১২ সপ্তাহের গর্ভাবস্থা | ভ্রূণের বৃদ্ধি, মায়ের শরীর এবং কিছু টিপস

Spread the love

পূর্ববর্তী সপ্তাহগুলোর মতই গর্ভাবস্থার ১২ সপ্তাহও ভ্রূণের বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে ৮-১২ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের ভ্রূণের আকার প্রায়  দ্বিগুণ হয়ে যায়।

এই সময়ের মধ্যে বাচ্চার সব অঙ্গ মোটামুটি গঠিত হয়ে যায় আর এখন থেকে এসব অঙ্গের পরিপূর্ণতা সাধিত হতে থাকে।

বিজ্ঞাপণ

সপ্তাহ ১২ বলতে বোঝায় গর্ভধারণের তিন মাস চলছে বা নির্দিষ্ট করে বললে দুই মাস তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে। আর দুই সপ্তাহের মধ্যেই গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার শুরু হবে।

গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি

গর্ভাবস্থার ১২ সপ্তাহ নাগাদ বাচ্চার সবগুলো তন্ত্রের বাহ্যিক গঠন মোটামুটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলেও এখনো এসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশ হওয়া এবং কাজ শুরু করতে অনেকটুকু সময় বাকি।

এসময় থেকে পরবর্তী ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত ভ্রূণের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিকাশের সাথে সাথে তারা নিজ নিজ কাজও শুরু করতে থাকবে।

গর্ভের শিশুটির আকার এই সপ্তাহে একটি বড় সাইজের বরইয়ের সাথে তুলনা করা যায়।এ সময় ভ্রূণের উচ্চতা থাকে প্রায় ২.১৩ ইঞ্চি বা ৫.৮ সেমি এবং এর ওজন হয় আনুমানিক .৪৯ আউন্স বা ১৪ গ্রামের মত। গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত শিশুর পা তার পেটের সাথে গুটানো অবস্থায় থাকে। তাই এ সময় পর্যন্ত ভ্রুনের উচ্চতা পরিমাপের জন্য ভ্রুনের উপরের অংশ থেকে নিচ পর্যন্ত উচ্চতা নেয়া হয়।

১২তম সপ্তাহের দিকে এসে গর্ভের ভ্রূণের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক বিকাশের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। সেগুলো নিম্নরূপঃ

মাথা এবং ঘাড়

ভ্রূণের মাথার আকার এখনো পুরো শরীরের আকারের প্রায় অর্ধেক। তার মুখের লালা গ্রন্থির কাজ এসময়ে শুরু হয়ে যেতে পারে। চোখ দুটো পরস্পরের দিকে আরও কাছাকাছি এসে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে চলে আসতে পারে।

হৃদস্পন্দন

এ সপ্তাহে ডপলার স্ক্যানে বাচ্চার হৃদস্পন্দন বোঝা যেতে পারে।

বুক

ভ্রূণের ফুসফুসের বিকাশ হতে থাকে এবং এসময় ভ্রূণ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড গ্রহন ও ত্যাগ করতে পারে।

পেট

ভ্রূণের পেটের বিভিন্ন অঙ্গগুলো, যেমন- স্প্লীন বা প্লীহা, ইন্টেস্টাইন এবং যকৃত এসময়ের মধ্যে গঠিত হয়ে যায়। এ সময় থেকে বাচ্চার পরিপাকতন্ত্রের পেশীগুলো সংকোচন প্রসারণ শুরু করতে পারে। এই সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমেই জন্মের পর তার খাবার তার মুখ থেকে পাকস্থলীতে যায়।

এখন পর্যন্ত ভ্রূণের পেটে জায়গা কম থাকায় তার ইন্টেস্টাইন বা নাড়িভুঁড়ি তার আম্বিলিকাল কর্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এ সপ্তাহ নাগাদ এসব তার পেটে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে চলে আসতে পারে। এসময় থেকে ভ্রূণের কিডনিও তার কাজ শুরু করতে পারে। ভ্রূণ যে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড গ্রহন করে তা কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবে রূপান্তরিত হয়ে ব্লাডারে জমা হয়।

জননাঙ্গ

ভ্রূণের জননাঙ্গ এই সময়ের মধ্যে প্রায় গঠিত হয়ে যেতে পারে।

হাত ও পা

ভ্রূণের হাতগুলো এখন অনেকটাই শরীরের সমানুপাতিক হয়ে যাবে তবে পাগুলো এখনো তুলনামুলকভাবে ছোট থাকার কথা।

রিফ্লেক্স

ভ্রূণের হাতের আঙ্গুলগুলো এসময় খোলা বাঁধা করতে পারে, পায়ের আঙ্গুলগুলো বাঁকা করতে পারে, চোখের পাতা মিটমিট করতে পারে এবং তার ঠোট দিয়ে চোষার মত ভঙ্গি করতে পারে।

চুল

ভ্রূণের শরীরে এ সপ্তাহ থেকে ধূসর বর্ণের চুল দৃশ্যমান হতে পারে। 

এছাড়াও এ সপ্তাহে ভ্রূণের থাইরয়েড ও প্যাঙ্ক্রিয়াস থেকে হরমোনের উৎপাদন শুরু হতে পারে। ভ্রূণের বোন ম্যারো শ্বেত রক্ত কণিকা তৈরি শুরু করতে পারে এবং ভ্রূণের ভোকাল কর্ডের গঠন ও শুরু হয়ে যেতে পারে। এ সময়ে ভ্রূণের চেহারা আরও স্পষ্টভাবে মানবশিশুর আকার ধারণ করে।

১২ তম সপ্তাহে মায়ের শারীরিক পরিবর্তন

মায়ের জরায়ু এসময় একটি বড়সড় কমলালেবুর আকৃতির হয়ে যায়। এ সপ্তাহ থেকেই জরায়ু পেলভিসের নিচ থেকে  পেটের দিকে বড় হতে থাকে। জরায়ুর আকার বাড়ার কারণে এসময় ডাক্তার হয়তো মায়ের পেটের নীচের দিকে জরায়ু অনুভব করতে পারবেন।

বিজ্ঞাপণ

জরায়ুর এ অবস্থান পরিবর্তনের কারণে মায়ের ব্লাডারের উপর থেকে কিছুটা চাপ কমে যেতে পারে যার কারণে ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ আসার সমস্যা কিছুটা কমে আসতে পারে।

এ সপ্তাহে মায়ের কোমরের সাথে সাথে স্তনের আকার বড় হতে পারে। এসময়ই হয়তো আপনার নতুন কাপড়ের প্রয়োজন পরবেনা তবে পুরনো কাপড়গুলো কিছুটা টাইট মনে হতে পারে।

অনেক মায়েরাই পেটের আকার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকেন। তবে কখনো কারও সাথে নিজেকে তুলনা করার চেষ্টা করবেন না। মায়ের পেটের আকার কেমন হবে তা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন- হরমোন, গর্ভাবস্থার আগের ওজন, কততম গর্ভাবস্থা এবং মায়ের পেটের পেশী ইত্যাদি।

এ সপ্তাহের একটি সুসংবাদ হতে পারে- এসময় থেকে মায়ের শরীরের HCG হরমোনের পরিমাণ কমতে থাকে কারণ এসময় থেকে প্লাসেন্টা প্রোজেস্টেরন হরমোন উৎপন্ন করা শুরু করে। HCG হরমোন কমে যাওয়ার কারণে এসময় থেকে মায়ের বমি বা বমি বমি ভাব, ঘন ঘন প্রসাব ইত্যাদি উপসর্গ কমে আসতে পারে।

তবে হরমোনের এ পরিবর্তনের কারণে কিছু নতুন উপসর্গ দেখা দিতে পারে আবার কিছু উপসর্গ একটু বেড়ে যেতে পারে-

স্কীন পিগমেন্টেশন

এ সময় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মেলানিন প্রোডাকশন বেড়ে যায়। ত্বকে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের পিগমেন্টরি ডিজঅর্ডার। হঠাৎ করে মুখে, গলায় কালো বা বাদামী যে ছোপ দেখা দেয়। একে অনেকে “মাস্ক অফ প্রেগন্যান্সি” বলে থাকেন।মাস্ক অফ প্রেগনেন্সিকে ক্লোয়েজমা বা মেলাজমা ও বলে। গর্ভবতী প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ  মায়েরাই এই সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন।

মাথা ঘোরা বা জ্ঞান হারানোর অনুভূতি

গর্ভবতী অনেক নারী মাঝে মাঝেই জ্ঞান হারানোর মতো অনুভব করেন। গর্ভাবস্থায় শরীরের হরমোনের পরিবর্তনের কারণেই এমন বোধ হয়।

যদি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আপনার জ্ঞান হারানোর মতো ভাব হয় তাহলে তাড়াতাড়ি কোথাও বসে পড়ুন,  যদি সম্ভব হয় দুই হাটুর মাঝখানে মাথা দিয়ে বসার চেষ্টা করুন (গর্ভাবস্থার শেষ দিকে যদিও এভাবে বসাটা সম্ভব নাও হতে পারে)। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারানোর ভাব কেটে যাবে।

যদি তা না হয় তাহলে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন। এতে শরীরে এবং মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে এবং অচেতন অনুভূতি আস্তে আস্তে কেটে যাবে।

মাথা ব্যাথা

কিছু কিছু মায়েদের মাথা ব্যাথা এসময় বেড়ে যেতে পারে। হরমোনের পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হয়। এছাড়াও ক্লান্তি, ক্ষুধা, পানিশূন্যতা, চাপ, সতেজ বাতাসের অভাবে এবং ব্যায়াম ইত্যাদি মাথা ব্যাথা হওয়া ও তার তীব্রতাকে প্রভাবিত করে।

তবে এসব ক্ষেত্রে হুটহাট ওষুধ না খেয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া উচিত। প্রচুর পরিমানে পানি খাওয়া, গরম পানিতে গোসল বা মাথা ম্যাসাজ এ ক্ষেত্রে উপকারি। এব্যাপারে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নিন।

যদি খুব বেশি ব্যাথা করে বা মাথা ব্যাথার ধরন আপনার অপরিচিত মনে হয় অথবা যদি এর সাথে অন্য আর কোন লক্ষণ থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারকে জানাতে হবে।

এসব ছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মায়েরা আরও অনেক ধরণের উপসর্গ অনুভব করতে পারেন। গর্ভকালীন সব ধরণের উপসর্গ নিয়ে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ুন।

এ সপ্তাহে করনীয়

গর্ভাবস্থার বারোতম সপ্তাহে প্রথম আলট্রাসাউন্ড করার পরামর্শ দেয়া হতে পারে । এর মধ্যে গর্ভপাতের ঝুঁকিও অনেকাংশে কমে যায় । সুতরাং এখন আপনি সবাইকে সুখবরটা জানাতেই পারেন।

বিজ্ঞাপণ

প্রথম আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান করার পর যদি দেখা যায় আপনার গর্ভফুল বা প্লাসেন্টার অবস্থান অবস্থান কিছুটা নিচে বা জরায়ু মুখের দিকে তাহলে চিন্তা করার কিছু নেই। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ২৮ সপ্তাহ নাগাদ প্লাসেন্টা জরায়ু মুখ থেকে সরে যায়।

ডাক্তারের কাছে যাবার সময় শিশুর বাবাকেও সম্ভব হলে সঙ্গে নিয়ে যান। তাহলে গর্ভাবস্থার বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে দু’জনে একসাথেই জানতে পারবেন।

গর্ভাবস্থার এই সময় থেকেই কেগেল এক্সসারসাইজ শুরু করার ভালো সময়। এই ব্যায়ামের ফলে ভ্যাজাইনার পেশীগুলো শক্তিশালী হয় যা সন্তান প্রসবের সময় এবং এর পর দ্রুত সেরে উঠতে বেশ কাজ দেয়। কেগেল ব্যায়াম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এবং এটি আপনার জন্য নিরাপদ কিনা তা জানতে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।

এছাড়াও গর্ভকালীন নিরাপদ ব্যায়ামগুলোও করা উচিৎ। এতে গর্ভকালীন অতিরিক্ত ওজন বহন করার শক্তি পাওয়া যায় এবং গর্ভকালীন বিভিন্ন ব্যাথা উপশমেও তা খুব কার্যকর।

নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি গ্রহন করতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান, গর্ভাবস্থার কিছু কমন সমস্যা, যেমন- অর্শরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ব্লাডার ইনফেকশনের ঝুঁকি কমায়।

গর্ভাবস্থায় যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই ওজন বৃদ্ধি পায় তাই নজর রাখতে হবে যাতে ওজন খুব বেশি বেড়ে না যায়। ওজন খুব বেশি বেড়ে গেলে বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ব্যাক পেইন, পায়ে ব্যাথা ইত্যাদি।

গর্ভাবস্থায় ডায়েটের ব্যাপারেও খুব সচেতন থাকতে হবে। এখনো যদি শুরু করে না থাকেন তবে এটাই একটা ব্যালান্সড ডায়েট শুরু করার সঠিক সময়। আপনার উপযোগী ডায়েট নিয়ে আপনার ডাক্তারের সাথে বা একজন পুষ্টিবিদের সাথে আলাপ করে নিন।

সবার জন্য শুভকামনা।

<<গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ১১
গর্ভাবস্থা সপ্তাহ ১৩>>


Spread the love

Related posts

Leave a Comment