গর্ভকালীন সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় আর তাই এই সময়ে নারীদের একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এই সতর্কতা শুধুমাত্র কাজের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় বরং খাবারের ব্যাপারেও মানতে হয় বিভিন্ন রকমের বিধি নিষেধ।
বেশ কিছু খাবার আছে যেগুলো গর্ভকালীন সময়ে বেশি করে খেতে হয় আবার কিছু খাদ্য থেকে এই সময়টাতে নিরাপদ দুরুত্ব বজায় রাখতে হয়। আর পেঁপে হল ঠিক এমনই একটি ফল যেটা পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হলেও গর্ভকালীন সময়ে এই ফলটি খাওয়া কতটুকু নিরাপদ সে বিষয়ে অনেকেই জানেন না।
গর্ভাবস্থায় পেঁপে খাওয়া কি নিরাপদ?
গর্ভাবস্থায় পাকা পেঁপে খাওয়া নিরাপদ। তবে আধা পাকা এবং কাঁচা পেঁপে গর্ভবতী নারীদের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কেননা কাঁচা পেঁপেতে ল্যাটেক্স এর পরিমাণ অনেক বেশি এবং এর ফলে জরায়ু সংকোচিত হয়ে যায়। তাই ডাক্তাররা গর্ভকালীন সময়ে কাঁচা পেঁপে খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করে থাকেন, কেননা এর ফলে গর্ভবতী নারীদের উপর বেশ ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পেঁপে পাকলে খাওয়া যাবে। কেননা পাকার সময় পেঁপেতে লেটেক্সের পরিমাণ কমে যায়। তবে সেটিও গাছপাকা হতে হবে। বর্তমানে বেশির ভাগ সময় পেঁপে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকানো হয়। এসব পাকা পেঁপেও ক্ষতিকর। কারণ এগুলো যেহেতু প্রাকৃতিক নিয়মে পাকে না তাই তাতে লেটেক্স রয়ে যেতে পারে।
অনেকেই বলেন গর্ভাবস্থায় তিনি কাঁচা পেঁপে খেয়েছেন কিন্তু সমস্যা হয়নি। এমনটা হতেই পারে। কাঁচা পেঁপে খেলে সমস্যা হবেই তা নয়। কিন্তু এর ফলে ঝুঁকি রয়ে যায়। তাই গর্ভের সন্তানের কথা চিন্তা করে এ ঝুঁকি না নেয়াই উচিত। তাই গর্ভাবস্থায় সবধরনের পেঁপে খাওয়া থেকেই বিরত থাকুন এমনকি রান্না করেও না।
আর তাই গর্ভকালীন সময়ে কি খাবেন আর কি খাবেন না এই ব্যাপারে আপনাকে বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস এবং শেষ তিন মাস একটু অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে, কেননা ডাক্তারদের মতে প্রথম তিন মাস বেশ সংকটপূর্ণ সময়।
পেঁপেতে থাকা লেটেক্স কেন ক্ষতিকর?
পেঁপেতে থাকা ল্যাটেক্স নামক এই সাদা দুধের মত দেখতে তরলটি পাপাইন, এনডোপেপটিডাস এবং সাইমোপাপাইন দিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। আর এই উপাদানগুলো গর্ভবতী নারীদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়,
- পাপাইন নামক এই উপাদানটি জরায়ুর সংকোচনের কারণ হতে পারে এবং যার ফলে গর্ভপাত হওয়ার তীব্র সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এই উপাদানটি প্রোজেস্টেরন নামক এক ধরণের হরমোন নিঃসরণ করা কমিয়ে দেয়, কিন্তু এই হরমোনটি সুস্থ ও স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার জন্য খুবই জরুরী।
- এছাড়া ল্যাটেক্স কিছুটা অক্সোটসিন এবং প্রোস্টাগ্লাডিনের মত কাজ করে থাকে। উল্লেখ্য যে এই দুই ধরণের হরমোনের কারণেই আদতে প্রসব শুরু হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ল্যাটেক্সের কারণেও প্রসব শুরু হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি কখনো কখনো প্রসব ত্বরান্বিত করার জন্য ডাক্তাররা গর্ভাবস্থার শেষ দিকে কাঁচা পেঁপে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
- ল্যাটেক্স নামক এই পদার্থটি কাঁচা এবং আধকাঁচা পেঁপে ও পেঁপের পাতার মধ্যে পাওয়া যায়। আর তাই গর্ভকালীন সময়ে কাঁচা পেঁপে এবং আধকাঁচা পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- তবে মজার তথ্য হল পেঁপে যত পাকতে থাকে ততই এর মধ্য থেকে ল্যাটেক্স নামক এই পদার্থটি কমে যেতে থাকে। আর একদম পেকে যাওয়া পেঁপের মধ্যে ল্যাটেক্স পাওয়াই যায় না। আর তাই এই পাকা পেঁপে আপনি চাইলেই খেতে পারেন, কোন সমস্যা নেই।
আসুন জেনে নেই পাকা পেঁপের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে
পাকা পেঁপে পুষ্টিগুণে ভরপুর, এর মধ্যে নিম্ন বর্ণীত উপাদানগুলো থাকে:
- বেটা ক্যারোটেন
- পটাশিয়াম
- ভিটামিন
- আয়রন
- ক্যালোরি
- ফলিক এসিড
যদিও পাকা পেঁপে গর্ভাবস্থার জন্য বেশ ভালো, তবে বেশ কিছু সময়ে আপনার পাকা পেঁপে খাওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে।
গর্ভকালীন সময়ে কখন সবধরনের পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে?
আপনার যদি নিম্ন বর্ণীত অবস্থা থাকে তাহলে ডাক্তার সাধারণত গর্ভকালীন সময়ে পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলে থাকেনঃ
- আপনার যদি ল্যাটেক্সে এলার্জি থাকে
- আপনি যদি অনুর্বরতা জনিত কোন ধরণের চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন এবং দীর্ঘ সময় পর গর্ভধারণ করেন।
- ইতোপূর্বে যদি আপনার গর্ভপাত, এবরশন, নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সন্তান জন্ম গ্রহণ অথবা এই ধরণের গুরুতর কোন অবস্থায় পড়ে থাকেন।
গর্ভকালীন সময়ে কাঁচা পেঁপে খাওয়ার প্রভাব
ডাক্তাররা নিম্নবর্তী কারনে গর্ভকালীন সময়ে কাঁচা এবং আধকাঁচা পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলে থাকেনঃ
ফিটাস অর্থাৎ গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে
টেরাটজেনিক জাতীয় উপাদান গর্ভের শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির উপর ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করে। আর পেঁপের মধ্যে সাইমোপাপাইন এবং পাপাইন নামক দুই ধরণের টেরাটজেনিক জাতীয় উপাদান পাওয়া যায়।
কাঁচা পেঁপের কারনে ইডেমা হতে পারে
গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত কাঁচা পেঁপে খাওয়ার কারনে ইডেমা অর্থাৎ শরীরে পানি আসতে পারে। এটি রক্তনালীগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়াটিকে ধীর করে দেয়। অতিরিক্ত চাপের ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং ভ্রূণের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা
ভিটামিন সি এর একটি সমৃদ্ধ উৎস হল কাঁচা পেঁপে। তবে কাঁচা পেঁপে অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে কিডনিতে পাথর তৈরি হতে পারে। আর এই ধরণের সমস্যার কারনে পাকস্থলীতে ক্র্যাম্প হতে পারে, যা কি না মা এবং গর্ভের শিশু উভয়ের জন্যই বেশ ক্ষতিকারক।
ভ্রূণের চারপাশের আবরণ দুর্বল করে দিতে পারে
পেঁপের মধ্যে থাকা পাপাইন নামক উপাদানটি ভ্রূণের চারপাশের আবরণকে অনেকাংশেই দুর্বল করে দিতে পারে। ফলাফল স্বরূপ ভ্রূণের চারপাশে নতুন কোষ ও টিস্যু তৈরি হতে বাঁধা পায়। এমন অবস্থা যে গর্ভের শিশুর জন্য বেশ ক্ষতিকারক সে কথা আর বলাই বাহুল্য!
তলপেটে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়
কাঁচা অথবা আধকাঁচা পেঁপের মধ্যে থাকার ল্যাটেক্স নামক উপাদানটির কারনে জরায়ু সংকোচন হওয়া শুরু হয়। এর কারনে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনাও তীব্র। এছাড়াও পেঁপের আঁশ জাতীয় পদার্থ অন্ত্র ও তলপেটে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ইস্ট্রোজেন উৎপাদন করে
আমরা জানি কাঁচা পেঁপে পিরিয়ড নিয়মিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়। কারণ তা শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে এস্ট্রোজেন হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই হরমোনের ভারসাম্যহীনতা থাকে তাই পেঁপে খেলে যে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেন ও তাপ উৎপন্ন হয়ে তাতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
জেনে নিন পেঁপে জনিত বেশ কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও তার সমাধানঃ
১। রান্না করা পেঁপে কি গর্ভকালীন সময়ে নিরাপদ?
যতক্ষণ পর্যন্ত পেঁপে পুরোপুরি না পেকে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি সেটা এমনি অথবা রান্না করেও খেতে পারবেন না। তবে পাকা পেঁপের ক্ষেত্রে তেমন কোন বাঁধা নেই।
২। গর্ভকালীন সময়ে কি পেঁপে জুস খাওয়া যাবে?
পেঁপের জুসের ক্ষেত্রেও পরামর্শ ঠিক একই রকম। কাঁচা অথবা আধকাঁচা পেঁপের জুস থেকে বিরত থাকুন। তবে পুরোপুরি পাকা পেঁপের জুস খেলে কোন সমস্যা হবে না।
৩। গর্ভকালীন সময়ে পেঁপে দিয়ে তৈরি মিল্কশেক খেলে সমস্যা হবে?
আপনি যদি পাকা পেঁপে দিয়ে তৈরি মিল্কশেক পান করেন তাহলে কোন সমস্যাই হবে না। তবে এক্ষেত্রেও আপনাকে কাঁচা অথবা আধা কাঁচা পেঁপে থেকে দূরে থাকতে হবে।
পাকা পেঁপে বেশ স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি ফল যা কি না গর্ভবতী নারীদের জন্য বেশ উপকারী। অপরদিকে কাঁচা অথবা আধকাঁচা পেঁপে গর্ভবতী নারীদের শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর। তবে কাঁচা অথবা পাকা যে ধরণেরই পেঁপে হোক না কেন, সেটা খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে আলাপ করে নিন।
সবার জন্য শুভকামনা।