শিশুর পেটে গ্যাস : কারণ, লক্ষন ও করণীয়

Spread the love

শিশুর পেটে গ্যাস হলে মা-বাবা চিন্তায় পড়ে যান কী করলে ভালো লাগবে, কান্নাকাটি একটু থামবে কিংবা কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেন, বাচ্চার পেটে বাতাস লেগেছে, দুধে বাতাস লেগেছে, যার কারণে বমি করে দিচ্ছে।আসল কথা হলো, পেটে গ্যাস বাচ্চাদেরও হয় আবার বড়দেরও হয়। বাচ্চারা বলতে পারে না যে তাদের কেমন লাগছে আর তাই আমরা বুঝতেও পারি না।

শিশুর পেটে গ্যাস কেন হয়?

বাচ্চার পেটে গ্যাস হওয়ার বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। জন্মের তিন মাস পর্যন্ত নবজাতকের গ্যাসের সমস্যা খুবই স্বাভাবিক কারণ এ সময় বাচ্চার পরিপাক্তন্ত্র ধীরে ধীরে সুগঠিত হয়। ৬-১২ মাস পর্যন্তও এটা স্বাভাবিক কারণ এ সময় বাচ্চা বিভিন্ন ধরনের খাবার প্রথম বারের মত খাওয়া শুরু করে।

বিজ্ঞাপণ

বাচ্চার পেটে যখন গ্যাস হয় তখন তার পাকস্থলী বাতাসের কারণে ফুলে যায় যা বাচ্চার হজমের প্রক্রিয়ার কারণে হতে পারে বা খাওয়ার সময় বাচ্চার পেটে বাতাস ঢুকে যাওয়ার কারনেও হতে পারে। শিশুর পেটে গ্যাস হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ হলো-

খুব দ্রুত খাওয়াঃ যদি বাচ্চার মায়ের বুকের দুধ বেশী থাকে বা বোতলে খাওয়ানো বাচ্চার বোতলের নিপলের ছিদ্র যদি বড় থাকে তবে বাচ্চা খুব দ্রুত দুধ গিলতে থাকে এবন সেই সাথে বাতাসও বাচ্চার পেটে চলে যায়, যার কারণে গ্যাস হতে পারে।

খুব আস্তে খাওয়াঃ একইভাবে মায়ের বুকে দুধ কম আসলে বা বোতলের ছিদ্র বেশী ছোট হলে বাচ্চার দুধ খাওয়ার সময় অতিরিক্ত বাতাস বাচ্চার পেটে চলে যায় এবং গ্যাস তৈরি করে।

বোতলের দুধে ফেনা থাকলেঃ বাচ্চাকে ফর্মুলা খাওয়ানো হলে ফর্মুলা তৈরি করার সময় বোতল যত বেশী ঝাঁকানো হয় তত বেশী তাতে ফেনা হয়। এতে বাচ্চার পেটে গ্যাস হতে পারে। তাই দুধ তৈরি করার পর কিছুক্ষণ রেখে দিন যাতে ফেনা কমে যায়। এরপর বাচ্চাকে খেতে দিন।

দুধের কোন নির্দিষ্ট প্রোটিন এর কারণেঃ  বাচ্চার যদি বুকের দুধ খায় তবে মায়ের ডায়েটের কোন প্রোটিনের কারণে বাচ্চার পেটে গ্যাস হতে পারে। মা ডেইরি প্রোডাক্ট খেলে এ সমস্যা বেশী দেখা যায়। কিসের কারণে হচ্ছে তা নিশ্চিত করা গেলে তা মায়ের ডায়েট থেকে বাদ দিন।

যদি বাচ্চা ফর্মুলা খায় তবে ফরমুলার কোন প্রোটিন হয়ত বাচ্চার সহ্য হচ্ছেনা তাই গ্যাস হচ্ছে। এমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ফর্মুলা পরিবর্তন করে দেখতে পারেন। মায়ের ডায়েটের কারণে হচ্ছে মনে হলে মায়ের ডায়েট থেকে একবারে একধরনের খাবার বাদ দিয়ে দেখুন বাচ্চার সমস্যা কম হচ্ছে কিনা।

কিছু কিছু খাবারের কারণেঃ বড়দের মত বাচ্চাদের কিছু কিছু সবজিতে পেটে গ্যাস হতে পারে। যেমন- ব্রকলি এবং বাঁধাকপি। এগুলো যদি খুবই স্বাস্থ্যকর এবং খাওয়া উচিত তারপরও চেষ্টা করুন যাতে খুব বেশী পরিমাণে খাওয়ানো না হয়।

ছয় মাস বয়সের পর বুকের দুধের পাশাপাশি একটু বাড়তি খাবার দেওয়া হয়। এতেও অনেক সময় পেটে গ্যাস হতে পারে। এসব শিশুর বাড়তি খাবারে বিভিন্ন প্রকার ফল বা শাকসবজি দিয়ে খিচুড়ি এবং মাছ-মাংস ও ডিম থাকে।

অনেক সময় খিচুড়িতে শাকের পরিমাণ বেশি হলে গ্যাস হওয়ার ঝুঁকি থাকে আবার ডালেও গ্যাস হতে পারে, এমনকি সিদ্ধ ডিমেও গ্যাস হতে পারে। তাই উচিত বাড়তি খাবার দেওয়ার সময় খাবারের দিকে নজর রাখা। যেমন- খিচুড়িতে শাক ও ডালের পরিমাণ কম দিয়ে কাঁচা কলা বা কাঁচা পেঁপের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া।

জুস খাওয়ার কারণেঃ  বাচ্চাদের মায়ের দুধ এবং ফর্মুলা ছাড়া অন্য কোন পানীয় খাওয়া উচিত নয়। যদি ৬ মাস হয় তবে পানি খেতে পারে। জুসে যে ফ্রুক্টোস ও সুক্রোস থাকে তা বাচ্চা ঠিকমত হজম করতে পারেনা। এর ফলে বাচ্চার পেটে গ্যাস এমনকি ডায়রিয়াও হতে পারে।

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না খাওয়াঃ বাচ্চা ৬ মাস হওয়ার পর পর্যাপ্ত পানি খেলে তার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে অনেক সময় পেটে গ্যাস ও ব্যাথা হয়। ৬ মাস বয়সী বাচ্চাকে দৈনিক বুকের দুধ বা ফর্মুলার পাশাপাশি ২-৪ আউন্স পানি খাওয়াতে হবে। বাচ্চার বয়স ১২ মাস হলে তা বাড়িয়ে ৪-৬ আউন্স করুন।

বাচ্চার অতিরিক্ত কান্নার কারণেঃ  বাচ্চা অনেক্ষন ধরে কান্না করতে থাকলে তার পেটে বাতাস ঢুকে যেতে পারে। তাই বাচ্চার কান্না যত দ্রুত সম্ভব থামানো উচিত।

কিভাবে বুঝবেন বাচ্চার পেটে গ্যাস হয়েছে?

বাচ্চার পেটে গ্যাস হচ্ছে কিনা সেটা বোঝাটা কষ্টকর কারণ বাচ্চা নিজ থেকে তার অসুবিধাগুলো বলতে পারেনা। তবে কিছু কিছু লক্ষন তার মধ্যে দেখা যেতে পারে-

  • চেহারা লাল হয়ে যাওয়া
  • কান্নাকাটি করা
  • খাওয়ার পর মোচড়ানো
  • হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা
  • পা ভাজ করে পেটের কাছে নিয়ে আসা ইত্যাদি।

তাছারা বাচ্চা যদি ঢেঁকুর তুলে বা বায়ু ত্যাগ করে তাহলে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবেন যে তার গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে।

তবে মাঝে মাঝে গ্যাসের সমস্যার এ লক্ষনগুলো অন্য কোন সমস্যারও ইঙ্গিত করতে পারে। বাচ্চা যদি ঢেঁকুর তোলার পর বা বায়ু ত্যাগ করার পরও কান্নাকাটি করতে থাকে তবে ধরে নিতে পারেন তার অন্য কোন সমস্যা হচ্ছে, যেমন- রিফ্লাক্স, কোষ্ঠকাঠিন্য বা কলিক।

বাচ্চার রিফ্লাক্স থাকলে তার পাকস্থলীর খাবার অন্ননালী দিয়ে উঠে এসে মুখ দিয়ে বের হয়ে যায় বা বমি হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বাচ্চার কষ্ট হয় এবং তার পিঠ বাকা করে ফেলে কিন্তু গ্যাসের সমসসার মত পা ভাজ করে পেটের কাছে আনেনা। গ্যাস এবং রিফ্লাক্সের মধ্যে পার্থক্য বোঝাটা জরুরী কারণ বাচ্চার রিফ্লাক্স থাকলে যদি ঢেঁকুর তোলা হয় তবে তা আরও খারাপ হতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণেও বাচ্চার পেটে গ্যাস হওয়ার মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে এ সময় বাচ্চা মোচড়াতে থাকে। তবে কোষ্ঠকাঠিন্য বোঝাটা সহজ কারণ তা হলে বাচ্চার পায়খানা করতে কষ্ট হয় এবং পায়খানা শক্ত হয়ে যায়।

বাচ্চার অতিরিক্ত কান্নার কারণেও মাঝে মাঝে মনে হতে পারে বাচ্চার পেটে গ্যাস হয়েছে। কিন্তু এটা কলিকের কারনেও হতে পারে।  শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে আপনার বাচ্চা যদি সাধারানত দিনে তিন ঘণ্টা বা তার বেশী, সপ্তাহে তিন বা চার দিনের বেশী এবং একটানা তিন চার সপ্তাহের বেশী কান্না করতে থাকে এবং তার যদি কোন ব্যাখ্যা না থাকে, ধরে নিতে পারেন বাচ্চা হয়ত কলিক

বাচ্চার গ্যাসের সমস্যা সমাধানে কি করা যেতে পারে?

বাচ্চাকে গ্যাসের কারণে কষ্ট পেটে দেখতে সব বাবা মায়েরই খারাপ লাগে। তবে কিছু কিছু পদ্ধতিতে আপনি বাচ্চার পেটে গ্যাস বের করে দিয়ে তার কষ্ট কমাতে পারেন।

বিজ্ঞাপণ

দুধের বোতল

বাচ্চা যদি বোতলে দুধ খায় তবে খেয়াল রাখুন যাতে দুধ খাওয়ার সময় বাচ্চার পেটে বাতাস বেশী না যায়। বোতল উচু করে ধরুন যাতে বোতলের নিপল দুধ পরিপূর্ণ থাকে। নিপল খালি থাকলে দুধের সাথে সাথে বাতাস বাচ্চার পেটে যেতে পারে।

বোতলের নিপলের ছিদ্র যাতে বেশী ছোট বা বেশী বড় না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নিপল বেশী বড় বা ছোট হলে বাচ্চার ঢোক গিলতে হয় বেশী যা গ্যাস উদ্দ্রেক করে। বাজারে এখন অ্যান্টি কলিক অনেক ফীডিং বোতল কিনতে পাওয়া যায় যেগুলো বাচ্চার পেটে বাতাস যাওয়ার পরিমান অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করে।

খাওয়ানোর সময় বাচ্চার পজিশন

বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় তার উপরিভাগ উঁচু করে ধরুন যাতে দুধ সহজে এবং দ্রুত তার পেটে যেতে পারে। যদি খাওয়ানোর সময় বাচ্চা বাকা হয়ে থাকে তবে গ্যাস বেশী হতে পারে।

খিদে পাওয়ার আগেই খাওয়ান

বাচ্চাকে খিদে পাওয়ার আগেই খাওয়ান। যদি সে খিদের কারণে কাঁদতে থাকে তবে কান্নার সাথে সাথে যেমন পেটে বাতাস যায় তেমনি খাওয়ানোর সময় সে খিদের কারণে তারাতারি খেতে চায় বলে বেশী বেশী ঢোক গিলতে থাকে এবং সেই সাথে বাতাসও। খাওয়ানোর সময় বাচ্চাকে শান্ত পরিবেশে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।

ঢেঁকুর তুলুন 

খাওয়ানোর সময় বার বার ঢেঁকুর তোলালে বাচ্চার পেট থেকে বাতাস বেরিয়ে যায়। বাচ্চার খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় স্তন পরিবর্তন করার আগে বা বোতলে দুধ খাওয়ানোর সময় কয়েক মিনিট পর পর বাচ্চার ঢেঁকুর তুলুন। খাওয়ানোর ঠিক পরপর আবার ঢেঁকুর তোলাতে হবে।

ঢেঁকুর তোলানর জন্য বাচ্চাকে আপনার কাঁধে এমনভাবে নিন যাতে তার থুতনি আপনার কাঁধে থাকে। একহাতে বাচ্চাকে ধরুন এবং আরেক হাত দিয়ে বাচ্চার পিঠ মাসাজ করে দিন বা আস্তে আস্তে চাপড়ে দিন।

বাচ্চা যদি তার মাথা তুলে ধরার মত উপযোগী হয় তবে তাকে এমনভাবে কাঁধে নিতে পারেন যাতে তার পেট আপনার কাঁধে লেগে থাকে এবং এরপর আস্তে আস্তে তার পিঠ চাপড়ে দিন বা মাসাজ করে দিন। এতে বাচ্চার পেটে আরেকটু বেশী চাপ পড়বে।  এভাবে যদি বাচ্চা পছন্দ না করে তবে বাচ্চাকে কোলে উপুড় করে শুইয়ে তার পিঠ মাসাজ করে দিতে পারেন।

বেবী বাইসাইকেল

বাচ্চাকে চিৎ করে শোয়ান। তার পা দুটো দু হাতে ধরে আস্তে আস্তে সাইকেল চালানোর ভঙ্গিতে নাড়াতে থাকুন। দিনে বেশ কয়েকবার এভাবে বাচ্চার মুভমেন্ট করান। ডায়াপার পাল্টানোর সময় করতে পারেন। অনেক বাচ্চার ক্ষেত্রেই এতে গ্যাস বেরিয়ে যায়।

পেটে মাসাজ করুন

বাচ্চাকে চিৎ করে শুইয়ে আস্তে আস্তে তার পেট মাসাজ করতে পারেন। এতে বাচ্চার রিলাক্স হওয়ার পাশাপাশি গ্যাস সমস্যার উপসম হতে পারে। এছাড়াও বাচ্চাকে আপনার হাঁটুর উপর পেটে ভর দিয়ে শুইয়ে তার পিঠে মাসাজ করে দিতে পারেন। এর ফলে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত বাতাস বেরিয়ে যায়। খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চার মাথা যেন ঝুঁকে না যায়। এজন্য এভাবে মাসাজ করার সময় আরেক হাতে বাচ্চাকে সাপোর্ট দিতে হবে।

গ্যাসের ওষুধ ও অন্যান্য

অনেক বিশেষজ্ঞই বাচ্চার গ্যাসের সমস্যা নিরাময়ে বিভিন্ন গ্যাসের ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গ্রাইপ ওয়াটার ও অনেক সময় ব্যাবহার করা হয়। এগুলোতে শিশুর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারনত পাওয়া যায়নি তবে বিভিন্ন গবেষণাতে এটাও প্রমানিত হয়নি যে এগুলো খুব বেশী একটা কার্যকর। বাচ্চার গ্যাসের সমস্যা কেন হচ্ছে সেটা আগে চিহ্নিত করা দরকার এবং সে সমস্যাটার সমাধান জরুরী।

যদি কোন খাবারের কারণে বাচ্চার গ্যাস হয় সেটা আগে চিহ্নিত করতে হবে। নয়ত যে কাজটার কারণে তার সমস্যা হচ্ছে সেটা চলতেই থাকবে আর তাকে বিভিন্ন ওষুধও খাওয়ানো হবে। এতে তার ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবেনা।

মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ করাটাই উত্তম। তাই উপরে যে পদ্ধতির কথাগুলো আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো চেষ্টা করে দেখুন। একেবারেই যদি কিছু না হয় বা বাচ্চা বেশী কষ্ট পায় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করাতে পারেন।

কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে? 

যদি বাচ্চার গ্যাসের সমস্যার সাথে অন্যান্য আরও কিছু লক্ষন দেখা যায়, যেমন- বমি, ডায়রিয়া বা জ্বর তবে দ্রুত ডাক্তারকে জানান। এগুলো বাচ্চার ফুড অ্যালার্জি, স্টোমাক ফ্লু বা GERD এর লক্ষন হতে পারে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment