গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথা বা ব্যাক পেইনের সমস্যায় কম বেশী সব মহিলায় ভোগেন। গর্ভাবস্থার যে কোন সময় এ উপসর্গ দেখা দিতে পারে তবে শেষের দিকে যখন গর্ভের শিশু বড় হতে থাকে তখন এ ব্যাথা বেশী দেখা যায়। গবেষনার তথ্য অনুযায়ী শতকরা ৫০-৭০ ভাগ মহিলাই গর্ভাবস্থায় ব্যাক পেইনে ভোগেন।
গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথা বা ব্যাক পেইন কেন হয়?
গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যথা হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। কিছু কিছু মায়েরা গর্ভধারণের শুরু থেকেই এতে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে যেসব মায়েদের ওজন বেশী থাকে বা গর্ভধারণের আগে থেকেই যাদের ব্যাক পেইনের সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় এর ঝুঁকি বেশী থাকে।
নীচে গর্ভাবস্থায় ব্যাক পেইনের কিছু সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা হোল
হরমোনের বৃদ্ধিঃ
গর্ভাবস্থায় অন্য অনেক সমস্যার মত ব্যাক পেইনের কারণ হিসেবেও হরমোনকে দায়ী করা যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় হরমোনের নিঃসরণের কারণে সন্তান জন্মদানের প্রস্তুতি হিসেবে পেলভিক এরিয়ার লিগামেন্টগুলো নরম হয়ে যায় এবং জয়েন্টগুলো ঢিলে হয়ে যায়। এর ফলে মায়ের শরীর অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং হাঁটার সময়, অনেক বসে থাকলে, চেয়ার থেকে ওঠার সময়, বা কোন কিছু তোলার সময় ব্যাথা অনুভূত হয়।
শরীরের ভর-কেন্দ্রের পরিবর্তনঃ
গর্ভাবস্থায় জরায়ু বড় হওয়ার সাথে সাথে মায়ের শরীরের ভর-কেন্দ্রও পরিবর্তিত হয় এবং পেটের পেশীগুলো সম্প্রসারিত ও দুর্বল হয়ে যায়। এর ফলে মায়ের Posutre আক্রান্ত হয় এবং পিঠের উপর অতিরিক্ত চাপ পরে।
এ ছাড়াও যেহেতু মায়ের শরীর এ সময় অতিরিক্ত ওজন বহন করে তাই এ সময় মায়ের শরীরের পেশী এবং জয়েন্টগুলোর উপর চাপ বেশী থাকে। এই কারণে গর্ভাবস্থায় ব্যাক পেইন বা পিঠ ব্যাথা দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও গর্ভাবস্থার শেষের দিকে বাচ্চার অবস্থানের উপর নির্ভর করে মায়ের স্নায়ুর উপর চাপ পড়তে পারে যার কারনেও ব্যাক পেইন দেখা দিতে পারে।
ব্যাক পেইনের ধরন
সাধারণত দুধরনের ব্যাক পেইন দেখা যায়-
- লাম্বার বা লোয়ার ব্যাক পেইন
- পোস্টেরিয়র পেলভিক পেইন
সঙ্গত কারনেই এ দু ধরনের ব্যাক পেইন এবং প্রসব যন্ত্রণার মধ্যে পার্থক্য জেনে রাখা উচিত। কারণ প্রসব যন্ত্রণাও পেছন থেকেই শুরু হয়।
লাম্বার বা লোয়ার ব্যাক পেইন
এ ধরনের ব্যাথা সাধারণত কোমর বা কোমরের উপরে পিঠের মাঝ বরাবর হয়। এ ব্যাথা কখনো কখনো পায়ের দিকে ছরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এ ধরনের ব্যাথাকে বলে sciatica। গর্ভাবস্থায় লাম্বার বা লোয়ার ব্যাক পেইন সাধারণত আমরা যে ব্যাক পেইনে আক্রান্ত হয় অনেকটা সেতার মতোই।
কিছু কিছু কারণে এ ব্যাথা বেড়ে যেতে পারে, যেমন- একটানা অনেকক্ষন বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে বা ভারী কিছু আল্গালে। রাতের দিকে এ ধরনের ব্যাথা বেশী অনুভুত হয়।
পোস্টেরিয়র পেলভিক পেইন
পোস্টেরিয়র পেলভিক পেইন সাধারণত পেলভিসের পেছন দিকে অনুভুত হয়। এ ধরনের ব্যাথায় গর্ভাবস্থায় সবচাইতে কমন। এ ধরনের ব্যাথা কোমরের নীচে, নিতম্বের এক বা উভয় পাশে হতে পারে। এ ছাড়াও উরুর পেছন দিকেও তা অনুভুত হতে পারে।
কিছু কিছু কাজে এ ব্যাথা বেড়ে যেতে পারে। যেমন- হাঁটার সময়, সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময়, নিচু চেয়ার থেকে ওঠার সময় ইত্যাদি। সামনের দিকে ঝুঁকে চেয়ারে বসে থাকলে পেলভিক পেইনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পিঠের ব্যথা থেকে স্বস্তি পেতে কি করা যেতে পারে?
গর্ভবতী মহিলাদের কোন না কোন সময় গর্ভাবস্থার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ব্যাক পেইন এর মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু, কিছু উপায় রয়েছে যা আপনাকে ও আপনার সন্তানকে কোন কষ্ট না দিয়ে ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করবে।
ব্যায়াম
ব্যাক পেইন হলে আমরা সাধারণত বিছানায় শুয়ে থাকি তবে খুব বেশী সময় শুয়ে থাকা উচিত নয়। শুয়ে থাকলে ব্যাক পেইনের তেমন কোন উপশম হয়না বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আরও বেড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শরীরচর্চা বা ব্যায়াম খুবই উপকারী।
তবে মনে রাখতে হবে গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করার আগে অবশ্যয় ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিতে হবে কারণ আপনার এমন কোন কন্ডিশন থাকতে পারে যার জন্য কিছু কিছু ব্যায়াম বা ব্যায়াম করা পুরোপুরি আপনার জন্য নিষিদ্ধ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ব্যাক পেইন বা পিঠ ব্যাথা দূর করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল ব্যায়াম। নিজের পেশীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি শরীরের সর্বস্তরের সুস্থতা খুব সহজেই শিশুকে বহন করার শক্তি যোগায়। তখন ওজন বৃদ্ধির পরও আপনি খুব সহজেই এবং আরামে শিশুকে বহন করতে পারবেন।
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যায়াম হল হাঁটা, সাতার কাটা এবং ধীরে সাইকেল চালানো। আপনি আপনার ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে আপনার জন্য যে ব্যায়ামটি ভাল হয়, সে ব্যায়ামটি করা শুরু করুন।
গর্ভাবস্থায় স্ট্রেচিং ব্যায়াম করলে ব্যাক পেইন থেকে স্বস্তি মিলতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে এ ধরনের ব্যায়াম করার সময় তা দ্রুত করা না হয় বা স্ট্রেচিং বেশী করা না হয়। এর ফলে হিতে বিপরিত হতে পারে। ব্যায়ামের সময় সব সময় নিজের শরীরের কথা শোনার চেষ্টা করুন। যখনি মনে হবে অসুবিধা হচ্ছে বা ব্যাথা হচ্ছে তখন ব্যায়াম বন্ধ করুন।
রিলাক্সেশন
রিলাক্সেশনের টেকনিকগুলো জেনে নিন। প্রফেশনাল কাউকে দিয়ে মাসাজ করাতে পারেন। মাসাজের ফলে কিছুটা আরামাবোধ করতে পারেন। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে হালকা মাসাজ ঘুমে সহায়তা করতে পারে।
যদি প্রফেশনাল কাউকে পাওয়া না যায় তবে আপনি আপনার সঙ্গীর সহায়তা নিতে পারেন। আপনার মাথা, ঘাড়, গলা, পিঠ, হাত এবং পায়ে আলতো মাসাজ এ সময় অনেক কাজে দিতে পারে।
ঠাণ্ডা বা গরম
আপনার ব্যথার স্থানে গরম ও ঠাণ্ডা সেঁকা দিতে পারেন। এতে আপনি কিছু সময়ের জন্য ব্যথা থেকে পরিত্রাণ পাবেন। তবে অবশ্যই আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। প্রথমে দুই-তিনদিন আপনার ব্যথাযুক্ত স্থানে ২০ মিনিট করে ঠাণ্ডা কম্প্রেস প্রদান করুন। এরপরে, আবার কয়েকদিন একই স্থানে গরম কম্প্রেস প্রদান করুন। কিন্তু, খেয়াল রাখবেন, গর্ভাবস্থায় কখনও পেটে ঠাণ্ডা বা গরম কম্প্রেস করবেন না।
Posture ঠিক রাখার চেষ্টা করুন
গর্ভবতী অবস্থায় মেরুদণ্ডের উপর বেশি চাপ পড়ে এবং অতিরিক্ত ওজন বহন করতে হয়। তাই, আপনি যখন বসে বসে কাজ করবেন, তখন সাথে একটি ছোট তোয়ালে বহন করুন এবং তা আপনার ব্যথার স্থানে লাগিয়ে রাখুন। যতক্ষণ বসে থাকবেন, সোজা হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করুন। এতে আপনার ভাল Posture বজায় থাকবে, যা আপনার মেরুদণ্ডের ব্যথা উপশম করতে কাজে দিবে।
সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন। গর্ভবতী মায়েরা সাধারণত ঝুঁকে থাকেন। এতে মেরুদণ্ডের উপর আরও চাপ পড়ে। যদি সোজা হয়ে দাঁড়ানোটা এসময় একটু কঠিন হবে তারপরও চেষ্টা করুন যাতে দাঁড়ানোর সময় ঘাড় যাতে পেছনের দিকে থাকে। বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে না থাকার চেষ্টা করুন। দাঁড়িয়ে থাকতে হলে কিছুক্ষন পর পর বসে বিশ্রাম নিন।
যদি পোস্টেরিয়র পেলভিক পেইন থাকে তবে বেশী সিঁড়ি বাইবেন না। এছাড়াও এমন সব ব্যায়াম থেকে বিরত থাকুন যেগুলোতে কোমর বা মেরুদণ্ড বেশী বাঁকাতে হয়।
সঠিক জুতা ব্যাবহার করুন
ফ্যাশনের জন্য মেয়েরা অনেকসময় উঁচু হিল ব্যবহার করেন আবার অনেকে সমতল জুতা ব্যবহার করেন। দুটোই ক্ষতিকর অভ্যাস, যার কারণে ব্যাক পেইন হয় কারণ দুইক্ষেত্রেই দেহের ওজন সমতা রাখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। তাই অপেক্ষাকৃত নিচু হিল পরে চলাফেরা করা ভালো। নিজের হাঁটার ছন্দের সঙ্গে মিলে যায় – এমন জুতা ব্যবহারই ভালো তবে সামান্য হিল হলে ভালো।
ভারী জিনিস আলগানো থেকে বিরত থাকুনঃ
গর্ভাবস্থায় ভারী জিনিস আলগানো উচিত নয়। যদি নিচ থেকে কোন জিনিস তুলতে হয় তবে ঝুঁকে না তুলে আগে হাঁটু ভেঙ্গে বসে তারপর তুলুন। বাজারের ব্যাগ বা কিছু বহন করতে হলে দু হাতে সমান ভর নেয়ার চেষ্টা করুন। একটি ব্যাগে সব জিনিশ না নিয়ে দুটি ব্যাগে সমান ওজন নিয়ে বহন করুন। এক হাতে ওজন বেশী নিলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা কষ্টকর হয় এবং তাতে মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে।
ঘুম
আপনি কিভাবে ঘুমাচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে আপনার মেরুডণ্ডের উপর চাপ পড়তে পারে এবং ব্যাক পেইন হতে পারে। গর্ভাবস্থায় বাম পাশ ফিরে শোওয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার মেরুদণ্ডের উপর চাপ যেমন কমবে তেমনি শরীরে রক্তপ্রবাহ বাঁধা গ্রস্থ হবেনা। এছাড়াও ঘুমানোর সময় দুপায়ের মাঝখানে বালিশ ব্যাবহার করতে পারেন যাতে উপরের পায়ের ভর বালিশের উপর পড়ে। পেটের নীচে বালিশ ব্যাবহার করতে পারেন বা পিঠের দিকে বালিশ দিয়ে সাপোর্ট দিতে পারেন।
কখন ব্যাক পেইন বিপদজনক এবং ডাক্তার দেখান জরুরিঃ
যদি গর্ভাবস্থায় পিঠে ব্যাথা একটানা দু সপ্তাহ চলতে থাকে তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। নিম্নলিখিত কারণ গুলো থাকলেও ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- যদি অনেক বেশী ব্যাথা থাকে এবং তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে বা ব্যাথা যদি কোন আঘাতের কারণে হয়।
- ব্যাক পেইনের সাথে যদি জ্বর থাকে বা যোনিপথে রক্ত যায় বা প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া করে।
- যদি দুর্বল বা ভারসাম্যহীন লাগে বা এক বা দু পায়ে অনভুতিহীন লাগে।
প্রসব শুরু লক্ষন গুলো জেনে নিন যাতে গর্ভাবস্থার শেষের দিকে ব্যাথা হলে বুঝতে পারেন তা প্রসব নাকি ব্যাক পেইন।
সবার জন্য শুভকামনা।