগ হারিয়ে ফেলবে এমন জিনিসপত্র শিশু থেকে দূরে রাখুন। শিশুর রুম পরিপাটি, গোছানো রাখুন৷ অতিরিক্ত খেলনা কিংবা বইগুলো লুকিয়ে রাখুন যাতে সেগুলো শিশুর দৃষ্টিগোচর না হয়।

শিশু ডে কেয়ারে থাকলে, ডে কেয়ারের শিক্ষককে বলে দিন যাতে তিনি আপনার শিশুকে চোখে চোখে রাখেন এবং শিশুর মনযোগে ব্যাঘাত ঘটায় এমন শিশু কিংবা খেলনা থেকে তাকে দূরে রাখেন।

ডেইলি রুটিন করে ফেলুন: ৪-৬ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে রুটিন বেশ ভালো কাজ করে এবং এটা বেশ জরুরিও বটে। কিন্তু এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে ডেইলি রুটিন জরুরির চেয়েও বেশী কিছু।

এতে করে একটু পর কি হতে যাচ্ছে, সে অনিশ্চয়তায় নিয়ে শিশুর যে টেনশান, তা হওয়ার আর অবকাশ থাকে না। নাহ, ডেইলি রুটিন নিয়ে একদম পুরোপুরি কঠোর হওয়ার প্রয়োজন নেই – কিন্তু শিশু কখন খাবে, কখন গোসল করবে, কখন ঘুমাবে প্রভৃতি জানে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে নিন।

শাস্তির পরিবর্তে পুরষ্কৃত করুন: আপনি নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন যে এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুর সাথে কঠোর হয়ে কিংবা শাস্তি দিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু আপনি এটা জেনে অবাক হবেন যে ছোট ছোট প্রশংসা যে শিশুর উপর কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে! শিশু কোন ভালো ব্যবহার করলে সাথে সাথে তার প্রশংসা করুন। যেমন – “আমি যেভাবে বেলেছি ঠিক সেভাবেই তুমি নিজে নিজে ব্রাশ করে ফেলেছো, বাবা? বাহ! থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

শিশু পছন্দ করবে এমন ছোট ছোট জিনিস  পুরষ্কার হিসেবে তাকে দেওয়ার জন্যে রেখে দিন। হতে পারে সেটা সোনালী তারকা, মজার রাবার স্ট্যাম্প কিংবা রাতে শোয়ার সময় একটা নতুন গল্প।এডিএইচডি আক্রান্ত শিশু কিন্তু অপেক্ষা করা একদমই পছন্দ করে না, তাই তাকে পুরস্কৃত করার সময় এমন পুরষ্কারই দেওয়া উচিত যা সে তাৎক্ষণিক উপভোগ করতে পারে।

এই দৃশ্যমান আদর শিশুকে একধরনের ভালোলাগা দেবে এবং সে আদরটা বারবার পেতে ভালো ব্যাবহারগুলো চলমান রাখার চেষ্টা করবে। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় সে ভালো ব্যাবহারের ফলে ভালোলাগা ব্যাপারটা বুঝতে পারবে, তখন আর এমন পুরষ্কারের কোন প্রয়োজন হবে না।

সবার জন্য শুভকামনা।

বিজ্ঞাপণ

Spread the love

Related posts

Leave a Comment