গর্ভাবস্থায় মায়ের এবং গর্ভস্থ শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য গর্ভধারণের শুরু থেকেই নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে প্রতি মাসে একবার ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেয়া হয়। দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার বেশীরভাগ মায়েদের জন্যই মোটামুটি আরামের সময়। এ সময় গর্ভপাতের সম্ভাবনা কমে যায় এবং অনেক ধরনের গর্ভকালীন সমস্যা কম থাকে যেমন- বমি বমি ভাব, মর্নিং সিকনেস ইত্যাদি।
তাই অনেকের কাছেই এ ট্রাইমেস্টার গর্ভকালীন সময়ে সবচাইতে প্রিয় সময়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের এবং গর্ভের শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ ট্রাইমেস্টারে মাসে অন্তত একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে প্রত্যেকটি সাক্ষাতে ডাক্তার কিছু বেসিক শারীরিক পরীক্ষা করবেন যেমন-
জরায়ুর বা পেটে আকার- ডাক্তার এ ট্রাইমেস্টারের প্রতিটি সাক্ষাতে আপনার জরায়ুর উচ্চতা মাপবেন যা fundal height নামেও পরিচিত। এটি সাধারানত মাপা হয় আপনার পেলভিক বোনের উপর থেকে জরায়ুর উপর পর্যন্ত উচ্চতা নিয়ে।
Fundal height আপনার গর্ভধারণের সময়ের সাথে সম্পর্কিত। যেমন ২০ সপ্তাহে সাধারণত Fundal height ২০ সেমি এর মত বা এর চাইতে ২ সেমি কম বেশী থাকে। ৩০ সপ্তাহে থাকতে পারে ৩০ সেমি বা এর চাইতে ২ সেমি কম বেশী।

যদিও এ পরিমাপটি নিখুঁত নয়। কারণ মোটা মায়েদের ক্ষেত্রে, গর্ভে যমজ সন্তান থাকলে বা এমনিওটিক ফ্লুইড বেশী থাকলে এ পরিমাপ ভিন্ন হতে পারে।
এ পরিমাপটি করা হয় ভ্রুনের বৃদ্ধির দিকে নজর রাখার জন্য। যদি Fundal height প্রত্যাশিতভাবে না বাড়ে বা এর বৃদ্ধির হার যদি কম বা বেশী হয় তবে ডাক্তার আপনাকে আল্ট্রাসাউন্ড করার পরামর্শ দিবেন যাতে ভ্রুনের এবং এমনিওটিক ফ্লুইড এর অবস্থা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়।
ভ্রুনের হৃদস্পন্দন- ডাক্তার এ সময় ডপলার আল্ট্রাসাউন্ডের মাদ্ধমে গর্ভের শিশুর হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এ পদ্ধতিতে সাধারণত শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করা হয় যা আপনার এবং শিশুর জন্য নিরাপদ।
এডেমা- এ সময় ডাক্তার আপনার পা, পায়ের গোড়ালি চেক করে দেখবেন তাতে কোন ফোলা আছে কিনা। পা ফুলে যাওয়া গর্ভাবস্থায় একটি সাধারণ ব্যাপার যা তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু তা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যাওয়া প্রি-এক্লাম্পশিয়া ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষন হতে পারে।
ওজন- প্রতিটি সাক্ষাতে ডাক্তার আপনার ওজন মেপে দেখবেন আপনার ওজন কি পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনার কতটুকু ওজন বাড়া দরকার তা নির্ভর করে গর্ভধারণের আগে আপনার ওজন কত ছিল এবং আপনার জারায়ুতে ভ্রুনের সংখ্যার উপর। আপনার ওজন প্রয়জনের তুলনায় কম বা বেশী থাকলে ডাক্তার আপনার খাবার দাবারের ব্যাপারে আপনাকে পরামর্শ দিবেন।
ব্লাড প্রেসার- গর্ভাবস্থায় সাধারণত ব্লাড প্রেসার কমে যায়। ২৪-২৬ সপ্তাহে ব্লাড প্রেসার সবচাইতে কম থাকে। কিছু কিছু মায়েদের দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে ব্লাড প্রেসার অনেক কম থাকতে পারে যেমন ৮০/৪০। আপনি যদি সুস্থ বোধ করেন তাহলে এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
কিন্তু গর্ভাবস্থায় ব্লাড প্রেসার বেশী থাকে ভয়ের কারণ হতে পারে। যদি তা বেশী থাকে বা বাড়তে থাকে তাহলে আপনার ডাক্তার গর্ভকালীন উচ্চরক্তচাপ বা প্রি-এক্লাম্পশিয়ার লক্ষন আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবেন। অনেক মাই উচ্চ রক্তচাপ থাকা সত্ত্বেও সুস্থ বাচ্চা প্রসব করেন। কিন্তু কেউ কেউ এতে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন বা সময়ের আগের বাচ্চা প্রসবের প্রয়োজন হতে পারে।
ইউরিন টেস্ট- ইউরিনে গ্লুকোজ ও প্রোটিনের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য ইউরিন টেস্ট করা হতে পারে। ইউরিনে প্রোটিনের মাত্রা বেশী থাকা প্রি-এক্লাম্পশিয়ার লক্ষন এবং গ্লুকোজের মাত্রা বেশী থাকে ডায়াবেটিসের লক্ষন। এ দুটোই গর্ভাবস্থায় ভয়ের কারণ।
এছাড়াও আপনার যদি প্রস্রাবে জালাপোড়া থাকে তাহলে ইউরিনে ব্যাক্টেরিয়া আছে কিনা তা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া হবে।
আরও অন্যান্য যেসব পরীক্ষা করা হতে পারে-
আলট্রাসাউন্ড
আলট্রাসাউন্ড গর্ভাবস্থায় আপনার এবং গর্ভের শিশুর সার্বিক অবস্থা জানার জন্য এখন অত্যাবশ্যকীয়। অনেক মায়েরা প্রথম ট্রাইমেস্টারে আলট্রাসাউন্ড করেন গরভধারনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। আবার অনেকেই দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে প্রথমবারের মত আল্ট্রাসাউন্ড করেন।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের আল্ট্রাসাউন্ডে ডিউ ডেট সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। ১৩-২৭ সপ্তাহের মধ্যে করা আল্ট্রাসাউন্ডে ভ্রুনের গঠন, প্লাসেন্টা এবং এমনিওটিক ফ্লুইডের ব্যাপারে ধারনা পাওয়া যায়।
কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে সব ধরনের সমস্যা নির্ণয় করা যায় না। যেমন- hydrocephalus আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে দেখা যেতে পারে কিন্তু হৃদপিণ্ডে শুক্ষ কোন ত্রুটি থাকলে তা আল্ট্রাসাউন্ডের ধরা না ও পড়তে পারে।
জেনেটিক রোগ নির্ণয়
যে কোনো গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় টেস্ট হলো জেনেটিক বা ক্রোমোজোমাল স্টাডি। সাধারণত অনাগত শিশু সুস্থ হবে কিনা, কোন বংশগত রোগ, প্রাণসংহারী রোগ, নিরাময় অযোগ্য রোগ যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এগুলো নির্ণয়ের জন্য জেনেটিক স্টাডি এবং ক্রোমোজোমাল স্টাডি করানো গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণত গর্ভের শিশুর নাড়ি ফুল থেকে রক্ত নিয়ে, এমনিওটিক ফ্লুয়িড নিয়ে এ ধরনের জেনেটিক বা ক্রোমোজোমাল টেস্ট করা হয়ে থাকে। এ জন্য বিশেষায়িত রোগ নির্ণয় কেন্দ্র বা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে এ পদার্থ বের করে আনা হয়। এ টেস্ট ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
জেনেটিক স্টাডি করে বিকলাঙ্গ শিশু, মাথার মধ্যে পানি জমে বড় হওয়া, অন্যান্য জন্মগত ত্রুটি যেমন- স্পাইনাবাইফিডা, মাইলোসিল, স্ফিংগোমাইলোসিল ইত্যাদি রোগ নির্ণয় করা যায়। হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস এর মাধ্যমে প্রাণঘাতি রোগ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করা সম্ভব।
প্রত্যেকটি সাক্ষাতের পর আপনার ডাক্তার আপনার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারনা দিবেন এবং ভয়ের কিছু থাকলে সে সম্পর্কে জানাবেন। তিনি আপনাকে এর পর আপনার আর কি কি পরিবর্তন ঘটতে পারে সে সম্পর্কেও ধারনা দিবেন এবং কি কি লক্ষন দেখা দিলে দ্রুত ব্যাবস্থা নিতে হবে তা জানিয়ে রাখবেন।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার এর শেষের দিকের সাক্ষাতে তিনি আপনাকে গর্ভের বাচ্চার নড়াচড়ার প্রতি খেয়াল রাখতে বলবেন এবং অসময়ে প্রসব যন্ত্রণা, প্রি-এক্লাম্পশিয়া ইত্যাদির লক্ষন সম্পর্কে অবহিত করবেন।
গর্ভকালীন সময়ে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডাক্তার এ সময় আপনার বিষণ্ণতার কোন লক্ষন আছে কিনা সেটাও খুঁটিয়ে দেখতে পারেন। তবে তিনি যদি এ ব্যাপারে জানতে না চান এবং আপনার মনে হয় যে আপনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন তবে অবশ্যয় তা ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন। এ বিষয়ে তিনি আপনাকে সাহায্য করতে পারেন বা এমন কাউকে রেফার করতে পারেন যে আপনাকে সাহায্য করবে।
এ সময় তিনি আপনাকে গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম, ভ্রমন এবং শারীরিক মিলন সম্পর্কে পরামর্শ দিবেন। এছাড়াও যদি ফ্লু সিজন হয় তাহলে আপনাকে ফ্লু এর প্রতিষেধক নেয়ার পরামর্শ দেয়া হবে।
সবার জন্য শুভকামনা।
[…] গর্ভাবস্থায় চেকআপ । দ্বিতীয় ট্রাইমেস… […]
[…] গর্ভাবস্থায় চেকআপ । দ্বিতীয় ট্রাইমেস… […]