টিকা আপনার শিশুকে পোলিও, হাম এবং হুপিং কাশির মত মারাত্মক রোগসমূহ থেকে নিরাপদ রাখে। কিন্তু অন্যান্য ঔষধের মত মাঝে মাঝে টিকারও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এসব প্রতিক্রিয়া খুবই সাধারণ এবং ক্ষতিবিহীন হয়ে থাকে।
আর কোন প্রতিক্রিয়াটি স্বাভাবিক এবং কোনটি নয় এটা জানা থাকলে আপনার শিশুর পরের রাউন্ডের টিকাটি দেয়ার পর আপনি নিশ্চিত থাকতে পারবেন।
টিকার স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমূহ
টিকা গুলো যেসব রোগ থেকে আপনার শিশুকে সুরক্ষা প্রদান করবে সেটার কিছু অংশ ব্যবহার করেই টিকা তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু এরা নিজেরা রোগের কারণ হিসেবে কাজ করে না।
এরা আপনার শিশুর শরীরকে শুধুমাত্র ঐসব রোগ মোকাবেলা করতে এন্টিবডি নামক রক্তের প্রোটিন তৈরি করতে বলে। উদাহরণস্বরূপ, হুপিং কাশির টিকা নেয়ার পর, যদি আপনার শিশু আসল রোগটির সংস্পর্শে আসে, তাহলে তার শরীর এটা নিজে থেকেই চিহ্নিত করতে পারবে এবং প্রতিহত করার সঠিক হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হবে।
টিকা গ্রহণের পর মৃদু প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝা যায় যে টিকা কাজ করছে। অন্যভাবে বললে, এসব উপসর্গকে আমরা একধরণের চিহ্ন হিসেবে দেখি যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে শিশুর শরীর নতুন এন্টিবডি তৈরি করছে। আর স্বভাবতই এই ধরণের প্রতিক্রিয়াগুলো কিছুদিনের মধ্যে আপনা আপনিই চলে যায়। খুবই সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- টিকা যেখানে দেয়া হয়েছে সেখানে ব্যথা বা লাল হয়ে যাওয়া
- হালকা ফুলে যাওয়া
- মেজাজ খিটখিটে হওয়া
- হালকা জ্বর আসা
- ঘুমাতে সমস্যা হওয়া
ডিটিপি এবং নিউমোনিয়ার টিকাগুলো মাঝে মাঝে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারে, যেমনঃ
- এক হাত বা পা পুরো ফুলে যাওয়া
কম পরিলক্ষিত হয় এমন প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
- বমি
- ঘুম ঘুম ভাব
- ক্ষুধামন্দা
এগুলো হল স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যা কোন ধরণের চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যাবে।
কীভাবে শিশুর টিকার ব্যথা বা অস্বস্তি কমাবেন
টিকার জায়গায় ব্যথা, ফুলে যাওয়া বা লাল হয়ে থাকলে
আদর করুন: শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে থাকলে কম কাঁদে। তাই টিকা দেয়ার পর শিশুকে কাছে রাখুন, জড়িয়ে ধরে রাখুন। তাকে একটু বেশি আদর করুন। এমন কিছু করুন, যাতে সে খুশি থাকে। এতে সে সামান্য হলেও ব্যাথা ভুলে থাকবে।
ঘনঘন খাওয়ান: টিকা দেয়ার শিশুকে ঘন ঘন খাওয়ান। এতে সে ব্যথা কিছুটা ভুলে থাকবে। বিশেষ করে বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুরা এ সময় একটু বেশি সময় খেতে চাইতে পারে। এতে বাচ্চা হাইড্রেটেদ ও থাকবে।
হাত পা নাড়াচাড়া করুনঃ শিশুর যে হাত বা পায়ে টিকা দেয়া হয়েছে সেটা নাড়াচাড়া করুন।
বেশি সময় কাটান: বাচ্চাকে একটু বেশি সময় দিন।তার সাথে খেলা করুন। এতে বাচ্চার ব্যথার অনুভূতি অনেকটাই কমে যাবে।
প্যারাসিটামল ড্রপ: এখন অনেক চিকিৎসকই টিকার ব্যথা কমাতে শিশুদের তরল প্যারাসিটামল দেন। এটাও খুব কাজের। কিন্তু এই জাতীয় ওষুধ দেওয়ার আগে কতবার এবং কতটুকু খাওয়াবেন সে সম্পর্কে চিকিৎসকের সঙ্গে ভালো করে কথা বলে নিন।
এছাড়াও ব্যথা কমানোর জন্য শিশুর ব্যাথার জায়গায় একটা ভেজা কাপড় জড়িয়ে রাখতে পারেন। এতে ব্যথা অনেকটুকু কমে যাবে।
জ্বর আসলে
টিকা দেয়ার পর অল্প জ্বর আসতে পারে। এসময় বাচ্চাকে বেশী জামাকাপড় পরিয়ে রাখবেন না। এতে ওরা অস্বস্তি বোধ করবে। হালকা গরম পানি দিয়ে শিশুর শরীর মুছে দিবেন ও একটু বেশি পানি বা তরল খাবার খাওয়াবেন। নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে ঘন ঘন বুকের দুধ বা ফর্মুলা খাওয়াবেন।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাচ্চাকে প্যারাসিটামল খাওয়াতে পারেন। মনে রাখবেন এ সব ওষুধ বাচ্চার ওজন ও বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণে খাওয়াতে হয়। তাই ডাক্তারের সাথে কথা না বলে ওষুধ খাওয়াবেন না।
শিশুদের কখনো এস্পিরিন ওষুধ খাওয়াবেন না। এতে রেয়েস সিনড্রোম নামক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
শিশুদের টিকা দেয়ার পরে হালকা একটু জ্বর হবে এটা খুব স্বাভাবিক – এ নিয়ে ঘাবড়িয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই!
কোন কারণে জ্বর না আসলে টীকায় কোন কাজ হয়নি এমনটা মনে করারও কোন কারণ নেই, বরং এ ক্ষেত্রে বুঝতে হবে শিশুটি শারীরিক ভাবে খুবই সুস্থ এবং টিকার প্রতিষেধক ক্ষমতাটি তার দেহে সঠিকভাবে স্থাপিত হয়েছে!
মনে রাখতে হবে যে টিকা দেবার দুদিন পর যদি কোন শিশুর জ্বর আসে তাহলে এটা টিকা জনিত কোন জ্বর নয়! তবে শুধু মাত্র BCG (বিসিজি) টিকা দেয়ার পরে টিকার স্থানটি লাল হয়ে পেঁকে পুঁজ বেড় না হলে বুঝতে হবে টিকাটি কোন কারণে অকার্যকর হয়েছে – এমন অবস্থায় পুনরায় বিসিজি টিকা দিতে হবে!
কখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন
আপনার শিশুর যদি কোন টিকার প্রতি অ্যালার্জি থাকে, তাহলে আপনি সেরকম লক্ষণ দেখতে পাবেন। সাধারণত, এসব প্রতিক্রিয়া টিকা গ্রহণের কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যায়।
তাই নিয়মানুযায়ী অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে কিনা সেটা খেয়াল রাখুন, যেমন, শিশুর মুড বা ব্যবহারে পরিবর্তন, তীব্র জ্বর, অথবা দুর্বলতা। শিশুদের মাঝে এরকম জটিল প্রতিক্রিয়াসমূহ প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। ১০ লক্ষ শিশুর মধ্যে একটি শিশুর হতে পারে। তারপরও, এটা জানা জরুরী যে কোন কোন উপসর্গ দেখা দিলে আপনার শিশুকে নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
যেসব উপসর্গগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবেঃ
- হাঁপানির মত শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা
- কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন/ ভারী হয়ে যাওয়া
- ত্বকে লাল লাল অ্যালার্জি জাতীয় প্রদাহ
- শরীরের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- দুর্বলতা
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
- মাথা ঘুরানো
- চেহারা বা গলা ফুলে যাওয়া
- ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি জ্বর আসা
- খিঁচুনি
চিন্তার কারণ হতে পারে এমন আরেকটা লক্ষণ হল যদি আপনার শিশু ৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কান্না করতে থাকে।
আর খুবই দুর্লভ ঘটনার মধ্যে রয়েছে, টিকা গ্রহণের পর শিশুর কোমায় চলে যাওয়া, দীর্ঘ সময়ের জন্য খিঁচুনি বা স্থায়ীভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়া। এগুলো হল ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিক্রিয়া। আসলে, ডাক্তাররাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন যে এসব বা অন্যান্য জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো টিকার জন্য হচ্ছে নাকি অন্য কোন কারণে।
যদি আপনার শিশুকে টিকা দেয়ার পর কোন গম্ভীর উপসর্গ দেখতে পান যা আপনাকে উদ্বিগ্ন করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান।
সবার জন্য শুভকামনা।