বাবা মায়ের প্যারেন্টিং এর ধরণ ভিন্ন হলে কি করবেন

Spread the love


বাবা-মা ভিন্ন দুজন মানুষ, ভিন্ন দুটো সত্ত্বা। সন্তানকে পরামর্শ দেওয়া, ভালবাসা কিংবা শাসন করার ব্যাপারে তাদের রয়েছে নিজস্ব ভঙ্গি, নিজস্ব ভাষা। কখনো কখনো দেখা যায় বাবা-মায়ের স্বভাব সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী! একজন উত্তর মেরু তো আরেকজন দক্ষিণ মেরু! তো এরকম বিপরীতমুখী বাবা-মায়ের ভিন্ন ভিন্ন প্যারেন্টিং স্টাইল তাদের সন্তানের জন্য মঙ্গল নাকি বিপদজনক? এই প্রশ্নের জবাব অল্পকথায় দেওয়া সম্ভব নয়। তাই নিচে ভিন্ন ভিন্ন প্যারেন্টিং স্টাইল ও সন্তানের ওপর সেসবের প্রভাব এবং বাবা-মায়ের করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

প্যারেন্টিং স্টাইলের প্রকারভেদ

১. অথোরিটেরিয়ান বা স্বৈরাচারী (Authoritarian Parenting)

এই স্বভাবের বাবা বা মায়েরা সন্তানের জন্য কঠোর ধরনের নিয়ম প্রণনয়ন করেন এবং নিয়ম ভঙ্গ করলে শাস্তি দিয়ে থাকেন। তারা মনে করেন, সন্তান তাদের সবধরনের আদেশ, নিষেধ মানতে বাধ্য। তারা যা বলবেন, সন্তান সেটাই করবে। তাদের কথামতো না চললে সন্তানকে শাস্তি পেতে হবে।

বিজ্ঞাপণ

২. অথোরিটেটিভ বা কর্তৃত্বপরায়ণ (Authoritative Parenting)

ধারণা করা হয়, এই স্বভাবের অভিভাবকরা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। বাচ্চাদের যেসব নিয়ম মেনে চলা উচিত তারা তারা সেই সব নিয়ম প্রণনয়ন করে থাকেন। তবে তারা প্রচণ্ড কঠোরতা প্রদর্শন করেন না। প্রয়োজনে একটু ছাড়ও দেন। কখনো বাচ্চারা কোনো নিয়ম ভাঙলে বা কোনো অপরাধ করলে তারা ক্ষমাসূচক দৃষ্টিতে দেখেন এবং সামনে যেন এমন ঘটনা না হয় সেদিকে মনোযোগী হোন। 

৩. পারমিসিভ বা সহনশীল (Permissive Parenting)

যে অভিভাবকেরা এই ক্যাটাগরিতে পড়েন, তারা মূলত সন্তানদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না বা কোনো জোর-জবরদস্তি করেন না। এই স্বভাবের অভিভাবকরা সন্তানদেরকে সাধারণত প্রশয় দিয়ে থাকেন। তারা সন্তানের প্রতি আশাও কম রাখেন। তারা সন্তানের সাথে অভিভাবক হিসেবে নয় বরং অনেকটা বন্ধুর মতো আচরণ করেন।

৪. আনইনভলভড বা বিচ্ছিন্ন (Uninvolved Parenting)

এই ক্যাটাগরির অভিভাবকদের সাথে সন্তানদের সম্পর্কটা অনেক দুর্বল হয়। তারা সন্তানের সাথে সেভাবে যোগাযোগ করেন না, কথাবার্তা বলেন না। সন্তানদের প্রতি তাদের তেমন কোনো আশাও নেই, সন্তানদেরকে নিয়ে কোনো স্বপ্নও নেই। তারা নামকাওয়াস্তে বাবা-মা হিসেবে সন্তানের জীবনে বিরাজ করেন মাত্র।

[ আরও পড়ুনঃ চার ধরণের প্যারেন্টিং স্টাইল এবং শিশুর উপর এর প্রভাব ]

বাবা মায়ের ভিন্ন ভিন্ন প্যারেন্টিং যেভাবে শিশুর উপর প্রভাব ফেলে

শিশুরা কিন্তু সবসময় নিষ্পাপ বা আলাভোলা থাকে না। তারা সময় সুযোগ বুঝে নিজেদের ফায়দা নিতে জানে। যদি বাবা-মায়ের প্যারেন্টিং স্টাইল আলাদা হয় তারা সেটা থেকে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। বাবা-মা যদি নিজেদের প্যারেন্টিং স্টাইল সম্পর্কে জ্ঞাত না হোন, প্যারেন্টিং স্টাইল নিয়ে একে-অন্যের সাথে ঝগড়া করেন; সন্তানরা তখন সেখান থেকে বিভ্রান্তিমূলক বার্তা পায়।

ধরা যাক, একজন অথোরিটেরিয়ান বা স্বৈরাচারী স্বভাবের অভিভাবক (সেটা বাবা বা মা যেকেউ হতে পারে) তার সন্তানকে নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য শাস্তি দিচ্ছেন। কিন্তু তার দাম্পত্য সঙ্গীটি পারমিসিভ বা সহনশীল স্বভাবের হওয়ায় তিনি সন্তানকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। ফলে তাদের সন্তান একটি মিশ্র এবং বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। যেহেতু নিয়ম ভেঙেও সন্তানটি বেঁচে গেল, তাই সে সামনে আবারো নিয়ম ভাঙতে পারে। কারণ সে জানে তার বাবা-মায়ের মধ্যে প্যারেন্টিং স্টাইল নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। সেই দ্বন্দ্বকে নিজের পক্ষে কাজে লাগানো যাবে।

তাই বাবা-মায়ের নিজেদের প্যারেন্টিং স্টাইল ও সন্তানের ওপর সেগুলোর প্রভাবে ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক হওয়া উচিত।

বাবা-মায়ের করণীয় কী

১. আলোচনা করা জরুরি

মতের মিল না হলে তা নিয়ে দাম্পত্য সঙ্গীর সাথে আলোচনা করা খুবই জরুরি। আপনারা দুজন একটা তালিকা তৈরি করতে পারেন, যেখানে লেখা থাকবে প্যারেন্টিং বা সন্তান প্রতিপালন বিষয়ক কোন কোন কৌশলের ব্যাপারে আপনারা দুজনই একমত পোষণ করেন এবং কোন কোন বিষয়ে আপনাদের মতের মিল হয় না।

তালিকা তৈরি হয়ে গেলে এবার আপনারা এমন একটি কৌশল নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করুন যেটাতে আপনাদের মতের অমিল রয়েছে। একে অন্যের সাথে বোঝাপড়া করে সামনে এগোন। আপনার সঙ্গী কী বলতে চাচ্ছে এবং তার বক্তব্যের পেছনে থাকা যুক্তিটা কী, তা বোঝার চেষ্টা করুন। কমিউনিকেশন স্কিল ব্যবহার করুন।

এভাবে আপনারা মতের অমিল হওয়া কৌশলটির ব্যাপারে একটা সমঝতায় আসতে পারবেন। এরপর তালিকার পরবর্তী কৌশলের দিকে নজর দিন। সেটা নিয়ে কাজ করুন। যতদিন পর্যন্ত আপনাদের “মতের অমিল” শীর্ষক তালিকায় থাকা সকল সমস্যার সমাধান না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চালু রাখুন।

২. গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবগত হোন

আপনি এবং আপনার দাম্পত্য সঙ্গীর কাছে কোন কোন বিষয় বা গুণাবলী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে; সেগুলো খুঁজে বের করুন।

সম্মান করা, দয়া করা, পরিবারকে সময় দেওয়া, সৎ থাকা, নতুন কিছু করে দেখার চেষ্টা করা ইত্যাদি গুণাবলী কি আপনাদের কাছে গুরুত্ব রাখে? এমনও হতে পারে আপনি এবং আপনার দাম্পত্য সঙ্গী সবগুলো বিষয়ে একমত হতে পারলেন না। সেক্ষেত্রে আপনারা আলাদা আলাদাভাবে নিজের মতো করে এমন পাঁচটি গুণাবলী সম্বলিত একটি তালিকা তৈরি করুন, যে পাঁচটি গুণ আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্ব রাখে।

এবার দেখুন আপনাদের দুজনের তালিকায় কী কী মিল-অমিল রয়েছে। এবার তৃতীয় একটি তালিকা তৈরি করুন, আপনারা যে গুণাবলীর ব্যাপারে একমত হয়েছেন শুধুমাত্র সেগুলো সেই তালিকায় টুকে নিন। এবার সেই গুণাবলী নিয়ে দুজনে কাজ করুন। সেই গুণাবলীকে সামনে রেখে সন্তান প্রতিপালন করুন।

৩. টিম হিসেবে কাজ করুন

শিশুদের জন্য ধারাবাহিকতা জরুরি। অন্য দিকে বাবা-মায়ের উচিত একে অন্যকে সাপোর্ট করা। একটি পরিস্থিতিতে বাবা ও মায়ের প্রতিক্রিয়া অবশ্য ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু সেই ভিন্ন মতামতকে একটা স্থির পর্যায়ে আনার জন্য বাবা-মাকে একটি টিম হিসেবে কাজ করতে হবে। নইলে বাবা-মা একে অন্যের সাথে তর্ক, ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে যাবেন। যা শিশুর ওপর বাজে প্রভাব ফেলবে।

বাবা-মাকে বুঝতে হবে কার কোন দিক বা গুণগুলো বেশ শক্তিশালী। সবসময় সমালোচনায় লিপ্ত না থেকে বরং একে অন্যকে প্রশংসা করতে হবে। “আমিই ঠিক, তুমি ভুল” এটা প্রমাণ করার বা এই ব্যাপারে প্রতিনিয়ত যুক্তি দেখানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।

আপনার সিদ্ধান্ত, পছন্দ-অপছন্দ যা-ই হোক না কেন যদি আপনারা স্থির করেন- একসাথে একটা টিম হিসেবে কাজ করবেন, ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন; তাহলে আপনারা লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবেন।

৪. আপনার দাম্পত্য সঙ্গী একজন ভিন্ন সত্ত্বা

আমরা মানুষ হিসেবে সবাই কিন্তু আলাদা। আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে। একইভাবে আপনার দাম্পত্য সঙ্গীর নিজস্ব রুচি, বক্তব্য আছে। বিয়ে করে একসাথে সংসার করছেন বলে এই না যে, আপনাদের দুজনের মতামত সবসময় মিলতেই হবে।

সন্তান লালন-পালন করার ব্যাপারে আপনার দাম্পত্য সঙ্গী ভিন্ন কেনো কৌশল অবলম্বন করতেই পারে বা তার প্যারেন্টিং স্টাইল ভিন্ন হতেই পারে। কৌশল ভিন্ন বলে দুজন একে অন্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে, এমনটা নয়। কিছুক্ষেত্রে বরং শিশুরা বাবা-মায়ের ভিন্ন ভিন্ন প্যারেন্টিং স্টাইল থেকে উপকৃত হয়। তারা ভিন্ন মতামত সম্পর্কে জানতে পারে।

একই ব্যাপারে দুজন মানুষের মতামত ভিন্ন হতে পারে, এই ব্যাপারটা শিশুরা অনুধাবন করতে পারে। এখানে এটাও মাথায় রাখতে হবে, শিশুরা কিন্তু বাবার সাথে এবং মায়ের সাথে একই রকম সম্পর্ক বজায় রাখে না।

মূলত বাবা-মাকে একটা বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, তা হলো- “আমরা দুজন দুটো ভিন্ন মানুষ, আমাদের প্যারেন্টিং স্টাইল ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হতেই পারে কিন্তু শিশুর অভিভাবক হিসেবে আমরা অবশ্যই একটি টিম হিসেবে কাজ করব।” ভিন্ন প্যারেন্টিং স্টাইল দাঁড় করাতে গিয়ে কোনোভাবেই ঝগড়ায় জড়ানো চলবে না। বাচ্চাদের সামনে তো একদমই নয়।

৫. প্রত্যেকটি শিশুর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও মেজাজ রয়েছে

শিশুকে মানুষ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই তার ব্যক্তিত্ব ও মেজাজকে বিবেচনায় রাখতে হবে। বাবা-মাকে এমন প্যারেন্টিং স্টাইল নির্বাচন করতে হবে যা তাদের শিশুর সাথে মানানসই এবং কর্যকরী হবে।

বাবা-মাকে ভাবতে হবে কোন পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করলে তাদের সন্তান সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। এক্ষেত্রে বাবা-মা দুজন যদি ভিন্ন দুটো পদ্ধতির কথা বলেন, সেক্ষেত্রে সমঝোতায় আসতে হবে।

তবে সমঝোতা বা কম্প্রোমাইজের সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে সন্তানের উন্নতি ও মঙ্গলের বিষয়টি। বাবা-মা দুজনই শিশুকে বড় করার ব্যাপারে নিজেদের লক্ষ্যের কথা একে অন্যকে জানাবেন, সেই লক্ষ্যের পেছনে আপনাদের যুক্তিগুলো কী কী এবং আপনারা কীভাবে আপনার সন্তানকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে চান সেটা দুজনে মিলে আলোচনা করেই ঠিক করতে হবে।

৬. দুজনে মিলে নিয়ম তৈরি করুন

নিজেরা বা বাচ্চারা বাড়িতে কী কী নিয়ম অনুসরণ করতে হবে সেগুলো দুজনে মিলে ঠিক করে নিন। “ভাল হয়ে থাকবে নইলে শাস্তি দেব।” শুধু এধরনের ভাসমান, অগভীর নিয়ম জারি করে আপনি বাচ্চাদেরকে শৃঙ্খলা শেখাতে পারবেন না। এতে বরং ভুল বোঝাবুঝি হবে, কনফিউশন বাড়বে।

বাচ্চারা কখন ঘুমুতে যাবে, কটায় ঘুম থেকে উঠবে, বিকেলে বাইরে খেলতে গেলে কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যাবে, খেলতে যাওয়ার আগে হোমওয়ার্ক শেষ করতে হবে কিনা, রাতে খাওয়ার আগে মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটার চালাতে পারবে কিনা ইত্যাদি নিয়মগুলো দুজনে মিলে তৈরি করুন।

শুধু নিজেরা তৈরি করেই প্রয়োগ করার জন্য উঠে পড়ে লাগবেন না যেন! প্রস্তাবিত নিয়মগুলো নিয়ে বাচ্চাদের সাথেও আলোচনা করুন। দেখুন তারা কী বলে। তাদের মতামত দিন।

বাচ্চারা যদি কোনো আইডিয়া দেয়, সেটাও বিবেচনায় রাখুন। আলোচনা শেষে তাদেরকে জানান বাসায় এই নিয়মগুলো চালু হতে যাচ্ছে। এখন থেকে তাদেরকে এই নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে।

নিয়ম বলবৎ করার আগে বাচ্চাদের আলোচনা করে নেওয়ার একটা বড় সুবিধা আছে। সেটা হলো, সবার নিয়মগুলো জানা থাকলে নিয়মগুলো প্রয়োগ করাটা সহজ হয়ে যায়।

৭. সুযোগ দিন

বাবা-মা হয়ে যাওয়া মানে এই নয় যে আপনাদের ভুল হবে না। সবারই কোনো না কোনো ভুল হয়। হয়তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন বা বাচ্চাদের সাথে মেজাজ হারিয়ে খারাপ কিছু বলে বসলেন কিংবা বাজে ব্যবহার করে ফেললেন। জীবনে চলার পথে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে।

আপনার দাম্পত্য সঙ্গী কোনো ভুল করে বসেছে বলে তাকে দোষারোপ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগবেন না। কিছু বলার থাকলে বাচ্চাদের অনুপস্থিতিতে বলুন, ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করুন। তারপর আপনার সঙ্গীর দিকে ক্ষমাসূচক হাত বাড়িয়ে দিন। মনে রাখবেন- সে আপনার জীবন সঙ্গী, আপনার শত্রু নয়। একে-অন্যকে সাপোর্ট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞাপণ

আপনাদের প্যারেন্টিং স্টাইল আলাদা হতেই পারে। তাই বলে সেটা যেন আপনাদের দুজনের সম্পর্ককে নষ্ট করে না দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। মন দিয়ে একে অন্যের বক্তব্য শুনবেন। এতে আপনার পরিবার দারুণ ছন্দে থাকবে। আপনারা সন্তানাদি নিয়ে একটি চমৎকার পরিবার গড়ে তুলতে পারবেন।

৮. আগ বাড়িয়ে যাবেন না

এ-ব্যাপারে সরাসরি একজন স্ত্রী এবং বাচ্চার মায়ের বক্তব্য শোনা যাক। আশা করি, এতেই পাঠকদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

“আমার স্বামী যখন বাচ্চাদের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতো বা শাসন করতো আমি আগ বাড়িয়ে আমার স্বামীর কথার মাঝে ঢুকে পড়তাম এবং নিজেই বাচ্চাদেরকে শাসন করতে শুরু করতাম। কিন্তু আমার স্বামী বিষয়টা আমাকে না ধরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেও পারিনি যে, আমি বারংবার এরকম কিছু করে আসছিলাম। আমার ওভাবে আগ বাড়িয়ে ঢোকার ফলে স্বামী তো বটেই, বাচ্চারাও কনফিউজ হয়ে যেত। ওরা বুঝতে পারতো না কার কথা শুনবে। বাবার কথা না মায়ের কথা!

তাছাড়া ওভাবে আগ বাড়িয়ে গিয়ে আমি নিজের অজান্তেই বাচ্চাদের সামনে আমার স্বামীর অবস্থানকেও ছোট করে দিচ্ছিলাম। ওরকম করতে থাকলে বাচ্চারা একটা সময় আর আমার স্বামীর কথা শুনতেই চাইবে না! কারণ ওদের কাছে মনে হবে, মায়ের কথাই আসল কথা। বাবা তো স্রেফ দুধভাত!

আমিই যদি বারবার আমার স্বামীর কথায় বাগড়া দিই, তাহলে সে নিজের প্যারেন্টিং স্টাইল প্রয়োগ করবে কীভাবে? প্যারেন্টিঙের চর্চাই বা করবে কীভাবে? সে কীভাবে নিজের পিতৃত্ব উপভোগ করবে? তাকে তো বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে শিখতে হবে কোনটা ভাল কাজ করছে। কিন্তু আমি নিজের অজান্তেই তাকে এসব থেকে বঞ্চিত করছিলাম।

নিজের ভুল বুঝতে পারার পর থেকে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। বাচ্চাদের সাথে আমার স্বামী যদি দুর্বল কৌশলও প্রয়োগ করে, আমি সেখানে আগবাড়িয়ে ঢুকে পড়ি না। বরং পর্যবেক্ষণ করি আমার স্বামীর কথাগুলোকে বাচ্চারা কীভাবে নিচ্ছে এবং এর বিপরীতে আমার স্বামী কীভাবে একজন বাবা হিসেবে ধীরে ধীরে পরিপক্ব হয়ে উঠছে।”

৯. কেউ-ই নিখুঁত নয়

সন্তানকে শাসন করতে গিয়ে আপনার স্বামী হয়তো মেজাজ হারিয়ে ফেলেছে। উল্টোপাল্টা বকা-ঝকা করেছে বা প্রচণ্ড কড়া কথা বলেছে। সেক্ষেত্রে সন্তানের মা হিসেবে এবং একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করাটা মোটেও উচিত হবে না। আপনাকে বুঝতে হবে ভুল আপনিও করতে পারেন।

বাবা-মা হয়েছেন বলে এই নয় যে আপনাদের ভুল হবে না। আপনার স্বামী যখন কোনো ভুল করে বসে, আপনি না বললেও সে পরবর্তীতে ঠিকই বুঝতে পারে তার কোথায় ভুল হয়েছে। তাকে নিজের মতো করে বিষয়টা অনুধাবন করতে দিন। ভুল করেছে বলে কোমরে আঁচল বেঁধে তাকে দোষারোপ করতে শুরু করবেন না।

১০. কৌশল ভিন্ন মানেই “খারাপ” নয়

হয়তো আপনার স্বামী বা স্ত্রী বাচ্চাদের সাথে হাসি-খুশি থেকে খুব ভাল মিশতে পারে। অন্যদিকে আপনি হয়তো একটু গম্ভীরভাবে থাকতে পছন্দ করেন। আপনার দাম্পত্য সঙ্গী বাচ্চাদের সাথে হাসি-খুশি থাকছে বা তাদেরকে একটু ছাড় দিতে পছন্দ করছে বলে কিন্তু এই নয় যে সে বাচ্চাদেরকে “নষ্ট” করে ফেলছে। বাচ্চাদেরকে ভিন্নধর্মী প্যারেন্টিং স্টাইল উপভোগ করতে দিন।

আপনি হয়তো প্যারেন্টিং বিষয় বিভিন্ন বই, আর্টিকেল পড়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান অর্জন করেন এবং নিজের প্যারেন্টিং স্টাইলে সেই জ্ঞানগুলো প্রয়োগ করে থাকেন। আপনার দাম্পত্য সঙ্গী হয়তো এত গবেষণা করে না। তাতে দোষ কী? তাকে না হয় নিজের মতো করে বাচ্চাদের সাথে ভাল সময় কাটাতে দিন। এতে কোনো ক্ষতি নেই।

১১. দাম্পত্য সঙ্গীকে ভিলেইন বানিয়ে দেবেন না

সন্তানদেরকে শাসন করতে গিয়ে বা অন্য কোনো কারণে তাদের বাবা বা মাকে তাদের চোখে ভিলেইন হিসেবে উপস্থাপন করবেন না।

আপনাদের প্যারেন্টিং স্টাইলে পার্থক্য থাকতেই পারে। হতেই পারে আপনার স্বামী বা স্ত্রী একটু বেশি কড়া, আপনি একটু নরম স্বভাবের। তাই বলে কখনো সন্তানকে এভাবে হুমকি দেবেন না, “তোমার বাবা (কিংবা মা) আজকে বাসায় আসুক। তারপর মজা টের পাবে! তোমাকে উচিত শিক্ষা দিবে!”

এধরনের কথা সন্তানের ওপর বাজে প্রভাব ফেলে এবং সন্তানের চোখে সেই অভিভাবক (বাবা বা মা) ভিলেইন হিসেবে চিত্রায়িত হয়ে যায়। যা পরবর্তী সেই অভিভাবকের সাথে সন্তানের সম্পর্ক সহজ হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

১২. সন্তানের বয়সের সাথে মানিয়ে নিন

সন্তানের শিশু বয়সে যে প্যারেন্টিং স্টাইল কাজ করেছে তার বয়ঃসন্ধিকালে একই প্যারেন্টিং স্টাইল কাজ নাও করতে পারে। তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের বয়স অনুযায়ী নিজেদের প্যারেন্টিং স্টাইলে পরিবর্তন আনা।

বাবা-মায়ের প্যারেন্টিং স্টাইলে পার্থক্য থাকলে সেক্ষেত্রেও সন্তানের বয়সের সাথে খাপ খাইয়ে সমঝোতায় আসা এবং এক টিম হিসেবে কাজ করার বিষয়টা ভুলে যাওয়া চলবে না।

বিজ্ঞাপণ

১৩. নিজের যত্ন নিন

প্যারেন্টিং এর কোনো শেষ নেই। সন্তান শিশু থেকে বড় হয়ে গেলেও বাবা-মায়ের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করা অনেক কঠিন এবং চাপের ব্যাপার। এই চাপ সামলানোর জন্য অবশ্যই বাবা-মায়ের উচিত নিজেদের যত্ন নেওয়া।

সারাদিন শুধু বাচ্চাদের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া উচিত। নইলে বাবা-মা হওয়ার দায়িত্বটা অনেকটা বোঝা বা শেকলের মতো মনে হতে পারে। ঠিকমতো ঘুমানো, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পানি পান করা, ব্যায়াম করা, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, মজা করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডেও নিজেদেরকে সংযুক্ত করা উচিত।

১৪. বাবাদেরকে শিখতে হবে

বাবা-মায়ের প্যারেন্টিং স্টাইল আলাদা হওয়াটা দোষণীয় নয়। কিন্তু যদি তারা তাদের প্যারেন্টিং স্টাইলে সমঝোতা করতে না পারেন, দুজন মিলেমিশে চলতে না পারেন, বারবার একে-অন্যের সাথে তর্কে লিপ্ত হোন; তাহলে সমস্যা।

এক সমীক্ষায় (আমেরিকায়) দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবারা একটা ব্যাপারে সবসময় অস্বস্তিতে ভোগেন। ব্যাপারটা হলো : পরিবারে মায়ের শক্তিশালী ভূমিকা। দেখা যায়, মায়ের রায়ই সন্তানেরা “চূড়ান্ত রায়” হিসেবে ধরে নেয়। এই ব্যাপারটা বাবাদেরকে পীড়া দেয়।

মায়ের রায় চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে অবশ্য যৌক্তিক কারণও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে অধিকাংশ (প্রায় ৭০ শতাংশ) প্যারেন্টিং সংক্রান্ত বইয়ের ক্রেতা নারী বা মায়েরা। অর্থাৎ, মায়েরা প্যারেন্টিং এর ব্যাপারে তথ্য জানতে ও জ্ঞান অর্জন করতে অনেক বেশি আগ্রহী। তাই স্বাভাবিকভাবেই মায়েদের প্যারেন্টিং সংক্রান্ত জ্ঞান বেশি থাকে।

তাই বাবাদেরও উচিত প্যারেন্টিং বিষয়ক আর্টিকেল, বই, প্রবন্ধ ইত্যাদি পড়া এবং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় নোট নেওয়া। এতে বাবা-মায়ের প্যারেন্টিং স্টাইলে ছন্দ আনতে সুবিধা হবে।

১৫. বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিন

নিজেরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে না পারলে বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হলে ফ্যামেলি থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হোন। একজন রেজিস্টার্ড কাউন্সিলর আপনাদেরকে উপযু্ক্ত পরামর্শ দিতে পারবেন।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment