গর্ভাবস্থায় মায়েদের মানসিক পরিবর্তন কেমন হতে পারে?

Spread the love

প্রেগন্যান্সি যেমন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়, তেমনই অন্যতম কঠিন সময়। এই সময় শরীর কখনও ভাল থাকে, কখনও খারাপ। তেমনই চলতে থাকে মুডেরও খামখেয়ালিপণা। সুস্থ মা মানে সুস্থ সন্তান। সেটার জন্য শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।

একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে গর্ভাবস্থায় একজন নারীকে সবসময়ই খুব হাসি-খুশি থাকতে হবে। আপনি সন্তানসম্ভবা জানার পর আপনার আশেপাশের মানুষও চাইবে আপনি ভালো মেজাজে থাকুন, আপনার শিশুকে নিয়ে ভালো চিন্তা করুন।

বিজ্ঞাপণ

তাদের কথা শুনতে শুনতে আপনারও হয়তো মনে হবে যে সবসময়ই ভালো থাকতে হবে। কিন্তু, এটাও সত্য যে এই নয়টা মাসেও অন্য নয়টা সাধারণ মাসের মতোই আপনার মনের আকাশে মেঘও জমবে, রোদও হাসবে।

আপনি সন্তাসম্ভবা – এটা জানার সাথে সাথে সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে। আপনার ব্যাপারে আপনার নিজের অনুভূতি পালটায়, অনাগত শিশু আর আর তার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা শুরু হয়।

আপনার স্বামীর সাথে আপনার সম্পর্ক পালটায়, ইতিমধ্যে যদি আপনি এক সন্তানের মা হয়ে থাকেন, তাহলে সেই শিশুটির সাথেও আপনার সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হয়। সম্পর্কের মাত্রা বদলায় আপনার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবের সাথে। আর, এই পরিবর্তনগুলোর সাথে হঠাৎ করে খাপ খাইয়ে নেয়াও সহজ হয় না।

এই নিবন্ধে গর্ভাবস্থায় মায়েদের মানসিক পরিবর্তনের যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার সবকিছুই যে সবার ক্ষেত্রে ঘটে তা নয়। আপনার যে সমস্যাটা হচ্ছে না, সেটা হয়তো অন্য আরেকজন সন্তানসম্ভবা মায়ের জন্য গুরুতর সমস্যা। এই নিবন্ধ থেকে সবাই তাদের নিজস্ব সমস্যা অনুযায়ী পরামর্শগুলো কাজে লাগাতে পারেন।

মুড সুইং বা মেজাজের ওঠানামা

মা হওয়ার সময়টায় মেয়েদের জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। আর যে কোনও পরিবর্তন এলেই যেহেতু মানুষের মনে নানা আবেগের খেলা শুরু হয়, কাজেই মা হওয়ার সময়েও তার ব্যতিক্রম কেন হতে যাবে? তবে সব মেয়েরই যে একইরকম মুড সুইং হয়, তা নয় ।এমন অনেক মেয়ে আছেন যাঁদের হয়তো সেভাবে কিছুই হয় না। 

মুড খারাপ হওয়া, মেজাজ খারাপ হওয়া, খিটখিটে থাকা- এ সবই দেখা যায় গর্ভাবস্থায়। সুতরাং এ সময়ে তার আবেগের ওঠানামা দেখা যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কেউ কেউ অনেকটাই শান্ত থাকেন। কিন্তু গর্ভাবস্থার প্রথম ও শেষ সময়টায় সাধারণত মেজাজের ওঠানামা হওয়াটা স্বাভাবিক।

নারীর শরীরে এসময় অনেক পরিবর্তন আসে, হরমোনের প্রভাব থাকে তীব্র, তার থেকেই হয় এই মুড সুইং।মেয়েদের শরীরে দুই ধরনের হরমোন রয়েছে, একটার নাম এস্ট্রোজেন, অন্যটার নাম প্রজেস্টেরন। প্রজেস্টেরনকে স্ট্রেস হরমোনও বলা হয়। কোনও কোনও মেয়ে এস্ট্রোজেনের  মাত্রায় বদল এলে সংবেদনশীল হয়ে পড়েন আবার কেউ কেউ প্রজেস্টেরনের বাড়াবাড়িতে প্রভাবিত হন।

গর্ভাবস্থায় ইসট্রোজেন হরমোন কখনো বেড়ে যায় আবার কমেও যায়। এর ফলে মেজাজ খিটখিটে থাকে। এ সময়ে অনেকে নিজেকে অসহায় মনে করেন, মানসিকভাবে দুর্বল বোধ করেন। আবার অনেকে নিজেকে সবলও মনে করেন।

হরমোনের পরিবর্তন ও ক্লান্তিবোধ

গর্ভাবস্থায় শরীরের হরমোনে পরিবর্তন হয় বলে প্রচন্ড ক্লান্ত বোধ হয়। কখনো কখনো বমি বমি লাগে। এমনকি গর্ভবতী নারী অল্পতেই প্রচন্ড আবেগপ্রবণ পড়েন, কিংবা মন খারাপ করে ফেলেন। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে এরকম খুব বেশি হয়।

আপনি নিজেই খেয়াল করলে দেখবেন আপনার হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই চোখে পানি চলে আসছে কিংবা আপনি কথায় কথায় রেগে যাচ্ছেন। ক্লান্তি আর শারীরিক অবসাদের জন্য আপনার হয়তো কিছুই ভালো লাগছে না। এ সময় নিজের শরীরের দিকে নজর দেয়া সবচেয়ে বেশি দরকারী আর সেই সাথে দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম।

গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে জানুন।

দুশ্চিন্তা

একজন নারী যখন গর্ভবতী হন, বিশেষ করে সেটা যদি তার প্রথম গর্ভধারণ হয়, তাহলে তিনি গর্ভের শিশুকে নিয়ে প্রচন্ড উৎকন্ঠা ও দুশ্চিন্তা বোধ করেন। বিভিন্ন কারণেই এই দুশ্চিন্তা হয়। যখনই প্রসবপূর্ব সেবার জন্য আপনি ডাক্তারের কাছে যাবেন, আপনার হয়তো মনে মনে দুশ্চিন্তা থাকবে যে শিশুর কোনো জটিলতা ধরা পড়তে পারে।

টাকা-পয়সা, বাসস্থান কিংবা পেশা নিয়েও আপনার মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করতে পারে। অভিভাবক হিসেবে আপনি আপনার দায়িত্বটুকু ঠিকমতো পালন করতে পারবেন কি না, কিংবা অভিভাবক হবার জন্য আদৌ আপনি প্রস্তুত কি না, এগুলো নিয়েও আপনার চিন্তা হতে পারে।

কিছু কিছু দুশ্চিন্তা আপনার সঙ্গীর সাথে কিংবা পরিবার বা বন্ধুদের কারো সাথে শেয়ার করুন। এসব বিষয় নিয়ে যত খোলামেলা কথা বলতে পারবেন, ততই ভালো হবে।

বিজ্ঞাপণ

ভীতি

গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাসে নারী গর্ভপাতের ভয় পেতে পারেন, বা সন্তানের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভীতি থাকতে পারে তার। পরবর্তী তিন মাসে তিনি ভয় পেতে পারেন, হয়ত তিনি সন্তানের সঠিক যত্ন নিতে পারবেন না বা তিনি ভালো মা হয়ে উঠতে পারবেন না। আর শেষের দিকে লেবার পেইনের ভয় বা এ সময়ে দুর্ঘটনার ভয় পেতে পারেন।

গর্ভাবস্থায় অনেক কিছুই হবু মায়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। এর ফলেই ভীতির জন্ম হয়। কিন্তু এটা জেনে রাখতে হবে এই ভয়ে কাবু হয়ে যাওয়া যাবে না, একে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।এক্ষেত্রে পরিবারের সবার সহযোগিতা কাম্য।

ভুলে যাবার প্রবণতা

স্মৃতি খারাপ হয়ে যাওয়া, মস্তিষ্কে ধোঁয়াটে ভাবটার কারণে গর্ভবতী নারী অনেক সময়েই এটা সেটা হারিয়ে ফেলেন, বা রুটিন কাজগুলো করতেও ভুলে যান। একে অনেক সময়ে বলা হয় প্রেগনেন্সি ব্রেইন বা বেবি ব্রেইন। আবার বাচ্চার জন্মের পরে মায়ের যদি ভুলে যাওয়ার রোগ ধরে, সেটাকে বলা হয়। মামি ব্রেইন বা মমনেশিয়া। কিছু কিছু গবেষণায় দেখা যায় এটা হয় হরমোন, বিশেষ করে প্রজেস্টেরনের বেশী মাত্রার কারণে। আবার ঘুম কম হবার কারণেও তা হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অঞ্চলে পরিবর্তন আসে, এটা দেখা গেছে। এই অঞ্চল স্মৃতি নিয়ে কাজ করে, ফলে এটাও ভুলোমনের পেছনে দায়ী হতে পারে। এ সময়ে গর্ভবতী নারী এত শত বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন যে, কিছুটা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক।

কান্না

খুব অল্প কারণেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার ব্যাপারটা দেখা যায় কিছু কিছু নারীর মাঝে। এ সময়ে তারা ঘন ঘন কাঁদেন। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে। কারণ এ সময়ে অনেক ধরণের অনুভূতি তাদের মাঝে কাজ করে এবং তাদের মানসিক অবস্থা থাকে নাজুক। বেশী কান্নাকাটি অনেক সময়ে বিষণ্ণতার লক্ষণ হতে পারে, যা কিনা ১০ শতাংশ গর্ভবতী নারীকে আক্রান্ত করে।

নিজের শরীর নিয়ে চিন্তা

গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি এবং শেষ দিকে নারীর শরীরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। এ সময়ে তার ওজন বেড়ে যায়। তিনি নিজের শরীর নিয়ে অসন্তুষ্টিতে ভুগতে পারেন। নিজের সঙ্গীর কাছে তার আকর্ষণ হারাচ্ছেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। কেউ কেউ এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানান, কেউ কেউ ওজন বাড়ছে বলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।

স্বপ্ন

অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেক গর্ভবতী নারীই স্বপ্ন দেখেন। তবে কখনো কখনো তাদের দুশ্চিন্তাগুলোও স্বপ্নে প্রতিফলিত হয়। কারণ, এ সময় একজন গর্ভবতী নারী সারাক্ষণই তার গর্ভাবস্থা এবং গর্ভাবস্থার কারণে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে চিন্তিত থাকেন। আপনার যদি সারাক্ষণই এরকম দুশ্চিন্তা হয়, তাহলে আপনার উচিত হবে ডাক্তারের সাথে কথা বলা।

গর্ভাবস্থায় স্বপ্ন কেমন হতে পারে তা নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন।

বিষন্নতা ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা

একজন গর্ভবতী নারী তার গর্ভের শিশুকে নিয়ে চিন্তিত বোধ করবেন, আবার হঠাৎ হঠাৎ বিষন্ন বোধ করবেন – দুটোই খুব স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু যদি এমন হয় যে তিনি সারাক্ষণই তার শিশুটিকে নিয়ে চিন্তিত থাকেন, কিংবা সারাক্ষণই বিষন্ন বোধ করেন, তাহলে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। কেন আপনার বিষণ্ণ লাগছে, এমনকি যদি কোনো কারণ ছাড়াই আপনার বিষন্ন লাগে, সেটাও আপনার ডাক্তার বা স্বাস্থ্য পরিদর্শককে জানান।

গর্ভাবস্থায় বিষণ্ণতা সম্পর্কে জানুন।

তাদেরকে আপনার বোঝাতে হবে যে এখন আপনার অন্য সময়ের চাইতেও বেশি খারাপ লাগে। গর্ভাবস্থায় অনেক নারীই এমন বিষন্ন হয়ে পড়েন যে তা কাটিয়ে উঠতে ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

কোনো গর্ভবতী নারীর যদি আগে কখনো মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো জটিলতা থেকে থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় কিংবা সন্তান প্রসবের পরেও বিষণ্ণ বোধ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আপনি যদি আগে কখনো কোনো মানসিক জটিলতায় ভুগে থাকেন, তাহলে গর্ভাবস্থার শুরুতেই সেটা আপনার ডাক্তারকে জানিয়ে দেয়া উচিত হবে।

গর্ভাবস্থায় যদি সময়ে সময়ে আপনার মেজাজের পরিবর্তন হতে থাকে, তাহলে কাউকে না কাউকে সেটা বুঝিয়ে বলুন। এগুলো মনের মধ্যে চেপে রেখে একা একাই যদি কষ্ট পান, তাতে কোনো ভালো ফল হবে না।

প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা বা পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন সম্পর্কে জানুন।

আপনি যদি আপনার দুশ্চিন্তাগুলো নিয়ে আরেকজন গর্ভবতী নারীর সাথে কথা বলেন, তাহলেও অনেক সময় উপকার হতে পারে। যার সাথে কথা বললে আপনার ভালো লাগবে বলে মনে হয়, আপনার উৎকন্ঠা আর উদ্বেগগুলো নিয়ে তার সাথেই খোলামেলা কথা বলুন। তিনি হতে পারেন আপনার সঙ্গী, কিংবা আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের কেউ কিংবা আপনার ডাক্তার !

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment