শিশুকে ভালোভাবে বুকের দুধ খাওয়া শেখাতে কিছু পরামর্শ

Spread the love

আপনি নিচের বিষয়গুলো অনুসরণ করার মাধ্যমে আপনার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়া শেখার জন্য সাহায্য করতে পারেন।

  • আপনার শিশুর ত্বকের সাথে ত্বক লাগিয়ে ধরে রাখা
  • শিশুর সহজাতভাবে স্তন মুখে ঢুকানো অনুশীলন করে
  • আপনার শিশুর ইঙ্গিতগুলো অনুসরন করে
  • হাত চাপ দিয়ে কিভাবে শালদুধ এবং বুকের দুধ বের করতে হয় তা শিখে।

ত্বকের সাথে ত্বক লাগানো

ত্বকের সাথে ত্বক লাগানো হল আপনার শিশুকে ধরার একটি উপায় যা শিশু এবং পিতা-মাতা উভয়ই উপভোগ করে। শিশু শুধুমাত্র একটি ডায়াপার পরা থাকে এবং খাড়া অবস্থানে ধরা থাকে। শিশুর বুক মায়ের বুকের উপর ত্বকের বিপরীতে থাকে। শিশুর নাক ও মুখ দৃশ্যমান থাকা এবং তার মাথা উঁচু করার জন্য মুক্ত থাকা নিশ্চিত করুন।

বিজ্ঞাপণ

একটি পাতলা কম্বল শিশুর পিঠের উপর আড়াআড়ি করে রাখা যেতে পারে। যখন শিশুদের ত্বকের সাথে ত্বক লাগিয়ে রাখা হয় তখন তারা ময়ের হৃদস্পন্দন ও শ্বাস শুনতে পারে এবং তার গায়ের ঘ্রান ও ত্বক অনুভব করতে পারে। এটি শিশুদের কাছে পরিচিত এবং স্বস্তিকর এবং তাদের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে ব্যাবহার করতে সাহায্য করে।

ত্বকের সাথে ত্বক লাগানোর গুরুত্ব

  • আপনার শিশুকে নিরাপদ ও নিরাপত্তাবোধ করতে সাহায্য করে
  • আপনার শিশুর হৃদস্পন্দন, শ্বাস এবং রক্তের শর্করাকে স্থির রাখে।
  • আপনার শরীরের তাপের মাধ্যমে আপনার শিশুকে উষ্ণ রাখে।
  • বন্ধন গড়ে এবং একে অন্যকে জানার ক্ষেত্রে গতি সঞ্ছার করে।
  • আপনার শিশুকে শান্ত হতে এবং কান্নাকাটি কম করতে সাহায্য করে।
  • আপনাকে আরও আত্মবিশ্বাসী এবং নিরুদ্বেগ হতে সাহায্য করে।
  • আপনার দুধ প্রবাহিত হতে সাহায্য করে এবং আপনার দুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারে।
  • মায়ের স্তন মুখে ঢুকাতে উৎসাহিত করে। এর অর্থ হলো আপনার স্তনের বোঁটাগুলো যন্ত্রণাপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং আপনার শিশু বেশি দুধ পাবে।

জন্ম দেয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার শিশুকে ত্বকের সাথে ত্বক লাগিয়ে রাখতে পারেন। এটি আপনাদের উভয়কে প্রসব থেকে আরোগ্যলাভ করতে সাহায্য করবে। আপনার শিশু যত বড় হবে, শিশুকে ঘন ঘন এবং লম্বা সময়ের জন্য ত্বকের সাথে লাগিয়ে রাখুন। অপরিণত শিশুরাও এতে থেকে উপকার লাভ করে।

আপনার সঙ্গী সময়ে সময়ে শিশুর ত্বকের সাথে ত্বক লাগিয়ে জত্ন নিয়ে আপনাকে আরাম দিতে এবং শিশুর প্রতিপালন করতে পারেন। এই পদ্ধতিকে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বলা হয়।

শিশুকে সহজাতভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো (এটাকে লেইড-ব্যাক ব্রেস্ট ফিডিং বা বায়োলজিক্যাল ব্রেস্ট ফিডিংও বলা হয়) 

শিশুর সহজাতভাবে স্তন মুখে ঢুকানো হল শিশুর জন্য স্বাভাবিক। শিশু যখন বুকের দুধ খাওয়া শিখছে তখন আপনার শিশু ভাল করে বুকের দুধ না খেলে বা আপনার স্তনের বোঁটাগুলো যন্ত্রণাপূর্ণ হলে এটি বিশেষ করে উপকারী।

  • কোন কিছুর সাহায্য নিয়ে পিছে ঠেস দিয়ে বসুন।
  • আপনার শিশুকে ত্বকের সাথে ত্বক লাগিয়ে ধরে রাখুন যাতে মাথা সহ তার পেট আপনার উপরে আপনার স্তনের কাছাকাছি থাকে।
  • আপনার শিশু একটি সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহন করছে যা তাকে আপনার স্তনের বোঁটা খুঁজতে সাহায্য করে। এটাকে “খাদ্যের সন্ধানে খোঁজাখুঁজি”(রুটিং) প্রবৃত্তি বলা হয়। আপনি তাকে তার মাথা ঘুরিয়ে বা তা উপরে নিচে নড়াচড়া করে আপনার স্তন খুঁজতে দেখবেন। এটাকে দেখে দ্রুত ওঠানামা করা বা ঠোকরানোর মত মনে হতে পারে।
  • আপনার শিশু আপনার স্তনের দিকে চলে আসলে বাহু ও হাত দিয়ে তার পিঠ এবং নিম্নদেশ ঠেস দিয়ে রাখুন। যখন তার কাঁধ এবং নিতম্ব ঠেস দেয়া থাকে তখন সে তার মাথা অল্প একটু পিছনের দিকে কাত করতে পারে। এটা তাকে মায়ের স্তন মুখে ঢুকাতে সাহায্য করে।
  • আপনার শিশু আপনার স্তনের বোঁটা খুঁজে পাবে। সে প্রথমে তার হাত দিয়ে এটা স্পর্শ করতে পারে।
  • কয়েকবার চেষ্টার পর আপনার শিশু তার চিবুক দিয়ে আপনার স্তনে ধাক্কা দিবে, খোলা মুখ নিয়ে উপরে পৌঁছাবে এবং আপনার স্তন মুখে ঢুকাবে।
  • আপনার শিশু একবার স্তন মুখে ঢুকালে আপনাদের উভয়ের আরাম নিশ্চিত করার জন্য আপনি আপনার এবং আপনার শিশুর অবস্থান ঠিকঠাক করে নিতে পারেন।

হাতে চাপ দিয়ে শাল দুধ বা বুকের দুধ বের করা

হাতে চাপ দিয়ে দুধ বের করা হল আপনার স্তন থেকে হাত ব্যাবহার করে দুধ বের করা। শালদুধ হচ্ছে সমৃদ্ধ, হরিদ্রাভ তরল প্রথম দুধ। আপনার শালদুধ খাওয়া আপনার শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা আপনার শিশুর রোগ- প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে সাহায্য করে এবং অত্যন্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ। জন্মের প্রথম ২-৩ দিন পর আপনি অল্প পরিমানে শালদুধ পাবেন।

হাত দিয়ে চেপে দুধ বের করা মায়েদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আপনাকে নিম্নরুপে সাহায্য করে-

বিজ্ঞাপণ
  • শিশুকে স্তন মুখে ঢুকানোর জন্য আগ্রহী করতে চাপ দিয়ে দুধের কয়েক ফোঁটা বের করুন।
  • দুধের কয়েক ফোঁটা আপনার স্তনের বোঁটায় আলতোভাবে ঘষে দেয়ার মাধ্যমে স্তনের বোঁটার যন্ত্রণা প্রতিরোধ করুন।
  • আপনার স্তনগুলো খুব বেশী পূর্ণ হলে, আপনার শিশু স্তন মুখে ঢুকানোর পূর্বে স্তনের বোঁটার কাছাকাছি জায়গা নরম করে নিন।
  • আপনার স্তন বেশী পূর্ণ হলে এবং আপনার শিশু না খেলে আপনার স্তন আরামদায়ক করে নিন।
  • আপনি শিশুর কাছ থেকে দূরে গেলে বা তাকে সরাসরি স্তনে ছাড়া অন্যভাবে খাওয়ানোর প্রয়োজন হলে, শিশুর জন্য চাপ দিয়ে দুধ বের করুন।
  • আপনার দুধের প্রবাহ বৃদ্ধি করুন।

আপনার শিশু জন্মগ্রহন করা মাত্রই বা এক-দুই সপ্তাহ আগে বুকের দুধ চাপ দিয়ে বের করার অনুশীলন করতে পারেন।

আপনার শিশুর জন্য শালদুধ বা বুকের দুধ চাপ দিয়ে বের করতে-

  • আপনার হাত ভাল করে ধুয়ে নিন।
  • একটি জায়গা খুঁজে নিন যেখানে আপনি আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।
  • বুকের প্রাচীর থেকে স্তনের বোঁটার দিকে সরে গিয়ে আলতোভাবে স্তন মালিশ করুন। মালিশ দুধ প্রবাহিত হতে সাহায্য করতে পারে। এটি আপনার আঙ্গুল দিয়ে স্তনের বোঁটা আলতোভাবে নড়াচড়া করার জন্যও সাহায্য করতে পারে।
  • স্তনের উপর কয়েক মিনিটের জন্য উষ্ণ তোয়ালে রাখুন।
  • এক হাত দিয়ে স্তন ধরুন, বোঁটার বেশী কাছাকাছি। আপনার বুড়ো আঙ্গুলসহ অন্য আঙ্গুলগুলো পরস্পরের বিপরীতে এবং আপনার স্তনের বোঁটা থেকে প্রায় ২.৫-৪ সে.মি(১-১.৫ইঞ্ছি) দূরে থাকতে হবে।
  • আপনার স্তনকে আলতোভাবে ভিতরে বুকের দিকে চাপ দিন।
  • ত্বক ঘষা ছাড়াই আপনার বুড়ো আঙ্গুলসহ অন্য আঙ্গুলগুলোকে একসাথে একে অপরের দিকে হাল্কাভাবে সঙ্কুচিত করুন।
  • কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত আপনার আঙ্গুলগুলোকে শিথিল করুন, তারপর একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করুন। আপনার স্তনের বোঁটার তলদেশে চাপ দিবেন না, কারণ- তা দুধের প্রবাহকে থামিয়ে দেয়ে এবং এটি আপনাকে যন্ত্রণা দিতে পারে।
  • আপনার স্তনের চারপাশে আপনার আঙ্গুল গুলোকে নড়াচড়া করুন যাতে আপনি পুরো স্তন থেকে চাপ দিয়ে দুধ বের করতে পারেন। প্রায় এক মিনিট বা যতক্ষণ পর্যন্ত দুধের প্রবাহ না থামে ততক্ষন এটি চালিয়ে যান। আপনি হাত বদল করতে পারেন এবং এক স্তন থেকে আরেক স্তনে সরে যেতে পারেন। আপনার স্তনে দুধের কোন পিণ্ড থাকলে চাপ দিয়ে বের করতে চেষ্টা করুন।
  • একটি চা-চামচ বা চওড়া মুখের পাত্রে দুধ সংগ্রহ করুন। আপনি শিশুকে একটি ছোট কাপ বা চামচ করে শালদুধ বা বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন।
হাতে চাপ দিয়ে শাল দুধ বা বুকের দুধ বের করা

কখনও কখনও একজন মা সাথে সাথেই দুধ খাওয়াতে সক্ষম নাও হতে পারেন বা চিকিৎসাজনিত কারণে মা এবং শিশুকে আলাদা করার প্রয়োজন হতে পারে। উভয়খেত্রেই আপনার দুধের সরবরাহ চালু করা এবং বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার শিশু সরাসরি বুক থেকে দুধ না খেলে, আপনি হাত চাপ দিয়ে বা পাম্প করে বা উভয়ের সংমিশ্রণে দুধ বের করে আপনার দুধের সরবরাহ চালু রাখতে পারেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে শিশু যতবার খাবে ততবার দুধ বের করবেন। ২৪ ঘন্টায় অন্তত ৮ বার হতে হবে। এমনকি শিশুর জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যেই আপনার স্তনে অবস্থান করার পর আপনি শুরু করতে পারেন।

ইঙ্গিত ভিত্তিক খাওয়ানো

আপনার শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ান। শিশুদের অন্তত ২৪ ঘণ্টায় ৮ বার খাওয়ানো প্রয়োজন। আপনার শিশুর ইন্দ্রিয়গুলো পর্যবেক্ষণ করুন। আপনার শিশু কখন খাওয়ার জন্য প্রস্তুত, খাওয়ার সময় তার সংক্ষিপ্ত বিরতির প্রয়োজন আছে কিনা এবং যখন তার খাওয়া শেষ সে আপনাকে তা জানাবে।

বিজ্ঞাপণ

আপনার শিশু দেখাবে যে সে প্রস্তুত এবং খাওয়ার জন্য অধীর। সে কতগুলো লক্ষন দেখাবে যেগুলোকে খাওয়ানোর ইঙ্গিত বলা হয়।

প্রারম্ভিক ইঙ্গিত “আমি ক্ষুধার্ত”

  • নড়াচড়া করা
  • মুখ খোলা, হাই তোলা বা চাটা
  • হাত থেকে মুখ পর্যন্ত নাড়ানো
  • মাথা একপাশ থেকে আরেকপাশে ঘোরানো।
  • খাদ্যের সন্ধানে খোঁজাখুঁজি করা, মুখ দিয়ে জিনিসপত্র ধরতে চাওয়া।

মধ্যবর্তী ইঙ্গিত “আমি সত্যিই ক্ষুধার্ত”

  • হাত-পা প্রসারিত করা
  • বেশী বেশী নড়াচড়া করা
  • হাত থেকে মুখ পর্যন্ত নড়ানো
  • চোষা, শরীর বাঁকানো বা দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ

বিলম্বিত ইঙ্গিত “আমাকে শান্ত কর তারপার আমাকে খাওয়াও

  • কান্নাকাটি করা
  • অশান্তভাবে শরীর নাড়ানো
  • রঙ লাল হয়ে যাওয়া

আপনার শিশুর বিলম্বিত খাওয়ার ইঙ্গিত দেখলে এটি আপনার শিশুকে খাওয়ানোর আগে শান্ত করার সময়। আপনি যেভাবে এটা করতে পারেন-

  • আপনার শিশু কান্নাকাটি করা শুরু করলে, দ্রুত সাড়া দিতে চেষ্টা করুন। দীর্ঘ সময় ধরে কান্নাকাটি করতে থাকলে, শিশুকে শান্ত করা কষ্টসাধ্য হয়।
  • তার পোশাক খুলে নিন এবং আপনার ত্বকের সাথে তাকে রাখুন।
  • সে সল্প সময় আগে খেয়ে থাকলে, তাকে পুনরায় খাওয়াতে চেষ্টা করুন।
  • শিশুকে আপনার বুক বা কাঁধের বিপরীতে ধরে থাকুন এবং তাকে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করুন বা একটি রকিং চেয়ারে এপাশ ওপাশ দোলা দিন।
  • তার ঢেকুর ওঠাতে চেষ্টা করুন।
  • তার সাথে কথা বলুন, তাকে গান শোনান।
  • তার ডায়াপার ভেজা বা ডায়াপারে মলত্যাগ করলে পরিবর্তন করুন।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment