গর্ভাবস্থায় টিটেনাস টক্সয়েড বা টিটি টিকা

Spread the love

সন্তান জন্মদানের আগ থেকেই বাবা মায়ের নানা ধরণের পরিকল্পনার শেষ থাকে না। কাপড়, দোলনা,  খেলনা নানাবিধ জিনিস সাজাতে শুরু করেন তারা।  কিন্তু অনাগত সন্তানের রোগ প্রতিরোধের জন্য তারা সেভাবে চিন্তা করেন কি? গর্ভাবস্থায় টিটি টিকা এমনই একটি সুরক্ষা অস্ত্র যা আপনার অনাগত শিশুকে রক্ষা করবে ধনুষ্টংকারের হাত থেকে। 

গর্ভাবস্থায় টিটেনাস টক্সয়েড বা টিটি টিকা

টিটি টিকা কি ?

টিটেনাস টক্সয়েড নামক একটি ভ্যাক্সিনকে সংক্ষেপে টিটি টিকা বলা হয়।  এই টিকা মানুষকে টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগের সংক্রমন থেকে রক্ষা করে। নবজাতকের ধনুষ্টংকার রোগ হওয়াটা মারাত্মক ফলাফল বয়ে আনতে পারে।  সারা পৃথিবীজুড়ে এই সমস্যা দূর করার স্বার্থে গর্ভবতী মায়েদের টিটি টিকা দেয়া হয়।

বিজ্ঞাপণ

টিটেনাস বা ধনুষ্টংকারের জীবাণুর নাম ক্লসট্রিডিয়াম টিটানি।  যেকোন ক্ষতের মাধ্যমে এই জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে।  রক্তে প্রবেশের পর এটি শরীরে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ তৈরী করে যাকে টক্সিন বলা হয়। এই টক্সিন বা বিষ স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ ঘটিয়ে মারাত্মক স্পাজম বা খিচুনি তৈরী করে।  অনেকসময় রোগীর মৃত্যুও ঘটে।

টিটি টিকা বা টিটেনাস টক্সয়েড গ্রহণ করার ফলে মানবদেহে এই জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরী হয়। সংক্রমণের পূর্বেই তৈরী হওয়া  এই এন্টিবডি টিটেনাসের জীবাণু শরীরে ঢোকামাত্রই তাকে  প্রতিহত করে।  ফলে রোগী বেচে যায় মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে।

টিটি টিকা বাহুর উপরের অংশে ডেলটয়েড মাসলে দেয়া হয়। প্রতি ডোজের পরিমাণ ০.৫ মি.লি.। 

গর্ভাবস্থায় টিটি টিকা কেন দেয়া হয়?

টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগের হাত থেকে মা ও শিশুকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই ভ্যাক্সিন সারা বিশ্বে প্রচলিত।  এই ভ্যাক্সিন মানবদেহে এক ধরণের এন্টিবডি তৈরী করে যা ধনুষ্টংকারের জীবাণুকে শরীরের ক্ষতি করা থেকে প্রতিরোধ করে।  

নবজাতকের টিটেনাস হওয়ার অন্যতম কারণ হল প্রসবের সময় পুরনো বা জীবানুযুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করা। প্রয়োজনীয় অ্যান্টিসেপটিক বা জীবনুমুক্তকরণ প্রক্রিয়ার অভ্যাস এখনো সবখানে ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে যেকোন সময় যন্ত্রপাতির দ্বারা নবজাতকে ক্ষত তৈরী করে জীবাণুর সংক্রমন ঘটতে পারে।

পুরাতন ব্লেড বা চাকু দিয়ে শিশুর নাড়ি কাটার ফলে এ রোগে মা ও শিশু উভয়েই আক্রান্ত হতে পারেন।  নবজাতকের দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা এই জীবাণুকে ঠেকাতে পারেনা।  কিন্তু মা যদি আগে থেকেই টিটি টিকা গ্রহণ করে থাকেন,  তবে তার শরীরে তৈরী হওয়া এন্টিবডি নবজাতকের দেহেও পৌছে যায়। যা টিটেনাসের সংক্রমণ থেকে মা ও নবজাতককে সুরক্ষিত রাখে।

গর্ভাবস্থায় টিটেনাস না নিলেই যে ধনুষ্টংকার হবে এমনটা নয়। যদি যেকোন ধরণের ক্ষতকে জীবাণুমুক্ত রাখা নিশ্চিত করা যায় তাহলে টিটেনাসের দেহে প্রবেশের সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যাবস্থায় এরকম নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা তেমন সম্ভবপর হয়ে উঠেনা।  তাই আগে থেকেই টিকা গ্রহণ করে নিশ্চিন্ত থাকাটা জরুরী।

আমাদের দেশে প্রচলিত ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামে বাচ্চাদেরকে পেন্টাভ্যালেন্ট টিকা দেয়া হয় যেখানে ধনুষ্টংকারের টিকাও দেয়া হয়।  এই টিকা শিশুর ৬ সপ্তাহ, ১০ সপ্তাহ এবং ১৪ সপ্তাহে তিন ডোজ দেয়া হয়। আর এই সময় পর্যন্ত মায়ের নেয়া টিটি টিকা নবজাতককে সুরক্ষা প্রদান করে।

বিজ্ঞাপণ

শিশু বয়সে নেয়া টিকার কার্যকারিতা নারীদের গর্ভধারণের সময় পর্যন্ত থাকেনা ফলে তা সদ্যজন্মানো বাচ্চার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনা,  তাই আমাদের দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের জন্য টিটি টিকা প্রদানের কার্যক্রম প্রচলিত আছে।

১৫৪৯ বছর বয়সের মহিলাদের টিটি টিকাদান সময়সূচি

৫ বার টিটি টিকা নিতে হয়। এ টিকা যে-কোন সময়ে নেয়া যায়। তবে সরকারী কর্মসূচি অনুযায়ী ১৫ বছর বয়স থেকে টিকা দেয়া শুরু করতে হয় এবং নীচের সময়সূচি অনুযায়ী সারাজীবনে ৫ বার টিটি টিকা দিতে হয়। পুরা ডোজ শেষ করতে মোট ২ বছর ৭ মাস সময় লাগে। কখন টিটি দিতে হবেঃ 

  • টিটি ১ম ডোজ ১৫ বছর পূর্ণ হবার পর।
  • টিটি ২য় ডোজ টিটি ১ম ডোজ দেয়ার ৪ সপ্তাহ পর।
  • টিটি ৩য় ডোজ টিটি ২য় ডোজ দেয়ার ৬ মাস পর।
  • টিটি ৪র্থ ডোজ ৩য় ডোজ দেয়ার ১ বছর পর।
  • টিটি ৫ম ডোজ টিটি ৪র্থ ডোজ দেয়ার ১ বছর পর।

গর্ভাবস্থায় টিটি টিকা দেয়ার নিয়ম

টিটেনাসের ৫টি টিকার ডোজ সম্পন্ন থাকলে আর গর্ভাবস্থায় এই টিকা নেয়ার প্রয়োজন নেই। যদি ডোজ সম্পন্ন না থাকে তবে নিম্নলিখিত সময়সূচী অনুসরণ করতে পারেন-

যদি গর্ভধারণের আগে টিটি টিকার কোন ডোজ দেয়া না থাকে

  • টিটি ১ম ডোজ গর্ভাবস্থার পঞ্চম মাসের পর।
  • টিটি ২য় ডোজ টিটি ১ম ডোজ দেয়ার ৪ সপ্তাহ পর।
  • টিটি ৩য় ডোজ টিটি ২য় ডোজ দেয়ার ৬ মাস পর অথবা পরবর্তী গর্ভাবস্থায়।
  • টিটি ৪র্থ ডোজ ৩য় ডোজ দেয়ার ১ বছর পর অথবা পরবর্তী গর্ভাবস্থায়।
  • টিটি ৫ম ডোজ টিটি ৪র্থ ডোজ দেয়ার ১ বছর পর অথবা পরবর্তী গর্ভাবস্থায়।

গর্ভধারণের আগে দুই ডোজ নেওয়া থাকলে গর্ভকালীন তৃতীয় ডোজ এবং সন্তান প্রসবের পর বা পরবর্তী প্রতি গর্ভাবস্থায় একটি করে চতুর্থ ও পঞ্চম ডোজ নিতে হবে।

গর্ভধারণের আগে তিন ডোজ নেওয়া থাকলে এবং গর্ভকালীন সময় যদি তৃতীয় ডোজ নেয়ার এক বছরের ভেতর হয় তবে এসময় চতুর্থ ডোজ দেয়ার প্রয়োজন নেই। সন্তান প্রসবের পর বা পরবর্তী প্রতি গর্ভাবস্থায় একটি করে চতুর্থ ও পঞ্চম ডোজ নিতে হবে।

যদি তৃতীয় ডোজ নেয়ার এক বছর পর গর্ভধারণ করেন তবে গর্ভাবস্থায় চতুর্থ ডোজ এবং সন্তান প্রসবের পর বা পরবর্তী গর্ভাবস্থায় পঞ্চম ডোজ নিতে হবে।

তবে গর্ভকালীন সময়ে কোনো জটিলতা বা ইমার্জেন্সি ইস্যুতে প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে এই টিকা পুনরায় দিতে হতে পারে।

টিটি টিকার বিষয়ে যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে

  • সর্বনিম্ন বিরতির আগে টিকা দিলে তা কার্যকরী হবে না এবং এই ডোজটি বাতিল বলে গন্য হবে।
  • টিটি টিকার ডোজের বিরতির কোনো সর্বোচ্চ সীমা নেই। দু’টি ডোজের মধ্যে সময় যদি ১২ মাসের ও বেশি হয় তবুও আবার প্রথম থেকে টিকা দেয়া শুরু করা যাবে না। নূন্যতম বিরতি পর হলেই পরবর্তি ডোজ টিকা দিতে হবে। অর্থাৎ প্রথম ডোজ দেয়ার ২৮ দিনের পরিবর্তে ২/৩ মাসের পরে আসলেও তাকে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে।
  • কোনো টিকার ডোজ অনুমান করে বা নিশ্চিত না হয়ে দেয়া যাবে না।

টিটি টিকা কোথায় পাওয়া যায়

বিজ্ঞাপণ

এই টিকা সূর্যের হাসি চিহ্নিত ক্লিনিক, মেরিস্টোপস ক্লিনিক, বড় হাসপাতাল, সরকারি হাসপাতাল, সরকারী বেসরকারী মেডিকেল কলেজ, ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও পাওয়া যায়। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রতি রবিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়।

টিটি টিকার সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

যাদের এলার্জি আছে তাদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ইনজেকশন দেওয়া স্থানে লালচে হয়ে ফুলে যেতে পারে। অল্প ব্যথা থাকে, কিছুটা জ্বলে। অনেকেরই জ্বর চলে আসে। হালকা জ্বর দুই তিন দিন স্থায়ী হতে পারে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারন নেই। টিকা দেওয়ার পর বাহুর পেশিতে হাত দিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকুন বরফ ঘষে লাগান ৫-১০ মিনিট। এছাড়া কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment