শিশুর খাবারে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা, পরিমাণ, উৎস এবং অন্যান্য

Spread the love

আপনার শিশুর সুস্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য ক্যালসিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আর্টিকেলটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন আপনার শিশুর ঠিক কি পরিমাণে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন এবং কোন ধরনের খাদ্য থেকে সে এই ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।

শিশুর জন্য কেন ক্যালসিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ?

ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁত মজবুত করে এবং নার্ভ ও পেশীর কার্যক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়াও ক্যালসিয়াম শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে বাঁধা দেয় এবং শরীরের সেসব এনজাইমগুলোকে সক্রিয় রাখে যেগুলো খাদ্যকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিতে রূপান্তরিত করে।

বিজ্ঞাপণ

শরীরের শতকরা ৯৯ ভাগ ক্যালসিয়াম দাঁত এবং হাড়ে সংরক্ষিত থাকে। আর যেহেতু ছোট শিশুরা প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে এবং শরীরের হাড় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন পড়ে।

আপনার শিশুর ঠিক কি পরিমাণে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন?

  • ১ থেকে ৩ বছরের শিশুর জন্য প্রতিদিন গড়ে ৭০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন।
  • ৪ থেকে ৮ বছরের শিশুর জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন।

তবে আপনার শিশুকে প্রতিদিনই এই পরিমাণে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়াতে হবে না। একটু লক্ষ্য রাখবেন যাতে প্রতি সপ্তাহে শিশু যাতে এমন পরিমাণে ক্যালসিয়াম পায় যেটার গড় দৈনিক এই পরিমাণে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ খেয়াল রাখবেন ১ থেকে ৩ বছরের আপনার শিশুটি যাতে প্রতি সপ্তাহে ৪৯০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম পায়। 

শিশুর ক্যালসিয়ামের জন্য সবচেয়ে ভালো উৎস

দুধ, দই এবং চিজ এই ধরনের স্নেহ জাতীয় পদার্থ ক্যালসিয়ামের জন্য সবচাইতে ভালো উৎস। এছাড়াও আরো অন্য কিছু খাবারে ক্যালসিয়াম রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

  • এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ সম পরিমাণ টফু যেটা ক্যালসিয়াম সালফেট দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে, তার মধ্যে থাকে ২১৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। (টফুর মধ্যে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, তবে সেটা নির্ভর করে টফু কীভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে তার উপর।
  • আধা কাপ সাধারণ দইয়ে ২০৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম আছে
  • এক টেবিল চামচ ব্ল্যাকস্ট্র্যাপ মোলাসেস বা গুড় এর মধ্যেঃ ১৭২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা কাপ ফ্রুট ইয়োগার্টে ১২২ থেকে ১৯২ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ক্যালসিয়াম থাকে।
  • আধা কাপ ক্যালসিয়াম-ফর্টিফাইড কমলার জুসে ১৩৩ থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ক্যালসিয়াম থাকে।
  • এক কাপের চার ভাগ সম পরিমাণ রিকোটা চিজে ১৬৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা কাপ দুধে ১৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা কপ চকোলেট দুধে ১৪৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা আউন্স পরিমাণ সুইস চিজে ১১২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা কাপ ভ্যানিলা ফ্রোজেন ইয়োগার্ট সাধারণ তাপমাত্রায় পরিবেশন করলে তার মধ্যেঃ ১০২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা আউন্স পরিমাণে Cheddar Cheese এর মধ্যেঃ ১০২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • এক স্লাইস হোল গ্রেইন পাউরুটির মধ্যে ২৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে
  • আধা আউন্স মোজারেলা চিজে ১০৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে
  • এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ সমপরিমাণ সবুজ শাকসবজিতে (Collard Greens) এর মধ্যে ৬৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • চার ভাগের এক ভাগ কাপ সমপরিমাণ বাসায় তৈরি পুডিং এর মধ্যেঃ ৭৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • এক টেবিল চামচ Tahini (sesame seed butter) এর মধ্যে ৬৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে
  • এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ শালগমে (Turnip Greens) এর মধ্যে ৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ সমপরিমাণ রান্না করা পালং শাকে ৬০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা কাপ ক্যালসিয়াম ফরটিফাইড সিরিয়ালে ৫১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা কাপ ক্যালসিয়াম ফরটিফাইড soy beverage এর মধ্যে ৪০ থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।
  • আধা কাপ কাঁচা বাঁধাকপিতে ৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে’।
  • প্রায় সব ধরনের বাদামে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফাইবার, ভাইটামিন, পটাসিয়াম, আয়রন ও খনিজ পদার্থ। একমুঠো বাদামে ৭২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।

খাবারের মধ্যে ক্যালসিয়ামের পরিমাণে ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে সেটা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে খাবারের পরিমাণ, ব্র্যান্ড, গুণগত মান সহ আরো অনেক কিছুর উপর। এছাড়াও একটি শিশু তার শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী বর্ণীত খাবারের থেকে কম অথবা বেশি পরিমাণে খেতে পারে। শরীরের চাহিদা, ওজন এসবের উপর ভিত্তি করে শিশুর ভিটামিনের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন।

ফ্যাটের কারণে ক্যালসিয়ামের উপর কোন ধরনের প্রভাব পরে না, কিন্তু স্নেহ জাতীয় খাবারের ফ্যাট শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুই বছরের কম বয়সী শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা এবং মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য যে ক্যালোরির প্রয়োজন হয় সেগুলো তারা ফ্যাট থেকেই গ্রহণ করে।

তাই এই সময়ে পূর্ণ ননিযুক্ত দুধ এবং ফুল ফ্যাট স্নেহ জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। তবে আপনার শিশুর ডাক্তার যদি তাকে পূর্ণ ফ্যাট যুক্ত খাবার খাওয়াতে নিষেধ করে থাকেন তাহলে এর ব্যতিক্রমটা আপনি করতেই পারেন।

বিজ্ঞাপণ

এছাড়া জেনে রাখা ভালো যে, দুই বছরের বেশি বয়সী শিশুরা ফ্যাট থেকে খুব কমই ক্যালোরি গ্রহণ করে থাকে, তাই তখন তাদের শারীরিক ওজন এবং স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধির জন্য লো ফ্যাট স্নেহ জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন।

শিশুর ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে বাবা মায়েদের জন্য কিছু পরামর্শ

বিশেষজ্ঞদের মতে অনেক শিশুরই ক্যালসিয়ামের চাহিদা ঠিকমত পূরণ হয় না। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, এখনকার শিশুদের মধ্যে দুধ জাতীয় খাবার ছাড়াও অন্যান্য অনেক ধরনের জুস খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর সেগুলো বেশি পরিমাণে খাবার ফলে শিশুদের দুধ জাতীয় খাবারের ঘাটতি দেখা যায়, আর ফলাফল স্বরূপ এর প্রভাব পরে ক্যালসিয়ামের চাহিদার উপর। নিম্নের কিছু ধাপ অনুসরণ করে আপনি এটা সুনিশ্চিত করতে পারেন যে আপনার শিশু সঠিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাচ্ছেঃ

  • বাচ্চারা সাধারণত দুধ খেতে চায় না। সেক্ষেত্রে দুধ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার শিশুকে খেতে দিন। এতে কিছুটা হলেও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি মিটবে।
  • শিশুর জন্য যখন সিরিয়াল, হট চকোলেট অথবা সুপ বানান, তখন পানির বদলে দুধ ব্যাবহার করুন।
  • বিভিন্ন খাবারের মধ্যে সাধারণ দুধের বদলে শিশুকে জাল দিয়ে ঘন করা দুধ দিন, কেননা এর মধ্যে সাধারণ দুধ থেকে দুই গুন পরিমাণ বেশি ক্যালসিয়াম থাকে।
  • ফলের সালাদের মধ্যে দই মিশিয়ে দিন, প্যান-কেক, smoothie এবং সস বানানোর সময় দুধের গুড়ো মিশিয়ে দিন। এছাড়া শাক সবজী, সস এবং mashed potato এর মধ্যে চিজ মিশিয়ে শিশুকে খাওয়াতে পারেন।
  • আপনার শিশুর জন্য ক্যালসিয়াম ফর্টিফাইড জুস, পাউরুটি এবং সিরিয়াল কিনুন।
  • ভিটামিন ডি শরীরে বেশি পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণে সহায়তা করে। তাই প্রতিদিন শিশু যাতে ৬০০ IU (International units) পরিমাণে ভিটামিন ডি গ্রহণ করে সেটা সুনিশ্চিত করুন। রোদে ভিটামিন ডি থাকে যা শরীরের ক্যালসিয়াম শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়। তাই শিশুকে রোদে খেলতে দিন।

বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম কি শিশু গ্রহণ করতে পারবে?

রক্তে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম সাধারণত এক ধরনের শারীরিক অসুস্থতার কারণে হয়ে থাকে, অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার গ্রহণ করার কারণে নয়।

ইন্সটিটিউট অফ মেডিসিনের মতে, ১ থেকে ৮ বছর বয়সী একজন শিশুর  প্রতিদিন ২৫০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়। যেটা প্রায় ৮ আউন্স গ্লাসের পরিমাণে ৮ গ্লাস দুধের মধ্যে থাকে। তাই আপনার শিশু তার খাবার থেকে কত পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করছে সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ যদিও শুধুমাত্র ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেলে তার রক্তে বেশি পরিমাণ ক্যালসিয়াম পাওয়া যাবে, এমনটা আসলে সাধারণত হয় না।

তবে অপরদিকে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট এক ধরনের সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

কিছু বাড়তি সতর্কতামুলক কথাঃ আপনার শিশু যদি খুব বেশি পরিমাণে দুধ খেয়ে থাকে, তাহলে আপনার এটা নিশ্চিত করতে হবে যে শুধুমাত্র দুধ থেকেই আপনার শিশু বেশি পরিমাণে ক্যালোরি যাতে না গ্রহণ করে।

অন্যান্য সুষম খাবার একটা শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়, তাই আপনার শিশু বেশি পরিমাণে দুধ খাওয়ার কারণে অন্যান্য সুষম খাবার না খেয়ে থাকছে কি না, সেদিকেও লক্ষ্য রাখুন। এছাড়া, আরেকটি বিষয় জেনে রাখা ভালো যে বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment