গর্ভবতী না হয়েও প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হওয়ার কারণ কি?

Spread the love

মাথা ঘোরা আর বমি বমি লাগা মানেই আমাদের দেশে প্রেগন্যান্ট বা গর্ভবতী হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়।তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গর্ভবতী না হয়েও টেস্ট পজিটিভ আসতে পারে।প্রেগনেন্সি পরীক্ষায় ভুল ফল আসার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে। তবে তা নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে দেখে নেওয়া যাক, এই পরীক্ষায় ঠিক করা হয়।

প্রেগন্যান্সি বা গর্ভবতী কিনা তা কিভাবে নির্ণয় করা হয়

বাসায় গর্ভধারন পরীক্ষায় আপনার প্রস্রাবে গর্ভধারন হরমোনের উপস্থিতি আছে কি না। ডিম্বানু নিষিক্ত হবার ৬ দিন পর গর্ভবতী মায়ের শরীরে বিশেষ একধরনের হরমোনের নিঃসরণ ঘটে, এর নাম এইচ.সি.জি (human chorionic gonadotropin)। মূত্রে এই হরমোনের উপস্থিতি পরীক্ষার মাধ্যমে মা গর্ভবতী কিনা তা নির্ণয় করা হয়।

বিজ্ঞাপণ

ডিম্বাণু শুক্রাশয়ের সাথে মিলিত হয়ে একটি কোষ গঠন করে। এই কোষ বার বার বিভাজিত হয়ে ভ্রুন বা ইমব্রায়ো গঠন করে। ভ্রুনের কোষগুলোর কিছু কোষ মিলে শিশুর অমরা বা প্লাসেন্টা গঠন করে। এই প্লাসেন্টা হরমোনের সৃষ্টি করে যার উপস্থিতি প্রস্রাবে ধরা পড়ে। এই হরমোন আপনার মাসিক বন্ধে ভুমিকা রাখে।

কেউ যদি গর্ভবতী হয়ে পড়ে, গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক সপ্তাহে রক্তে এইচ.সি.জি (human chorionic gonadotropin) হরমোনের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়।যদি পিরিওড বন্ধ নিশ্চিত হওয়ার আগে আপনি পরীক্ষা করেন তবে প্রস্রাবে এইচ.সি.জি হরমোনের উপস্থিতি নাও থাকতে পারে।

গর্ভধারণের ১১ দিন পর থেকে রক্তপরীক্ষায় এবং ১২ থেকে ১৪ দিন পর থেকে মূত্র পরীক্ষায় এই হরমোনের উপস্থিতি ধরা পড়ে। ৮ থেকে ১১ সপ্তাহ ধরে ৭২ ঘন্টা অন্তর, হরমোনের এই মাত্রা দ্বিগুণ হতে থাকে। তার পর থেকে অবশ্য এই মাত্রা স্থির হয় এবং প্রসবের পরে কমে যায়।

বাড়ির পরীক্ষা মূত্রের ওপরে করা হয়। যদি এইচ সি জি থেকে থাকে তাহলে ব্যবহৃত প্রেগনেন্সি কিটে ঘটে যাওয়া রাসায়নিক বিক্রিয়ার সঙ্কেত (কোম্পানি ভেদে আলাদ) দেখে যে কেউ অনুমান করে নিতে পারেন তিনি গর্ভবতী কিনা।

গর্ভবতী না হয়েও প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হওয়ার কারন কি ?

যদিও প্রস্তুতকারি অধিকাংশ কোম্পানির দাবি তাদের কিট ৯৯% নিখুঁত, তবুও কখনও কখনও অন্য কয়েকটি কারণে ফলাফলে ভুল আসতে পারে।

নির্ধারিত নির্দেশ না মানা হলে– পরীক্ষা করার সময় যে নির্ধারিত নির্দেশ প্রেগনেন্সি কিটে দেওয়া থাকে তা মানা দরকার। বিশেষ করে সময়ের দিকটা খেয়াল রাখতে হবে। সঙ্কেত বোঝার ক্ষেত্রে যাতে ভুল না হয়, সেদিকেও নজর রাখা দরকার।

এক্সপাইরি ডেট পেরিয়ে গেলে– যদি কিটের এক্সপাইরি ডেট পেরিয়ে গিয়ে থাকে তাহলেও ভুল ফল আসতে পারে কারণ সেক্ষেত্রে এইচ সি জি হরমোন নির্ধারক রাসায়নিকটি ঠিক মতো কাজ করতে পারে না।

ফার্টিলিটি মেডিসিন– অনেক সময় উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য এইচ সি জি হরমোন যুক্ত ফাটিলিটি মেডিসিন দেওয়া হয়। যেমন, ইন-ভিট্রো-ফার্টিলাইজনের অংশ হিসেবে ইঞ্জেকশন। এই জাতীয় ওষুধ নেওয়ার পরে প্রেগনেন্সি পরীক্ষা করালে ভুল ফল আসার সম্ভাবনা থাকে।

বিজ্ঞাপণ

শুরুতেই গর্ভপাত– এমনও হতে পারে, পজিটিভ প্রেগনেন্সি পরীক্ষার কিছুদিন পরেই কারও পিরিয়ড শুরু হয়ে গেল। তাতে এমন মনে হতে পারে যে, পরীক্ষায় ভুল ফল এসেছিল। ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নাও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চার হওয়ার পরে একেবারে শুরুতেই গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার কারণে আপাতদৃষ্টিতে এমন মনে হয়।

এমনও হয়, বহু ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চার হওয়া সত্বেও কিছু বোঝার আগেই বহু মহিলার গর্ভপাত ঘটে যায়। এদের কেমিক্যাল প্রেগনেন্সি বলে। সাধারণত নিষিক্ত ডিম্বানুতে ক্রোমোজোমঘটিত বিশৃঙ্খলার কারণে এমন ঘটে। মোট গর্ভপাতের ৫০-৭৫% কেমিক্যাল প্রেগনেন্সিজনিত। এই ধরনের প্রেগনেন্সিতে প্রত্যাশিত পিরিয়ডের আগে পরে ব্লিডিং হয় বলে প্রেগনেন্সি টেস্টে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা তৈরি হয়।

এইচ সি জি শরীরে রয়ে গেলে – প্রসব অথবা গর্ভপাতের পরে মোটামুটি এক মাস সময় ধরে শরীরে এইচ সি জি-র অস্তিত্ব থেকে যায়। আমেরিকান প্রেগনেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের মতে কোনও মহিলার গর্ভপাতের পরে এইচ সি জি মাত্রা স্বাভাবিক হতে ৪-৬ সপ্তাহ লেগে যায়। এর কারণ কিছু প্লাসেন্টা তখনও শরীরে থেকে গিয়ে এইচ সি জি উত্পাদন করে চলে। এই সময় প্রেগনেন্সি পরীক্ষায় ভুল ফল আসতে পারে।

এক্টোপিক প্রেগনেন্সি হলে– অনেক সময় ইউটেরাস বা জরায়ুর বাইরে নিষিক্ত ডিম্বানু বড় হতে থাকে। একে এক্টোপিক প্রেগনেন্সি বলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফ্যালোপিয়ান টিউবে হলেও ওভারি বা সার্ভিক্স অঞ্চলেও এক্টোপিক প্রেগনেন্সি ঘটে।

এই প্রেগনেন্সি শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণতা পায় না কারণ, জরায়ুর বাইরে থাকায় ভ্রূণের ঠিক মতো পুষ্টি ও বৃদ্ধি হয় না। অথচ এই সময়েও কিন্তু এইচ সি জি উত্পাদন চলতে থাকে, যা প্রেগনেন্সি পরীক্ষায় ভুল ফলাফল দেখায়। এই ধরনের গর্ভসঞ্চার থেকে জীবনসংশয়ের ঝুঁকি থাকে।

শারীরিক অসুস্থতা

  • মেয়েদের কিছু জার্ম সেল টিউমার (Germ cell Tumor) হতে পারে। যেমন: ডিজজার্মিনোমা (Dysgerminoma)। এটা ওভারির একটা টিউমারের নাম। এই রোগে অস্বাভাবিকভাবে HCG হরমোন নিঃসৃত হয়। তখন প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলে পজিটিভ হবে। কারন এ সময় HCG লেভেল বেশি থাকে।
  • বিভিন্ন ট্রফোব্লাস্টিক টিউমার (Trophoblastic Tumor) যেমন: হাইডাটিডফর্ম মোল (Hydatiform Mole), কোরিওকারসিনোমা (Choriocarcinoma) ইত্যাদিতেও একই ঘটনা ঘটে। শরীরে টিউমারের কারনে এ সময় প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলে ফলাফল পজিটিভ আসবে। মনে হবে প্রেগন্যান্ট ।
  • শরীরের যেখানে ইনসুলিন তৈরী হয় সেখানেও কিছু টিউমার হতে পারে যা HCG নিঃসরণ করে। এক্ষেত্রেও টেস্ট পজিটিভ হতে পারে।
  • বমি বন্ধ হওয়ার জন্য বাজারে বিভিন্ন নামে প্রোমিথাজিন (Promethazine) ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এগুলো খেলেও প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হতে পারে । দেখা গেলো এমন হলো যে, কেউ বাসে চড়লে বমি হয় বলে বমির ওষুধ খেয়েছে, বমি ভাব বা Motion Sickness বন্ধ হওয়ার জন্য। বাস থেকে নেমে আবার একটু মাথা ঘুরালো আর বমি বমি লাগলো। সন্দেহ করে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করালো। এক্ষেত্রেও মিথ্যামিথ্যি পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে।

এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি শারীরিক সমস্যায় এইচ সি জি মাত্রা বেড়ে গিয়ে প্রেগনিন্সে পরীক্ষায় ভুল ফল দেখাতে পারে। যেমন,

  • পিটুইটারি গ্ল্যান্ড ও হরমোন মাত্রার বিশৃঙ্খলা। বিশেষ করে, মেনোপজ পূর্ববর্তী বা মেনোপজ হয়ে যাওয়ার পরে
  • জেস্টেশনাল ট্রোফোব্লাস্টিক রোগ, যাতে সেই সব কোষগুলিতে টিউমার হয়, যারা সাধারণত প্ল্যাসেন্টা তৈরিতে অংশ নেয়
  • ওভারি, ব্লাডার, কিডনি, লিভার, লাঙ, কোলন, ব্রেস্ট ও স্টমাকে ক্যান্সার হলে
  • ফ্যান্টম এইচ সি জি, যাতে কিছু অ্যান্টিবডি টেস্টিং কিটের সঙ্গে ক্রিয়া করে
  • ওভারিয়ান সিস্ট
  • কিডনি রোগ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন

তাই প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হলেই গর্ভবতী হয়েছে এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। উপরের বিষয়গুলো মাথায় রেখেই বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত।

গর্ভবতী না হয়েও প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ হওয়ার কারণ কি? | Audio Article 

Spread the love

Related posts

Leave a Comment