শিশুকে প্রশংসা করার সময় যে শব্দগুলোর ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে

Spread the love

শারীরিক ও মানসিক ভাবে একটি শিশু স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বেড়ে ওঠার জন্য বাবা মা’কে হাজারো বিষয়ে মনোযোগী হতে হয়। কেবল মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করাই নয় বরং শিশুকে বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহিত করার জন্য প্রশংসা করাও বেশ প্রয়োজন। তবে যে কোন প্রশংসা করার আগে প্রশংসার শব্দগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কেননা কখনো কোন প্রশংসা শিশুকে তো উৎসাহী করে তোলেই না বরং সে কাজটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।  

“ প্রশংসা এক ধরণের মানসিক ওষুধ। যে কোন ওষুধের মতই “প্রশংসা” ইচ্ছেমত ব্যবহার করা যাবেনা। প্রত্যেকটি ওষুধের ব্যপারেই কিছু নিয়ম কানুন (যেমন- কতবার ও কখন খাওয়াতে হবে) এবং সতর্কতা ( যেমন- সম্ভাব্য অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন) অবলম্বন করতে হয়। ঠিক একইভাবেই এই মানসিক ওষুধের বিষয়েও যথাযথ নিয়মকানুন ও সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন।”

বিজ্ঞাপণ
Dr. Haim Ginott

গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের ব্যবহৃত বেশিরভাগ প্রশংসাবাক্য শিশুদের মোটিভেশন বাড়ানোর চাইতে আরও কমিয়ে দেয়।যেমন ধরুন, শিশু কোন একটি কাজ করার পর আপনি যদি তাকে বলেন, “কাজটি একদম পারফেক্ট হয়েছে, এর থেকে ভালো হতেই পারে না!” তাহলে দেখা যাবে শিশু সেই কাজটি আরো ভালোভাবে করার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। এছাড়া যখন আপনি এমন বলবেন যে, “তুমি সবার সেরা!” তখন শিশুর মধ্যে মিথ্যে আত্মতুষ্টি চলে আসতে পারে, যা তার পরবর্তী জীবনে ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করবে।

তাই শিশুকে সবসময় এমনভাবে প্রশংসা করা উচিৎ যাতে সেই প্রশংসা শিশুর মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সঠিক শব্দচয়নের মাধ্যমে শিশুর প্রশংসা করলেঃ 

  • শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে
  • আরো ভালো কিছু করার জন্য প্রেরণা পায়
  • শিশু অধ্যবসায়ী হয়ে উঠে

আসুন জেনে নেই শিশুকে ইতিবাচক প্রশংসা করার কিছু উপায় সম্পর্কে।

আন্তরিকতার সাথে সৎভাবে প্রশংসা করুন

নিজের সন্তানকে উৎসাহ দেয়ার জন্য তার যে কোন কাজের প্রশংসা করার সময় হয়ত আমরা ইচ্ছে করেই শিশুকে মিথ্যে প্রশংসা করি আর ভাবি যে শিশু এতে অনেক বেশি উৎসাহী হয়ে উঠবে।

আমাদের এই ধারণাটি একদমই ভুল, কেননা এতে সন্তান নিজের সঠিক মূল্যায়ন সম্পর্কে বুঝে উঠতে পারবে না। যেমন ধরুন, তাকে আপনি তিনটি অংক করতে দিলেন, আর দেখা গেল সে তিনটির মধ্যে একটি অংক ভুল করে ফেলেছে। আপনি তাকে উৎসাহ দিয়ে বলতে পারেন “তুমি একটা জিনিয়াস! দুটো অংক সঠিক করেছ”।

আপনার এই প্রশংসায় তার কিন্তু ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এই ধরণের মিথ্যে প্রশংসায় আসলে কিন্তু আপনার সন্তান ভুলবে না। সে ঠিকই মনে মনে ভাবতে থাকবে, আমি তো মাত্র দুটো প্রশ্নের উত্তর পারলাম, তাহলে আমি কীভাবে জিনিয়াস হলাম? এতে তার মনে এমন ধারণাও জন্মাতে পারে যে আপনি আসলে তার প্রতি তেমন মনোযোগ দিচ্ছেন না, এমনিতেই বলার খাতিরে বলছেন।

এর চাইতে বরং শিশুকে বলতে পারেন, তোমার যে অংকগুলো সঠিক হয়েছে সেগুলো খুবই চমৎকার হয়েছে। এভাবে বুঝে বুঝে অংক করলে দেখবে তুমি সবগুলো অংকই সঠিক ভাবে করতে পারছ! আর তাকে যখন এভাবে বলা হয়ে সে আরো ভালোভাবে চেষ্টা করার প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠবে।

সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রশংসা করুন এবং কারণ ব্যাখ্যা করুন

প্রশংসা করার সময় ঠিক কি কারণে প্রশংসা করছেন সেটা বলে দিন এবং একই সাথে তার করা কাজটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রশংসা করুন। কারণ, প্রশংসা তখনই সবচাইতে ভালো কাজ করে যখন শিশু নির্দিষ্টভাবে বুঝতে পারে কি কারণে প্রশংসা করা হয়েছে। যেমন ধরুন সে একটি ছবি এঁকেছে, এখন তাকে, “তোমার আঁকা ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে” এই বলে প্রশংসা না করে বরং আপনি বলতে পারেন, “তোমার ছবিতে সবুজ রঙের ব্যবহার আমার খুব ভালো লেগেছে।”

এছাড়া সন্তান যদি কোন একটি ভালো কাজ করে তাহলে তাকে শুধুমাত্র, “তুমি খুব ভালো একটি কাজ করেছ” না বলে বরং তাকে বুঝিয়ে বলুন যে এই কাজটি কেন ভালো কাজ। সেই সাথে অন্যান্য আরো কিছু ভালো কাজের উদাহরণ দিতে পারেন। যাতে করে আপনার সন্তান ভবিষ্যতে সেই কাজগুলোর প্রতিও বেশ উৎসাহী হয়ে উঠে।

নির্দিষ্ট করে না বললে শিশু বুঝতে পারেনা ঠিক কি কারণে আপনি খুশি হয়েছেন এবং ভবিষ্যতে কোন আচরণটি পুনরাবৃত্তি করতে হবে সে সম্পর্কেও শিশু কোন ধারণা পায়না।এভাবে নির্দিষ্ট করে প্রশংসা করার আরেকটি উপকারিতা হচ্ছে এতে শিশু বুঝতে পারে আপনি তার প্রতি এবং তার কাজের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন এবং আপনি কেয়ার করেন। আপনার এই আচরণ শিশুর আচরণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকরী।

সন্তানের দক্ষতা এবং অর্জন নিয়ে প্রশংসা না করে বরং তার চেষ্টা এবং ইচ্ছার প্রশংসা করুন

বেশ কয়েক বছর আগে American Psychological Association (APA) পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের উপর করা এক গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই গবেষণাটি করা হয়েছিল গণিতের সমস্যা সমাধান নিয়ে। গবেষণাটিতে কিছু ছাত্রছাত্রীকে তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশংসা করা হয়েছিল আর কিছু ছাত্রছাত্রীদের তাদের চেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রম নিয়ে প্রশংসা করা হয়েছিল।

ফলাফলে দেখা গেছে যাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশংসা করা হয়েছিল তারা পরবর্তীতে কোন গণিত সমাধানে ব্যার্থ হলে তা মেনে নিতে পারছিলনা। অন্যদিকে যেসব ছাত্রছাত্রীদের তাদের চেষ্টা এবং পরিশ্রম নিয়ে প্রশংসা করা হয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে সমস্যা সমাধানে আরও বেশি উদ্যোগী হতে এবং নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণে উৎসাহী হতে।

এই কারণে গবেষকরা মনে করেন যদি আপনি শিশুর কাজের ফলাফলের চাইতে তার কাজের পদ্ধতি নিয়ে এবং তার চেষ্টা নিয়ে প্রশংসা করেন তাহলে সে নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ধারণা পাবে এবং পরবর্তীতে আরো নতুন কিছু করার চেষ্টা করবে।

এই পুরো বিষয়টি আপনার সন্তানকে অধ্যবসায়ী করে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। কেননা মেধা সবার মধ্যেই থাকে, কিন্তু সেটাকে কাজে লাগাতে পারে শুধুমাত্র তারাই যারা প্রচেষ্টা করেছে। আর আপনার সন্তান যখন কিছু বারবার চেষ্টা করবে তখনই তার মেধা আরো অনেক চমৎকার ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে।এমনকি শিশু যখন কোন কাজে ব্যর্থ হবে তখন সে বুঝতে পারবে সে যদি চেষ্টা করতে থাকে তাহলে সে সফল হবেই।

যেমন ধরুন, শিশু যদি ঘরের কাজে আপনাকে সাহায্য করতে উৎসাহী হয় কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ঘর অগোছালো করে ফেলে তবে তাকে বলুন “ আমি জানি কাজটা একটু কঠিন কিন্তু তুমি যেভাবে চেষ্টা করছ তা আমার খুব পছন্দ”

শিশুর প্রশংসার উপরে কোন শর্তারোপ করবেন না

“তুমি যদি কাজটি আবার করতে পারো তাহলে তোমাকে অনেক বুদ্ধিমান বলব” অথবা “তুমি খুব ভালো খেল, তাই আগামী খেলায় তোমাকে জিততেই হবে” এমন কোন কথা নয় বরং শিশুর করা কাজটির প্রশংসা করুন। আপনার সন্তান অনেক উৎসাহ নিয়ে একটি খেলা খেলেছে, হয়ত জয়লাভ করেছে অথবা করেনি, সে যাই হোক না কেন তার উৎসাহ উদ্দীপনার প্রশংসা করুন। খেলার কোন একটি অংশ যদি যে ভালো খেলে থাকে, তাহলে সেই সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে প্রশংসা করতে পারেন।

এই ধরণের গঠনমূলক প্রশংসা আপনার সন্তানকে তার নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে সাহায্য করবে। সে বুঝতে পারবে প্রতিযোগিতায় সবসময় জয়লাভ করা যায় না বরং প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করা যতটা জরুরী ঠিক ততটাই জরুরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে জয়লাভের চেষ্টা করাটাও। এতে করে শিশু যে কোন কাজই অধ্যবসায়ের সাথে করার জন্য উৎসাহী হবে। আর কোন কারণে কোন কাজ করতে ব্যর্থ হলে হতাশা নয় বরং নতুন করে চেষ্টা করার উদ্দীপনা খুঁজে পাবে।

শিশুকে প্রশংসা করার সময় কারো সাথে তুলনা করবেন না

যে কোন বিষয়ে কারো সাথে তুলনা করাটা আমাদের যেন প্রতিনিয়ত অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।  স্কুলে, ক্লাসে, পরীক্ষায় এমনকি খেলার মধ্যেও আমরা সন্তানদের প্রতিনিয়তই কারো না কারো সাথে তুলনা করছি। খারাপ করলে বলছি অমুকের মত তুমি ভালো করছ না কেন? তবে এখানেই ক্ষান্ত হচ্ছি না আমরা বরং কেউ যদি ভালো করে তাহলে তাকে প্রশংসা করার সময়ও তুলনা করতে ছাড়ি না এই বলে যে, তুমি অমুকের মতই ভালো করেছ।

এভাবে কারো সাথে তুলনা করলে তা শিশুদের মোটিভেশন যোগায় এটা ঠিক। কিন্তু যখন কোন কাজে ব্যর্থ হয় তখন এই ধরণের বাক্যগুলো কিন্তু উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ধরুন আমাদের চাইতে যোগ্য কারোও সাথে যদি আমাদের তুলনা করা হয় এবং সে তুলনায় আমরা যদি ভালো ফলাফল করতে পারি তবে আমরা গর্বিত হয়, খুশি হয় এবং সেই সাথে উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি আমরা কোন কারণে ব্যর্থ হয় তখন সেই খারাপ লাগার পরিমাণটাও কিন্তু অনেকগুনে বেড়ে যায়।  কারণ আমরা তখনও সেই তুলনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনা।

এভাবে তুলনা করা হলে শিশুরা ভাবতে শুরু করে সব কাজেই সফল হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ, নতুন কিছু শেখা বা চেষ্টা করাটা নয়। এভাবে সব সময় সফল হওয়ার মানসিকতা শিশুর নতুন কিছু করার এবং শেখার উৎসাহ কমিয়ে দেয়। ব্যর্থতার ভয়ে তারা নতুন কোন চ্যালেঞ্জ নিতে চায়না বা নতুন কোন দক্ষতা অর্জন করতে চায়না।

তাই শিশুকে, “তুমি ঠিক তোমার বড় বোনের মতই ভালো কাজ করছ” অথবা “বাহ! বি সেকশনের ফার্স্ট বয়-এর মত তুমিও ভালো রেজাল্ট করেছ” এই ধরণের কথা না বলাই ভালো। এর পরিবর্তে আমরা বলতে পারি, “তুমি বেশ চমৎকার একটি কাজ করেছ” অথবা “বাহ, তুমি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছ এতে আমরা অনেক খুশি হয়েছি!”

যে কোন সহজ কাজে প্রশংসা বা অতি প্রশংসা এড়িয়ে চলুন

আপনার সন্তানের যে কোন সহজ কাজের জন্য আপনি যখন তাকে প্রশংসা শুরু করবেন তখন শিশুর মধ্যে বেশ কয়েক ধরণের প্রভাব পরতে দেখা যায়। এমনকি শিশুর আত্মবিশ্বাসের উপরেও এই ধরণের প্রশংসা বেশ জোড়াল প্রভাব বিস্তার করে, আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে এই প্রভাব মোটেও ভালো প্রভাব নয় বরং বেশ ক্ষতিকর।

যে সব শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে তাদের বাবা মায়েরা খুব সহজ কোন কাজেই তাদের প্রশংসা করে থাকেন। তারা হয়ত মনে করে থাকেন যে এই প্রশংসা শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলবে। আদতে এই ধরণের কাজ মোটেও শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে না বরং শিশু নিজেই বুঝতে পারে খুব সামান্য কাজের জন্যই তাকে বাহবা দেয়া হচ্ছে, আর তাই শিশু বরং আরো অনেক বেশি অনুৎসাহী হয়ে উঠে।

আবার যে সব শিশুরা এমনিতেই বেশ আত্মবিশ্বাসী তখন আপনি যদি একদম সহজ কোন কাজেই তার অতি প্রশংসা শুরু করেন, তাহলে শিশুর মধ্যে এক ধরণের ক্ষতিকর আত্ম মুগ্ধতা চলে আসতে পারে। এভাবে প্রশংসা করলে আপনার সন্তান নিজেকে সবার থেকে সেরা মনে করা শুরু করে দিতে পারে। একই সাথে আপনার সন্তান তখন অন্যদের থেকেও প্রশংসাবাক্য আশা করা শুরু করতে পারে।

তাই এই ধরণের অতিরিক্ত প্রশংসা না করে বরং আপনার সন্তানকে সঠিক বিষয়েই প্রশংসা করুন। আপনি তখনই তার প্রশংসা করবেন, যখন সে সত্যই প্রশংসার দাবীদার হয়ে উঠে।

যখন প্রশংসা করবেন তখন স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে করুন

শিশুকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বা আনন্দের সাথে অভিনন্দন ও প্রশংসা জানানো মোটেও কঠিন কিছু নয়। শিশু যখন চমৎকার কোন একটি কাজ করবে তখন শিশুকে জড়িয়ে ধরুন অথবা তার পিঠ চাপড়ে তাকে বাহবা দিন। শিশুকে বুঝতে দিন যে আপনি তার কাজে খুবই খুশি হয়েছেন। অপ্রত্যাশিত ভাবে শিশুর প্রশংসা করুন, যাতে করে শিশু যেন খুব খুশি হয়ে ওঠে।

শিশুর নিজের প্রতি ভালো বোধ করার বিষয়গুলো যাতে সব সময় অন্যের মতামতের উপর নির্ভরশীল না হয়ে যায় সেদিকেও মনোযোগ দিন। তাই কখনো কখনো “আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত” না বলে তাক বলুন “তোমার গর্ববোধ করা উচিত”

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment