মোলার প্রেগন্যান্সি | গর্ভকালীন জটিলতা

Spread the love

মোলার প্রেগন্যান্সি কি?

মোলার প্রেগন্যান্সি এক ধরনের অস্বাভাবিক গর্ভধারণ যেখানে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলের টিস্যুগুলোর অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঘটে।  মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে ভ্রুন গঠিত হওয়ার পরিবর্তে অস্বাভাবিক সিস্ট বা টিউমারে পরিণত হয় যা দেখতে আঙ্গুরের থোকার মত হয়।

স্বাভাবিক এবং সুস্থ গর্ভাবস্থায় মায়ের জরায়ুতে প্লাসেন্টার সৃষ্টি হয় এবং তা গর্ভের শিশুর পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে কিন্তু মোলার প্রেগন্যান্সি ক্ষেত্রে এমনটা হয়না।

বিজ্ঞাপণ

মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে প্রথম দিকে স্বাভাবিক গর্ভধারণের লক্ষনগুলো দেখা যায় কিন্তু কিছুদিন পরেই রক্তক্ষরণ সহ আরও কিছু জটিলতা দেখা দেয়। প্রতি ১০০০ গর্ভবতী মহিলার মধ্যে ১ জনের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মোলার প্রেগন্যান্সি কেন হয়?

মোলার প্রেগন্যান্সির কারন অস্বাভাবিকভাবে নিষিক্ত ডিম্বাণু। গর্ভধারণের সময় নিষিক্ত ডিম্বাণুতে বাবা এবং মায়ের ক্রোমোসোম এ কোন সমস্যা থাকলে মোলার প্রেগন্যান্সির সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণুটি থেকে কোন ভ্রুনের সৃষ্টি হয়না বা সৃষ্টি হলেও তা অস্বাভাবিক থাকে।

মোলার প্রেগন্যান্সি

স্বাভাবিক গর্ভধারণে নিষিক্ত ডিম্বাণুতে বাবার দিক থেকে ২৩টি এবং মায়ের দিক থেকে ২৩ টি ক্রোমোসোম থাকে। মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে তা হয়না।

মোলার প্রেগন্যান্সি দুধরনের হয়- কমপ্লিট মোলার প্রেগন্যান্সি এবং পার্সিয়াল মোলার প্রেগন্যান্সি।

কমপ্লিট মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণুতে বাবার দিক থেকেই দুই সেট বা ৪৬ টি ক্রোমোসোম থাকে। মায়ের দিকের কোন ক্রোমোসোম থাকেনা। এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভ্রুন, এমনিওটিক থলে বা স্বাভাবিক প্লাসেন্টাল টিস্যু গঠিত হয়না। এর পরিবর্তে অনেকগুল সিস্ট গঠিত হয় যা দেখতে আঙ্গুরের থোকার মত লাগে।

পার্সিয়াল মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণুতে মায়ের দিক থেকে ১ সেট বা ২৩টি কিন্তু বাবার দিক থেকে দুই সেট বা ৪৬টি ক্রোমোসোম থাকে। অর্থাৎ ডিম্বাণুতে ৪৬ টির পরিবর্তে ৬৯ টি ক্রোমোসোম থাকে। এ ধরনের প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে কিছু স্বাভাবিক প্লাসেন্টাল টিস্যু থাকতে পারে। তাই ভ্রুনের গঠন শুরু হয়। কিন্তু তা এতটাই অস্বাভাবিক থাকে যে খুব বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনা।

মোলার প্রেগন্যান্সির কোন নির্দিষ্ট কারন নেই তবে কিছু কিছু বিষয় এর ঝুঁকি বাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হয়-

  • বয়স- কিশোরী এবং ৩৫ বছরের পরে গর্ভধারণ করলে এর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • পূর্বের ইতিহাস থাকলে- যদি আগে দুই বার বা তার অধিক বার মোলার প্রেগন্যান্সি হয়ে থাকে তাহলে তা আবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • আগে গর্ভপাত হয়ে থাকলে।
  • ফলিক এসিড ও ক্যারোটিন এর অভাবে এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • ভৌগলিক কারনে- এশিয়া মহাদেশের মহিলাদের মধ্যে মোলার প্রেগন্যান্সিতে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশী।

মোলার প্রেগন্যান্সির লক্ষন

শুরুর দিকে আপনি আলাদা কোন লক্ষন টের পাবেন না। স্বাভাবিক গর্ভধারণের যে লক্ষনগুলো সেগুলোই থাকবে। কিছু সময় পর আপনার  স্পটিং বা ভারী রক্তপাত দেখা দিতে পারে।

এটি উজ্জ্বল লাল বর্ণের বা বাদামী হতে পারে, অনবরত বা মাঝে মাঝে হতে পারে। এছারাও যোনিপথে রক্তের সাথে আঙ্গুর আকৃতির সিস্ট বের হতে পারে।  এ লক্ষনগুলো ৬ সপ্তাহ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে যে কোন সময় দেখা দিতে পারে।

এছারাও বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, পেটে খিল ধরা বা পেট অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যেতে পারে। কারন মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে জরায়ু স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুত বাড়ে। আপনার হাইপারথাইরইদিসম(hyperthyroidism) এর সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আপনার নার্ভাস লাগা, ক্লান্ত লাগা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং প্রচুর ঘাম হতে পারে।

কিছু কিছু মায়েদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের মধ্যবর্তী সময়ে প্রি-এক্লাম্পশিয়া দেখা দিতে পারে যদি এর মধ্যে মোলার প্রেগন্যান্সি ধরা না পড়ে। তবে যেহেতু এখন গর্ভধারণের শুরুতেই আলট্রাসাউন্ড করা হয় তাই ওই সময় পর্যন্ত মায়েদের না যাওয়ার সম্ভাবনায় বেশী।

লক্ষনগুলো দেখা দিলেই দেরী না করে বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করুন। এগুলো যে মোলার প্রেগন্যান্সিরই লক্ষন তা নাও হতে পারে। কিন্তু তারপরও আপনার চিকিৎসক আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করে দেখবেন কি কারনে এমন হচ্ছে।

বিজ্ঞাপণ

হয়তবা আপনার রক্ত পরীক্ষাও করা হতে পারে যাতে আপনার hCG হরমোনের মাত্রা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে আলট্রাসাউন্ডে আঙ্গুরের থোকার মত সিস্ট দেখা যাবে এবং hCG হরমোনের মাত্রা বেশী থাকবে।

মোলার প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা

মোলার প্রেগন্যান্সি ধরা পড়লে চিকিৎসকেরা মোলার টিস্যুগুলো পরিষ্কার করা সিদ্ধান্ত নেবেন। এ পদ্ধতিটিকে বলা হয় dilation and curettage বা D&C। এটি সাধারণত জেনারেল বা রিজিওনাল এনেস্থেশিয়ার মাদ্ধমে করা হয়।

D&C এর মাদ্ধমে টিস্যুগুলো পরিষ্কার করার পর হয়ত আপনার বুকের এক্সরে করা হতে পারে যাতে বোঝা যায় সেগুলো আপনার Lungs পর্যন্ত ছড়িয়েছে কিনা। মোলার টিস্যুর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়ানোর সম্ভাবনা যদিও খুব কম তারপর ও যদি এমনটা হয় তবে Lungs আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশী।

এর পরও কয়েক সপ্তাহ আপনার চিকিৎসক আপনার hCG লেভেল মনিটর করবেন। hCG লেভেল নেমে যাওয়ার মানে হোল মোলার টিস্যুগুলো পুরোপুরি পরিষ্কার হয়েছে। টানা কয়েক সপ্তাহ hCG লেভেল শূন্যতে থাকলেও আপনাকে হয়ত প্রতি মাসে একবার করে পরবর্তী বছর খানেক তা মনিটর করার পরামর্শ দেয়া হবে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিস্যুগুলো পরিষ্কার করার পরও অস্বাভাবিক কোষ রয়ে যেতে পারে। সাধারণত পার্সিয়াল মোলের ক্ষেত্রে ১১ ভাগ এবং কমপ্লিট মোলে ১৮-২৯ ভাগ মহিলার এটা হতে পারে। এটাকে বলা হয় persistent gestational trophoblastic neoplasia.

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এটা কেমোথেরাপির মাদ্ধমে নিরাময় করা যায়। খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে তা এক ধরনের ক্যানসারে পরিনত হতে পারে (২০-৪০ হাজারে একজন)। এটা gestational choriocarcinoma নামে পরিচিত।

দ্রুত এবং কার্যকর ব্যাবস্থা নিলে এই ক্যানসারও নিরময়যোগ্য যদি তা জরায়ুর বাইরে বিস্তার লাভ না করে। জরায়ুর বাইরে অস্বাভাবিক কোষগুলো বিস্তার লাভ করলে ৮০-৯০ ভাগ ক্ষেত্রে তা নিরাময় সম্ভব। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারন নেই।

আপনার যদি পরবর্তীতে আর গরভধারন করার পরিকল্পনা না থাকে তাহলে D&C এর পরিবর্তে হিস্টারেকটমি বা জরায়ু পুরোপুরি অপসারণ এর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এতে অস্বাভাবিক কোষগুলো আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ৪০ বছরের বেশী মহিলাদের ক্ষেত্রে যাদের কমপ্লিট মোলার প্রেগন্যান্সি ধরা পড়ে তাদের সাধারণত এ পরামর্শ দেয়া হয় কারন তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশী থাকে।

মোলার প্রেগন্যান্সির কতদিন পর আবার গর্ভধারণ করা যায়

আপনার যে ধরনের ট্রিটমেন্ট ই হোক না কেন, আবার গর্ভধারণ করার জন্য আপনার hCG লেভেল শূন্যতে নেমে যাওয়ার পর অন্তত এক বছর অপেক্ষা করা উচিত। এর আগে গর্ভধারণ করলে আপনার hCG লেভেল আবার বেড়ে যাবে এবং আপনার চিকিৎসক এর পক্ষে তা বেড়ে যাওয়ার সঠিক কারন নির্ণয় করা সম্ভব হবেনা।

তবে সুসংবাদ হচ্ছে মোলার প্রেগন্যান্সি আপনার আপনার স্বাভাবিক গর্ভধারণের ক্ষমতার উপর কোন প্রভাব ফেলেনা। গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু, জন্মগত ত্রুটি, সময়ের আগেই প্রসব বা অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি ও এতে বাড়েনা। এছারাও আবার মোলার প্রেগন্যান্সিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ১থকে ২ ভাগ। তারপরও আবার গর্ভধারণ করলে প্রথম ট্রাইমেস্টার এ আল্ট্রাসাউন্ড করে নিশ্চিত করতে হবে সবকিছু ঠিক আছে কিনা।

পরিশিষ্টঃ 

মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে গর্ভপাতের মতোয় আপনার গর্ভ নষ্ট হওয়ার বেদনায় ভোগা স্বাভাবিক। যেহেতু এ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের সব লক্ষনই প্রকাশ পায় এবং আপনি মানসিক ভাবে তার জন্য তৈরি হতে থাকেন তাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ আপনাকে এবং আপনার পরিবার পরিজনকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে ফেলতে পারে।

কিন্তু একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে এ ধরনের জটিলতার ক্ষেত্রে আপনার কিন্তু নিজের স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবতে হবে। যেহেতু আপনার নিয়মিত চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে এবং অনেকটা সময় আপনাকে সাবধান থাকতে হবে তাই ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। প্রয়োজনে আপনাকে এবং আপনার সঙ্গীকে অন্যদের সাহায্য নিতে হবে, কথা বলতে হবে যদি সম্ভব হয় কোন বিশেষজ্ঞের সাথে কাউন্সেলিং করার চেষ্টা করুন।

সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment