গর্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা | মমনেশিয়া (Momnesia)

Spread the love

আমার মনে হচ্ছে, গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই আমি কেমন যেন ভুলোমনা হতে শুরু করেছি৷ এটা কি আমার ভাবনার ভুল নাকি আসলেই এমন কিছু হচ্ছে?

হ্যা, অধিকাংশ গর্ভবতী মহিলারাই এই বিষয়টি উল্লেখ করে থাকেন। প্রায় ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ গর্ভবতী নারীরাই বলে থাকেন যে গর্ভধারণ অবস্থায় তারা কিছুটা ভুলোমনা এবং অমনোযোগী হয়ে পড়ছেন। মূলত গর্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কেন হয় এই বিষয়ে এখনো কোন সঠিক ধারণা পাওয়া যায়নি, তবে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা কিন্তু চলছেই।

গর্ভকালীন এই মস্তিষ্কের জটিলতা (একে মমনেসিয়া বলেও ডাকা হয়) যতটা না বেশী তাত্বিক, তার চেয়ে বেশী অনুভূতির। গর্ভধারণ আপনার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মোড় যা আপনার জীবনের গতি প্রকৃতি পাল্টে দিতে পারে। এই অজানা আশংকা এবং উত্তেজনা এই দুইয়ে মিলেই কিন্তু যথেষ্ট, সাধারণ কাজ থেকে আপনার মনযোগ সরিয়ে দিতে।

বিজ্ঞাপণ

সম্ভাবনাময় আগামী নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা এবং মানসিক চাপও কিন্ত আপনার মনযোগে প্রভাব ফেলতে পারে। এর পাশাপাশি তো রয়েছে প্রতিনিয়ত শারীরিক ধকল, যা আপনাকে অস্থির করে তোলে।

প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বিভিন্ন বিষয় ভুলে যাওয়ার মানে কিন্তু এই না যে আপনি স্মৃতিবিনাশী রোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন। এটা ঘটতে পারে হরমোনজনিত কারণে। সবকিছু ভুলে যাওয়ার এই উপসর্গটিকে সাধারণভাবে বলা হয় অ্যামনেশিয়া (Amnesia)। কিন্তু যখন নতুন মা বা হবু মায়েদের এ ধরণের সমস্যা দেখা দেয় তখন তাকে “মমনেশিয়া” (Momnesia) নামেও অভিহিত করা হয়।  

গর্ভাবস্থার কিছু সময় পর পর্যন্ত এই অবস্থা থাকবে, তারপর হরমোনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলে এই উপসর্গও দূর হয়ে যাবে।

মমনেসিয়া বা গর্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতার বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা কি?

সত্যি বলতে এই জটিলতার সর্বসম্মত কিংবা প্রমাণিত কোন ব্যখ্যা নেই। একজন নারী যখন গর্ভধারণ করেন, অসংখ্য রকমের হরমোন শরীরজুড়ে নিঃসৃত হয়, মূলত এর কারণেই তার মধ্যে শারিরীক পরিবর্তনগুলো ঘটে থাকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ জানে না ঠিক কোন হরমোন কিভাবে মস্তিষ্কে বা স্মৃতিশক্তিতে প্রভাব ফেলে কিংবা কতটুকু প্রভাব ফেলে কারণ এ নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন।

কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে যেসব নারী গর্ভবতী হননি, তাদের তুলনায় গর্ভবতী নারীদের স্মৃতিশক্তি তূলনামূলক অনেক খারাপ।

আরেকটা গবেষনায় বলা হয়েছে, গর্ভধারণকালীন সময়ের শেষ তিন মাসেই নারীদের স্মৃতিশক্তি সবচেয়ে বেশী খারাপ লক্ষ্য করা যায়। আবার অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যেসব নারীরা গর্ভবতী নন, বুদ্ধির পরীক্ষায় প্রায় তাদের সমানই স্কোর করেছেন গর্ভবতী নারীরা।

২০১৬ সালে, একটা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গর্ভধারণ একজন নারীর মস্তিষ্কে বড় ধরণের এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন সাধন করে থাকে।

গবেষকরা ২৫ জন নারীর এমআরআই (MRI) করে বের করেছেন যে, গর্ভধারণকালীন সময়ে নারীরা কিছু ‘গ্রে ম্যাটার’ হারায় এবং তা ঘটে থাকে সামাজিক সচেতনতা এবং আরেকজনের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন বিষয়কে দেখার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের যে অংশ কাজ করে, সে অংশে। এই পরিবর্তনটা ডেলিভারির পর ২ বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকে।

তবে গবেষকেরা এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন৷ এই পরিবর্তন নারীর মস্তিষ্ককে মাতৃত্বের জন্যে যথেষ্ট কার্যকরী এবং ‘স্পেশাল’ করে গড়ে তোলে। শুনতে একটু অন্যরকম মনে হলেও, মস্তিষ্কের এই পরিবর্তন শিশুর সাথে আপনার সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করে এবং আপনাকে প্রস্তুত করে যাতে আপনি শিশুর প্রয়োজনে সময়োপযোগী সাড়া দিতে পারেন।

যদিও এই সময়ে স্মৃতিশক্তি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গবেষকেরা কোন নির্দিষ্ট উপসংহারে পৌছেন নি, কিন্তু তারা ধারণা করেছেন যে, মস্তিষ্কের এই পরিবর্তনের কারণে স্মৃতিশক্তি প্রভাবিত হতে পারে এবং কিছুটা দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

গর্ভাবস্থায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করতে আমি কি করতে পারি?

সত্যি বলতে, এক্ষেত্রে আপনার খুব বেশী কিছু একটা করার নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো যাতে ভুলে না যান, সেগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন:

প্রতিদিনের ক্যালেন্ডার রাখুন। আপনার মোবাইলে ক্যালেন্ডার এপ্লিকেশনটি ব্যবহার করতে পারেন, অথবা ছোট ডেইলি প্ল্যানার বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোও ব্যবহার করতে পারেন।

বিজ্ঞাপণ

গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন। যে জিনিসগুলো আপনার সবসময় দরকারী- যেমন চাবি, হাতঘড়ি এগুলো রাখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে রাখুন যাতে সহজেই খুঁজে পান।

এলার্ম দিয়ে রাখুন। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং কিংবা কাজগুলোর জন্যে এলার্ম দিয়ে রাখুন। আপনার ফোনে কিংবা কম্পিউটারে এলার্ম দিয়ে রাখলে এগুলো মিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

ছবি তুলে রাখুন। ধরুন আপনি কোন বড় কিংবা ব্যস্ত পার্কিংয়ে গাড়ি রাখলেন, কোথায় রাখলেন তার ছবি মোবাইলে তুলে রাখুন। এছাড়াও কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মনে রাখার জন্যে মস্তিষ্কের উপর নির্ভর না করে ছবি তুলে রাখতে পারেন। যেমন – মিটিংয়ের কোন স্লাইড, ম্যাগাজিনের আর্টিকেল, কোন অনুষ্ঠানের সময়সূচি ইত্যাদি।

নোট করার এপ্লিকেশন ব্যবহার করুন। এখন মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের অনেক এপ্লিকেশন আছে যেগুলোতে লিখে, ছবি তুলে, ভয়েস রেকর্ড করে নোট করা যায়। সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন৷ Simplenote, Google Keep, Evernote, এবং OneNote তাদের মধ্যে অন্যতম।

স্মৃতিসহায়ক বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করুন। যখন আপনি নতুন কারো সাথে পরিচিত হবেন, তার নাম মনে রাখতে তার নামের কাছাকাছি কিছু দিয়ে তাকে কল্পনা করুন। ধরুন, আপনি আকাশ নামের কারো সাথে পরিচিত হিলেন, তাকে কল্পনা করুন সে যেন খোলা আকাশের নিচে একা দাঁড়িয়ে আছে। পরের বার তার সাথে যখন দেখা হবে, তার নাম খুব দ্রুত মনে পড়ে যাবে।

ছোট নোটবুক ব্যবহার করুন। আপনার সাথে দৈনন্দিন যা যা ঘটেছে, সব নোটবুকে টুকে রাখুন। নাহ, খুব গোছালো সুন্দর করে নোট করতে হবে, তা কিন্তু না। দৈনন্দিন সবকিছু এক জায়গায় থাকলে আপনার মনে করতে সুবিধা হবে।

যথেষ্ট পরিমাণে ঘুমান। শুধু শিশুকে যত্ন ও পরিচর্যার জন্যে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতেই যে আপনার প্রচুর ঘুম প্রয়োজন, তা কিন্তু নয়। আপনার মস্তিষ্ককে সতেজ ও প্রাত্যহিক জীবনে সচেতন থাকতেও আপনার যথেষ্ট পরিমাণ ঘুম প্রয়োজন।

ব্যায়াম করুন। আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ীই নিয়মিত ব্যায়াম করুন। নিয়মিত ব্যায়াম করলে গর্ভাবস্থায় শুধু যে সুস্বাস্থ্যবান থাকবেন, তা-ই নয়, এটা আপনার স্মৃতিশক্তিকে তীক্ষ্ণ করবে, পাশাপাশি আপনাকে রাতে ভালো ঘুমাতে সাহায্য করবে এবং দিনের বেলায় আপনি যখন ব্যস্ত থাকবেন, আপনার মস্তিষ্ককে সচল রাখবে।

আশপাশের মানুষদের থেকে সাহায্য নিন। আপনার স্বামী কিংবা পরিবারের সদস্য কিংবা আপনার বন্ধুবান্ধব – যখন যার সাথেই থাকুন না কেন, আপনার দৈনন্দিন জীবনের কাজে তাদের সহায়তা করতে বলুন। কোন কাজ করে দিতে, এটা সেটা এনে দিতে কিংবা শিশুর যত্ন নিতে তাদের বলতে পারেন।

এই সময়ে আপনি যত কম পরিশ্রম করবেন, আপনার অবসাদগ্রস্থ হওয়াও তত কমে যাবে। আর যত অবসাদ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন, ততই আপনার স্মৃতিশক্তি ভালো থাকবে।

কাজকর্ম সহজ করে ফেলুন। একই সাথে অনেক কাজ করা থেকে বিরত থাকুন৷ প্রথমে ঠিক করুন কোনটা বেশী জরুরি কোনটা কম, সে অনুযায়ী কাজ আগে পরে করুন। মনে রাখবেন, এই সময়ে আপনার নিজের শরীরে শক্তি থাকাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। দরকারী কাজের জন্যে শক্তি জমিয়ে রাখুন।

এই স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়াটা কি আমার গর্ভাবস্থার কোন সমস্যার লক্ষণ?

গর্ভাবস্থায় টুকটাক ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আপনার যদি আসলেই মনে হয় আপনার কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করতে সমস্যা হচ্ছে কিংবা মনযোগ আসছে না অথবা আগে আপনি যে বিষয় বা কাজ খুব আগ্রহভরে করতেন, সেগুলোতে আর আগ্রহ পাচ্ছেন না – এমন যদি দু সপ্তাহ বা এর বেশী সময় ধরে হয়ে থাকে, এর কারণ খুব সম্ভবত আপনার গর্ভকালীন বিষন্নতা।

যখন আপনি অসময়ে বিনাকারণে বিষন্নতা বোধ করবেন, চুপচাপ বসে থাকবেন না। অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। এই সব বিষয়ে আজকাল অনেক কাউন্সেলিং এবং সাহায্য পাওয়া যায়। গর্ভকালীন বিষণ্ণতা সম্পর্কে আরও জানতে আমাদের লেখা আর্টিকেলটি পড়ুন।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts