গর্ভাবস্থায় চন্দ্রগ্রহন ও সূর্যগ্রহণের প্রভাব । প্রচলিত কুসংস্কার ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

Spread the love

নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় হল গর্ভাবস্থা। শুধু নারী নয়, তার শিশুর জীবন কীভাবে গড়ে উঠবে তা অনেকটাই নির্ভর করে এ সময়ের ওপরে।দুঃখজনক হলেও সত্যি,  যে সময়টাতে নিবিড় পরিচর্যা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের মাঝে গর্ভবতী মায়ের থাকা উচিত সে সময়টাতেই কিছু ভুল ধারণার কারণে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। বাংলাদেশের শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের প্রচলন দেখা যায়।

চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, ঠিক দুপুরবেলা, সন্ধ্যাবেলা, মাঝরাত এসব সময়ে বাইরে বের হওয়া যাবে না- এমন একটা প্রথা তো আপনারা জানেন, তাই না? এর কতটুকু ভিত্তি আছে বলে আপনাদের মনে হয়? উত্তর- একটুও না। গ্রহণের সময়ে কাজ করা যাবে না, খাওয়া যাবে না- এমন প্রথা একেবারেই ঠিক নয়।

বিজ্ঞাপণ

সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহন কি?

অন্য সব ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার মতো গ্রহণও সবসময় জনসাধারণের কাছে এক অপার রহস্যের আধার হয়ে থেকেছে। সূর্য বা চাঁদ চোখের সামনে একটু একটু করে আড়াল হতে থাকা, দিনের বেলা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া, চাঁদ লালচে রং ধারণ করা, ভৌতিক সবুজাভ জ্যোতির্বলয় তৈরি হওয়া ইত্যাদি সবকিছুই হাজার বছর ধরে মানুষকে অভিভূত করে এসেছে। আর এই রহস্যময় ঘটনার পেছনের প্রকৃত কারণ না জানার কারণে জন্ম নিয়েছে অনেক মনগড়া কাহিনী আর কুসংস্কার।

প্রকৃতপক্ষে গ্রহণ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত বা আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এটি তখনই ঘটে, যখন সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ একই সরলরেখায় অবস্থান করে। পৃথিবী ও চাঁদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে কখনো সূর্যগ্রহণ হয়, কখনোবা চন্দ্রগ্রহণ। সহজভাবে বলতে গেলে, চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমণ করতে করতে যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে চলে আসে, তখন এটি সূর্যের আলোকে পৃথিবীপৃষ্ঠে আসতে বাধা দেয়। ফলে সূর্যগ্রহণ ঘটে।

আবার যখন পৃথিবী নিজ কক্ষপথে আবর্তন করতে করতে চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে, তখন এটি সূর্যের আলোকে চাঁদের ওপর আপতিত হতে বাধা দেয় এবং পৃথিবীর ছায়ায় চাঁদ আচ্ছাদিত হয়। একে বলা হয় চন্দ্রগ্রহণ।

গ্রহনের সময় যেসব কুসংস্কার প্রচলিত এবং তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রহণ (Eclipse) সম্পর্কে বিভিন্ন লোকজ বিশ্বাস ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, গর্ভবতী নারীদেরকে তাদের গর্ভস্থ শিশুর সুরক্ষার জন্যে গ্রহণের সময় অতিরিক্ত কিছু সাবধানতা মেনে চলতে বলা হয়। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণের সঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতির তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনই কিছু প্রচলিত কুসংস্কার এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।।

গর্ভবতী নারীরা সূর্যগ্রহণের সময় বাড়ির বাইরে গেলে এবং খালি চোখে গ্রহণ দেখলে গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ, অন্ধ বা দেখতে অসুন্দর হয়

পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় যখন চাঁদ সূর্যকে সম্পূর্ণরূপে আড়াল করে ফেলে, তখন এর উজ্জ্বল জোতির্বলয় থেকে তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ ঘটতে থাকে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, এই বিকিরণ সূর্যের আলোর তীব্রতার তুলনায় অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই এই বিকিরণ ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে, পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডল ভেদ করে এসে দর্শকের চোখে অন্ধত্ব সৃষ্টি করতে পারার কোনো সম্ভাবনা নেই।গর্ভের ভেতরে থাকা শিশুর তো প্রশ্নই আসেনা।

তবে সূর্য পুরোপুরি আড়াল হয়ে যাওয়ার আগেই, অর্থাৎ আংশিক সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের উজ্জ্বল বিকিরণ চোখে পড়লে তাতে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি এর ফলে অন্ধত্বও (eclipse blindness) দেখা দিতে পারে। তবে এটি গর্ভস্থ শিশুর সাথে সম্পর্কিত নয়।

তাই সরাসরি সূর্যের দিকে না তাকানোর নিয়মটি শুধু গর্ভবতী নারী নয়, বরং সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি সানগ্লাস বা এক্স-রে ফিল্মও পুরোপুরিভাবে নিরাপদ নয়। সূর্যগ্রহণ দেখার জন্যে বিশেষভাবে তৈরি নিরাপদ চশমা (eclipse glass) পরে, তবেই সূর্যগ্রহণ দেখা উচিত।

গ্রহণের সময় কোনো খাবার রান্না করা, খাবার খাওয়া বা পানি পান করা উচিত নয়

মনে করা হয়, গ্রহণের সময় এক প্রকার বিকিরণ ঘটে, যা খাবারকে বিষাক্ত করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ সময় এমন কোনো ক্ষতিকারক বিকিরণ ঘটে না, যা খাবারে বিষক্রিয়া করতে পারে। তবে সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যরশ্মি পৃথিবীপৃষ্ঠে আসতে বাধা পায়। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ বেশ কমে যায়।

কম তাপমাত্রা এবং সূর্যালোকের অভাবের কারণে খাবারে ক্ষতিকর জীবাণুর আক্রমণ হতে পারে বলে আশঙ্কা থাকে। তাই খাদ্য সংরক্ষণ এবং পরিচ্ছন্নতার সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চলাই যথেষ্ট।

গ্রহণের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্যে উপবাস পালন করা উচিত”

অনেকে চন্দ্রগ্রহণ শুরুর নয় ঘণ্টা এবং সূর্যগ্রহণ শুরুর বারো ঘণ্টা আগে থেকে এ উপবাস শুরু করেন। এ সময় উপবাস পালনকারীগণ রান্না করা খাবার এবং পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। এসব ধারণার সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ নেই এবং নিশ্চিত ভাবেই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও নেই।

যদি গ্রহন দীর্ঘ সময় ধরে চলে তবে বেশীক্ষণ না খেয়ে থাকা উচিত হবেনা। আবার এত দীর্ঘ সময় যদি পানি পান না করেন তবে পানিশূন্যতাও দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে গরমের সময়। পানিশূন্যতা হলে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, জ্ঞ্যান হারানো এবং অ্যাসিডিটির মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনটা হলে অবশ্যই  ডাক্তারকে জানাতে হবে।

গর্ভবতী নারীরা গ্রহণ চলাকালে ছুরি, কাঁচি বা অন্য কোন ধারালো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবে না। কোনো ধাতব অনুষঙ্গ বা গহনা ব্যবহার করা যাবে না

এসব নিষেধাজ্ঞা না মানলে গর্ভস্থ শিশু ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করবে, এমন একটি কুসংস্কার এই উপমহাদেশে প্রচলিত রয়েছে। আবার মেক্সিকোতে ঠিক উল্টো ধারণাটি প্রচলিত। সেখানে গ্রহণের কুপ্রভাব থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য গর্ভবতী নারীরা ধাতব অনুষঙ্গ (যেমন- সেফটিপিন) পরা, পেটের কাছে ছুরি ধরে রাখা, লাল রঙের অন্তর্বাস পরা- এসব নিয়ম পালন করে থাকেন।

বিজ্ঞাপণ

প্রকৃতপক্ষে জন্মগত ঠোঁট বা তালু কাটার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না পাওয়া গেলেও, বংশগত, পরিবেশগত কারণ কিংবা কিছু ঔষধ বা রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে এটি হতে পারে বলে জানা যায়। তবে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সাথে শিশুর এ ধরনের শারীরিক ত্রুটির কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

মানব ভ্রূণের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম সপ্তাহ বয়সে তার নাক, মুখের তালু এবং ঠোঁট তৈরি হয়। কোনো কারণে দু’পাশের অংশগুলো মাঝে এসে মিলিত হতে বাধা পেলে ঐ অংশে ফাঁকা থেকে যায়। তখন একে আমরা ঠোঁটকাটা বা তালুকাটা বলে থাকি। এর সঙ্গে গ্রহণের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

আরও পড়ুনঃ শিশুর জন্মগত ত্রুটি 

গর্ভবতী নারীদেরকে গ্রহণ চলাকালে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে হবে, নইলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিতে পারে

এই কুসংস্কারটিও উপমহাদেশে বেশ প্রচলিত। তবে গর্ভে শিশুকে রেখে চিত হয়ে শোয়াটা মায়েদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। গর্ভাবস্থার ১৫ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে মায়ের জরায়ু অনেক বড় হয়ে যায়। এর ফলে মা যদি চিৎ হয়ে শোয় তবে তা রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এভাবে শোয়ার ফলে জরায়ুর চাপে ইনফেরিয়র ভেনা কাভা সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। এই শিরাটি শরীরের মধ্যভাগ ও নিম্নভাগ থেকে রক্ত হৃদপিণ্ডে প্রবাহিত করে।

গর্ভাবস্থার ১৬ সপ্তাহ পার হয়ে যাবার পর অনেকক্ষণ চিত হয়ে শুয়ে থাকলে মায়ের জ্ঞান হারানোর মতো অনুভূতি হতে পারে, কারণ গর্ভস্থ শিশুটির সকল চাপ তখন রক্তনালীগুলোর ওপর পড়ে।

তাই একজন গর্ভবতী মহিলা অন্য সময়ে যেভাবে চলাচল করেন বা শুয়ে থাকেন, গ্রহণের সময়েও ঠিক সেভাবেই চলতে পারবেন। তার শিশু তার জরায়ুর ভেতরেই সুরক্ষিত আছে। সুতরাং বিকলাঙ্গতা ঘটানোর মতো অন্য কোনো কারণ না থাকলে, শুধু গ্রহণের প্রভাবে শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে- এমন আশঙ্কা অমূলক।

আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় শোওয়ার নিয়ম।

 “গ্রহণ শেষ হওয়ার পর গোসল করে এর সকল অশুভ প্রভাব শরীর থেকে দূর করে ফেলতে হবে

গ্রহণ কেন হয়, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থেকে আমরা জেনেছি যে, এটি সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক একটি ঘটনা। সুতরাং এর ওপর কোনো কিছুরই মঙ্গল বা অমঙ্গল নির্ভর করে না। তাই গোসল করে এর অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার আদতে কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।

যে সংস্কারটি মানবেন

সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো বারণ। এই সংস্কার অবশ্যই মানবেন। সত্যি বলতে, যেকোনো সময়েই সূর্যের দিকে সরাসরি তাকাতে নেই। সে হোক গ্রহণের সময়, কিংবা স্বাভাবিক সময়ে। সূর্যগ্রহণ দেখতে কাঁসার পাত্রে পানি থেকে শুরু করে ব্যবহার হয়েছে কাজে লাগে না এমন এক্স-রে প্লেটও। এখন অবশ্য বিশেষ রোদচশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। দেখে-শুনে ভালো মানের এমন চশমা কিনতে পারেন।

বিজ্ঞাপণ

তবে যদি এ ব্যাপারে খুবই অন্ধবিশ্বাস থাকে তবে এসব রীতি মেনে চলতে বাঁধা নেই। গ্রহন সাধারণত কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। এতে যদি মনে শান্তি আসে তবে পালন করতে পারেন। তবে অবশ্যয় গর্ভের বাচ্চার যাতে উল্টো ক্ষতি না হয় যায় সেদিকে লক্ষ রাখা সবচেয়ে জরুরী।

যদি গ্রহন দীর্ঘ সময় ধরে চলে তবে বেশীক্ষণ না খেয়ে থাকা উচিত হবেনা। আবার এত দীর্ঘ সময় যদি পানি পান না করেন তবে পানিশূন্যতাও দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে গরমের সময়। পানিশূন্যতা হলে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, জ্ঞান হারানো এবং অ্যাসিডিটির মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনটা হলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানাতে হবে।

মূল কথা এটিই যে, গর্ভস্থ শিশুর ওপর গ্রহণের প্রভাব সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর পক্ষে বৈজ্ঞানিকভাবে শক্ত কোনো প্রমাণই নেই।এ ক্ষেত্রে কোনোরকম কুসংস্কার প্রশ্রয় দেওয়া নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

সুতরাং গর্ভাবস্থায় গ্রহণ দেখা দিলে এ নিয়ে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কিছু নেই। কোনো কারণে এগুলো পালন করা সম্ভব না হলে সন্তানের বিরাট কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে, এমনটা ভেবে দুশ্চিন্তায় ভোগাও উচিত নয়। বরং এ দুশ্চিন্তায় সন্তানের ক্ষতি করতে পারে।

আপনি যদি প্রসূতি মা হয়ে থাকেন, নিজের শরীরের যত্ন নিন। অনাগত সন্তানের জন্য শরীরে যথেষ্ট পুষ্টির ব্যবস্থা করুন

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment