৩-৬ মাস বয়সী শিশুর বিকাশে যেভাবে সাহায্য করবেন

Spread the love

৩-৬ মাসে পরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য

জন্মের সময় শিশুদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণভাবে পরিণত থাকেনা। শিশুরা যখন বিভিন্নধরনের শব্দ, ঘ্রাণ, দেখার জিনিস, স্নেহ এবং প্রীতি পূর্ণ স্পর্শের অভিজ্ঞতা লাভ করে, তখন তাদের মস্তিষ্ক এ-সবের সাথে সমন্বয় সাধন করে যার মাধ্যমে তারা ভাষা শেখে, সমস্যা সমাধান করতে, এমনকি পরবর্তী জীবনে গণিত সংক্রান্ত বিষয়সমূহ সমাধান করতে শেখে।

আপনার ও প্রাপ্ত বয়স্ক যারা শিশুদের দেখাশোনা করেন তাদের সাথে পারশপরিক সম্পর্ক শিশুদের মনের মাঝে সামাজিক ও মানসিক আবেগ জাগিয়ে তোলে। আপনি যখন কথা বলেন, গান করেন, জড়িয়ে ধরেন এবং আপানার শিশুর ডাকে সাড়া দেন, আপনি তার পূর্ণতা বিকাশে সাহায্য করেন।

বিজ্ঞাপণ

৩-৬ মাস বয়সী বাচ্চার যা যা দরকার 

বাচ্চা এখন দ্রুত বড় হয়ে উঠছে তাই তার ঘন ঘন দুধ খাওয়া দরকার। চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে যে কোন সময় সে শক্ত খাবার খাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠবে। তাকে শক্ত খাবার আস্তে আস্তে অভ্যস্ত করাতে হবে। একবার একধরনের খাবার খাওয়ানো উচিত যাতে তার অ্যালার্জি আছে কিনা তা বোঝা যায়। সে যে খাবার খেতে চায়না তা তাকে খেতে জোর করা উচিত নয়।

যদি আপনি তাকে আদর করার সময় সে বিরক্ত হয় তবে বুঝবেন সে অত্যন্ত ক্লান্ত বা অতিমাত্রায় উত্তেজিত। সে একটু শান্ত হলে তাকে নিরাপদ ও শান্ত পরিবেশে রাখার চেষ্টা করুন। এখন বাচ্চা দুরের জিনিষও দেখতে পায়, এবং সে নানা ধরনের জিনিসের দিকে তাকাতে চাইবে। মাঝে মাঝে তার অবস্থান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিন এবং তাকে বাইরে নিয়ে যান। তার বিছানায় বা খেলার জায়গায় চলনশীল জিনিসপত্র তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বাচ্চাকে কথা বলতে ও শোনার দক্ষতা অর্জনে আপনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। সে যদি কলকল শব্দ করে তখন আপনি কথা বলুন। সে উত্তর দিবে। আপনি তার শব্দ করা শুনুন এবং তারপর তার উত্তর দিন। ঠিক বড় মানুষদের মতন।

আপনার শিশুর বিকাশে সাহায্য করুন

নিরাপত্তা

  • কাপড়-বদলানোর টেবিলে অথবা বিছানায় আপনার শিশুকে কখনও একা রাখবেন না। ডায়াপার বদলানোর সময় সর্বদা আপনার হাত তার ওপর রাখবেন যেন সে পড়ে না যায়।
  • তার নাগালের বাইরে জিনিসপত্র রাখবেন যে এ-সব সে মুখে পুরতে না পারে।
  • আপনার শিশুকে কখনোই একা রাখবেন না। এক সেকেন্ডের জন্যও না।

নিশ্চয়তা

  • আপনার শিশুর দিকে তাকিয়ে যথেষ্ট হাসবেন। খুব শীঘ্রই সেও পাল্টা হাসি হাসতে শুরু করবে।
  • আপনার বাচ্চা বার বার একই ধরনের ছোট ছোট ছড়া ও গল্প শুনতে, কিংবা লুকোচুরি, টুকি দেওয়া ইত্যাদি খেলা অনেকবার ধরে খেলতে পছন্দ করবে।
  • একজন মা কিংবা বাবা হিসেবে আপনিই হলেন আপনার বাচ্চার সবচেয়ে ভালো খেলার সাথী। তাই তার সঙ্গে খেলা করার জন্য প্রতিদিনই সময় দেয়ার চেষ্টা করুন।
  • তাকে খেলনা বা এমন ধরনের জিনিস দিন যেগুলি সে মুখে দিলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই এবং সেগুলি নিয়ে তার সাথে কথা বলুন। খেলার জন্য প্রচুর খেলনা কেনার দরকার নেই- আপনার বাচ্চা বাড়ির নানা নিরাপদ, সহজ জিনিসপত্র নিয়েই খেলতে পারে।
  • আপনার কণ্ঠস্বরই বাচ্চার কাছে তার প্রিয় সঙ্গীত। সুতরাং তাকে গান গেয়ে শোনান, এমনকি যদিও আপনার মনে হয় যে আপনার গলা ভালো শোনাচ্ছে না। আপনার বাচ্চা আপনার সমালোচনা করবেনা। টিভি বা রেডিও চালানো থাকলে সেটা বন্ধ করে দিন যাতে আপনার বাচ্চা আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
  • আপনার বাচ্চা যখন ক্লান্ত বা বিচলিত বোধ করবে তখন থাকে সান্তনা দেয়ার জন্য তার কোন প্রিয় গান ধীরে ধীরে ও নিচু গলায় গাওয়ার চেষ্টা করুন।

স্বাস্থ্য

  • আপনার শিশুকে ঘুম পাড়ানোর সময় যদি মুখে বোতল দিতে চান, তাতে শুধু পানি বা দুধ দেবেন। ফলের রসে বা দুধে যে চিনি থাকে তা তার মাড়ি বা নতুন দাঁত- ওঠাতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
  • আপনার শিশুকে বিছানায় শোয়ানোর সময় হাতে বোতল দেবেন না। তার মুখের হাসিটা এতে ব্যাহত হতে পারে।
  • শিশুকে বসতে শেখানোর জন্য, তার পা দুটো ছড়িয়ে রাখুন যাতে ওর শরীরের ওজনের ভারসাম্য থাকে৷ এটা তার উল্টে পড়ার ভয় কমিয়ে দেয়। এইভাবে তাকে বসিয়ে দেওয়ার পরে,  সামনে তার প্রিয় খেলনা রেখে দিন৷ শিশুর চারপাশে কম্বল বা বালিশ ঠেস দিয়ে রাখুন যাতে পড়ে গেলে ব্যথা না লাগে৷ তার প্রতি নজর রাখার জন্য কাছাকাছি থাকুন৷
  • এছাড়া আপনার শিশুকে পেটে ভর দিয়ে খেলতেও উৎসাহিত করতে পারেন৷ একটা খেলনা দেখার জন্য আপনার শিশুকে যে মাথা ও বুক উপরদিকে তুলে রাখতে হবে তাতে ওর ঘাড়ের মাংসপেশী মজবুত হবে এবং বসে থাকার জন্য তার মাথার ভার সামলানোর ক্ষমতারও বিকাশ হবে৷

জ্ঞান অর্জন

  • আপনার শিশুকে যা কিছু বলবেন ভালো করে ব্যাখ্যা সহকারে বলবেন, যেমন, “তোমার বাবা এখন তোমাকে হাঁটাতে নিয়ে যাবে”
  • খেলার সময় যা খেলছেন তার সঙ্ঘে মানানসই প্রচুর শব্দ করুন, যেমন- একটা গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সময় “ভ্রমম-ভ্রমম” বা ঐ ধরনের আওয়াজ। এসব করলে আপনার বাচ্চা নানা ধরনের শব্দ শুনবে এবং এটাও শিখবে যে লোকজনের গলার আওয়াজ শোনা একটা মজার ব্যাপার।
  • আপনার শিশুকে হাত বাড়াতে, কিছু ধরতে, অথবা কিছু ধরলে সেটা হাতে রাখতে সুযোগ দেবেন। তাকে বাহবা দেবেন।
  • ছোট বাচ্চারা খেলাধুলার ভেতর দিয়েই সবচেয়ে ভালো শিখতে পারে, সুতরাং গান এবং ছড়াকে মজার খেলাই পরিনত করুন। আপনার গলার স্বর বার বার বদলান, কিছু অঙ্গভঙ্গী করুন অথবা আপনার বাচ্চার অথবা পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধবের নাম যোগ করুন।

সমন্বয় সাধন

  • আপনার শিশুর ধারেকাছে থাকাকালীন কারও সাথে রেগে বা উচুগলায় কথা বলবেন না।
  • আপনার শিশুকে তার নাম ধরে ডাকবেন এবং তার সাথে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও সেইসঙ্গে তার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবেন।

কি আশা করতে পারেন

মনে রাখবেন প্রত্যেক শিশু আপনাপন গতিতে বিকাশলাভ করে। এগুলো শুধু নীতিসম্পর্কিত নির্দেশাবলী। আপনার শিশুর বিকাশলাভ সম্পর্কে আপনার যদি কোনো উদ্বেগ থাকে, তাহলে আপানার ডাক্তার বা অন্য কোন বিশ্বাস ভাজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করুন।

  • আপনার শিশু কথা বলা শুরু করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এবং সে কলকল করে বা অসংলগ্নভাবে শব্দ করবে।
  • উপুড় হয়ে শোয়া অবস্থায় সে তার মাথা উঠাতে চেষ্টা করবে এবং পাশাপাশি গড়াতে থাকবে।
  • সে কোন কোন জিনিসের নাগাল পেতে চাইবে কিংবা সেটা ধরে রাখতে চেষ্টা করবে।। ঝুঁকিপূর্ণ নয় এবং চুষতে পারে এমন জিনিস তাকে দেবেন কারন যা কিছুই সে ধরবে সেগুলো সে সোজা তার মুখে পুরতে পারে।
  • সে কোলাহলপূর্ণ শব্দে ভয় পেতে পারে যেমন রাগান্বিত স্বরে কথা বলা,কুকুরের ডাক কিংবা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ। তাকে আপনার শরীরের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখুন এবং ভয় না পেতে আশ্বস্ত করুন।

এসময় থেকে আপনার বাবুর খাবারের চাহিদা বেড়ে যাবার কথা। আস্তে আস্তে ওজন ও আগের চেয়ে বাড়ার কথা। এসময় প্রতিবার খাবার সময় পরিমানে বেশী খাবে, তবে একবার খাবার সময় থেকে পরের বার খাবার সময়ের মধ্যবর্তী গ্যাপ বাড়তে থাকবে। কারণ তার পাকস্থলী এসময় থেকে কিছুটা বড় ও পরিপক্ব হবার দিকে অগ্রসর হয়।

বিজ্ঞাপণ

চার থেকে ছয় মাসে পর্যন্ত আস্তে আস্তে তার পাকস্থলী সলিড খাবারের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে, এক এক বাচ্চার ডেভেলপমেন্ট এক এক রকম , তাই অন্ততপক্ষে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ মাসের আগে সলিড/ সেমি সলিড শুরু না করাটাই শ্রেয়।

তিন থেকে চার মাসের যেকোনো পর্যায়ে বাচ্চা আপনাকে অবাক করে দিয়ে উপুড় হতে এবং গড়িয়ে যেতে শুরু করবে। যেহেতু শিশু হুট করেই গড়াতে এবং উল্টাতে শুরু করে আপনাকে দু-তিন মাস হওয়ার সময় থেকেই খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন উঁচু কোন জায়গা বা বিছানায় বাচ্চাকে অরক্ষিত রাখা না হয়। সবচে’ ভালো হয়, দিনের বেলা যখন আপনাকে এদিক ওদিক যেতে হয় বিভিন্ন কাজে, সেসময় মেঝেতে পরিস্কার তোশক কিংবা ম্যাট বিছিয়ে বাবুকে রাখলে।

৪ থেকে ৭ মাস বয়সে আপনার শিশু বসে থাকার মত যথেষ্ট শক্তপোক্ত হয়ে যায়৷ যদি তাকে আপনার কোলে বসিয়ে রাখেন বা মেঝেতে বসিয়ে দেন, তাহলে কয়েক মুহূর্ত আপনার কোনোরকম সাহায্য ছাড়া সে হয়ত বসে থাকতে পারবে৷শিশুকে বসতে শেখানোর জন্য, তার পা দুটো ছড়িয়ে রাখুন যাতে ওর শরীরের ওজনের ভারসাম্য থাকে৷ এটা তার উল্টে পড়ার ভয় কমিয়ে দেয়।

এইভাবে তাকে বসিয়ে দেওয়ার পরে,  সামনে তার প্রিয় খেলনা রেখে দিন৷ শিশুর চারপাশে কম্বল বা বালিশ ঠেস দিয়ে রাখুন যাতে পড়ে গেলে ব্যথা না লাগে৷ তার প্রতি নজর রাখার জন্য কাছাকাছি থাকুন৷

এসময় বাচ্চার মানসিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। শ্রবণ ক্ষমতা ও দৃষ্টি শক্তি পরিপক্কতা লাভ করে। বাচ্চা শক্ত ভাবে কিছু ধরতে, মুঠো ছেড়ে দিতে শেখে। রঙিন ও শব্দ যুক্ত খেলনার প্রতি অনেক বেশী আকৃষ্ট হয়। পরিবারের সদস্যদের আলাদাভাবে চিনতে শেখে এবং বিশেষ প্রিয় ব্যাক্তিটির প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে। এ সময় থেকেই বাচ্চার মধ্যে Separation Anxiety পরিলক্ষিত হয়। বিশেস করে কর্মজীবী বাবা মায়েরা কাজে থাকাকালীন সময়ে বাচ্চা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে।

মাস অনুযায়ী শিশুর বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে পড়ুন-

আপনার নিজের যত্ন নেবেন

নতুন শিশুর আগমন খুবই রোমাঞ্চকর এবং একটি খুশির ঘটনা, হোক সে প্রথম বা চতুর্থ। কিন্তু এটি আবার পরিবর্তনেরও সময়। সংসারের বাড়তি কাজগুলো পরিবারের সকলে কিভাবে ভাগ করে নেবে, কে কোন কাজটা করবে এই সকল বিষয়গুলো নিয়ে পরিবারের সদস্যরা কথা বলা উচিত।

কেউই সম্পূর্ণ বা নির্ভুল নয়। সবকিছুই যে আপনাকে সঠিকভাবে করতে হবে এমন নয় এবং সবকিছুই যে আপনাকেই করতে হবে তাও ঠিক নয়। মেনে নিন যে আপনি আগের মত ঘন ঘন বাইরে যেতে পারবেন না কিংবা আগের মত ঘরটা গুছিয়ে রাখতে পারবেন না। পড়াশোনা করতে, গানবাজনা শুনতে, টেলিভিশন কিংবা আরাম গোসল করতে আপানার নিজের জন্য কিছু সময় বের করে নেয়ার চেষ্টা করবেন (অন্তত দৈনিক ৩০ মিনিট)

পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের সাহায্য চাইতে পারেন যেন আপনি এবং আপনার সঙ্গী শিশুর কাছ থেকে দূরে গিয়ে কিছু সময় কাটাতে পারেন।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment