গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ সংক্রান্ত প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা
মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত এক অত্যন্ত সাধারণ সমস্যা। প্রায় ২০ শতাংশ মেয়েদের এই দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিতে যেতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়না। একে প্রতিরোধের উপায়ও খুব কম। তা সত্ত্বেও প্রচলিত রয়েছে নানা ধরনের কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারনা, সামাজিক বিধিনিষেধ। শিক্ষিত মানুষজনও এর ব্যাতিক্রম নন।
এরকমই কিছু মিথ বা ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। অবশ্য সব ধরনের গর্ভপাত নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করবনা। গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাসে ঘটা গর্ভপাত যার পেছনে কোন জ্ঞাত ডাক্তারি কারণ নেই, সেগুলি নিয়ে যেসব ভুল ধারনা আছে, তার মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
[ আরও পড়ুনঃবাচ্চার হার্টবিট না আসার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত ]
মায়ের দোষেই গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ
এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অফিসের কাজ, সংসারের কাজ বা সাময়িক চাপ- এর ফলে গর্ভপাত হয়েছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু এর কোন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই। অনেক সময় মায়েরা নিজরাই নিজেদের দোষারোপ করেন। হয়তো বা এটাই আমাদের সামাজিক রীতি, যে রীতিটি মায়েরা আত্মস্থ করেন, আর সন্তান-সন্তুতির যে কোন দুর্দশার দায় নিজেদের ওপর চাপিয়ে দেন।
গর্ভপাত খুব বিরল বা কম ক্ষেত্রে হয়
গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাসের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ বাচ্চা নষ্ট হয় যায়। অবিশ্বাস্য হলেও পরিসংখ্যান তাই বলে। তবে যাদের একবার, দু বার এমনকি তিনবার গর্ভপাত হয় তাদেরও অধিকাংশের পরবর্তীকালে সুস্থ সন্তান হয়।
কম্পিউটার স্ক্রিনের অধিক ব্যাবহারে গর্ভপাত বাড়ছে
অফিসে যেসব মায়েরা সারাদিন কাজ করেন তাদের ধারণা হতে পারে যে এর ফলে তাদের গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে এবং এটা ভুল ধারণা বলে প্রমাণিত।
গর্ভপাত করানো পরবর্তীকালে গর্ভপাতের কারণ
যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যাক্তির হাতে উপযুক্ত স্থানে ও উপযুক্ত সময়ে নিরাপদ পদ্ধতিতে ডাক্তারি গর্ভপাত (Medical Termination of Pregnancy) ভবিষ্যতের গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ায় না।
জন্মনিরোধক বড়ি গর্ভপাতের কারণ
একেবারে ভুল ধারণা। রোজ একটা করে গর্ভনিরধোক চার সপ্তাহে ২১ দিন বা ঐরকম যেসব বড়ি রোজ একটা করে খাওয়া হয় সেগুলো গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ায় না। তবে গর্ভাবস্থার প্রথমে (সাধারণত অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের ক্ষেত্রে মায়ের ইচ্ছা করে করেন) একসাথে অনেকগুলো গর্ভনিরোধক বড়ি খেলে গর্ভপাত হতে পারে।
গরম পানিতে গোসল করলে গর্ভপাত হতে পারে
গর্ভাবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা খুব বেশী বাড়া উচিত নয়। কিন্তু প্রচণ্ড জ্বরের কারণে গর্ভপাত হয়েছে এমনটা শোনা গেলেও গরম পানিতে গোসল করার জন্য কারো বাচ্চা নষ্ট হয়েছে এমনটা শোনা যায়নি।
গর্ভাবস্থায় যৌন সঙ্গম করলে গর্ভপাত হতে পারে
এর পেছেনেও কোন তথ্য প্রমাণ নেই। গর্ভাবস্থার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সহবাস বা যৌনসংগম সাধারণভাবে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ায় না।
[ আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় সহবাস কতটা নিরাপদ? ]
প্রোজেস্টেরন হরমোন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে গর্ভপাত আটকানো যায়
এটি বিতর্কিত বিষয়। কয়েকটা ছোট ছোট গবেষণার ফল থেকে এরকম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে গর্ভাবস্থায় প্রজেস্টেরন হরমোনের কয়েকটি ধরন হয়তো গর্ভপাত ঠেকাতে কিছু ফল দিলে দিতে পারে।
কিন্তু গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে যোনি থেকে রক্তপাত হলেই তাকে প্রজেস্টেরন দিয়ে গর্ভপাত আটকানোর চেষ্টা করা বিজ্ঞানসম্মত- এমন কথা বলার আগে অনেক বড় আকারে, বেশী রোগীর মধ্যে এবং বিভিন্ন ধরনের অবস্থায় প্রজেস্টেরন প্রয়োগে উপকার হল কিনা সেই পরীক্ষা করতে হবে।
স্থূলতা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়
এর মদ্ধে কিছু সত্যি থাকলে থাকতে পারে। স্থূল মহিলাদের মধ্যে গর্ভপাতের হার বেশী। কিন্তু এর পেছনের কারণটা আমরা জানিনা না। আর কতটা পর্যন্ত ওজন থাকলে তা “নিরাপদ” আর কতটা মোটা হলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়তে শুরু করবে- সেটাও জানি না। এই বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলার আগে আরও গবেষণা দরকার।
[ আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি । কতটুকু বাড়া স্বাভাবিক ? ]
এইচ সি জি (HCG) ইনজেকশন দিয়ে গর্ভপাত আটকানো যায়
এটা প্রজেস্টেরন হরমোন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে গর্ভপাত আটকানোর মত বিতর্কিত বিষয়। এমন ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা রোগীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগে সেটা ঠিকভাবে প্রমাণ হওয়া উচিত। আর সেই প্রমাণটা করবার জন্য এখন উপযুক্ত উচ্চমানের গবেষণা করা বাকি আছে।
বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে গর্ভপাতের সম্ভাবনা কমে
গর্ভপাতের সম্ভাবনা দেখলেই অধিকাংশ চিকিৎসক যে কথাগুলো বলেন তার মদ্ধে বিশ্রাম আর শুয়ে থাকার ব্যাপারটা প্রায় সব সময়েই থাকে। কিন্তু বিশ্রাম আর শুয়ে থাকার ফলে গর্ভপাত আটকানো গেছে এমন কোন তথ্য প্রমাণ নেই।
তবে এটা ঠিক যে গর্ভপাতের প্রথম দিকে যোনি মুখে রক্তপাত দেখা দিলে অনেক মহিলারই শুয়ে থাকতে ভালো লাগতে পারে। অন্যদিকে অতিরিক্ত বিশ্রাম ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (পায়ের গভীর শিরার মদ্ধে রক্ত জমাট বাঁধা)- এর সম্ভাবনা বাড়ায়।, আর হবু মাকে আরও অসুস্থ করে তোলে।
মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত কেন হয় ?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে গর্ভপাতের পেছনের কারণটা ঠিক কি? কিভাবে এটা কাজ করে? এখন বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত যে ক্রোমোজোম- ঘটিত ত্রুটির জন্য অধিকাংশ প্রথম পর্যায়ের গর্ভপাত হয়। এই ক্রোমোজোম ঘটিত ত্রুটি একটি আচমকা ঘটা দুর্ঘটনা মাত্র এবং পরবর্তী গর্ভধারণে তার কোন ছাপ পড়ে না।
মায়ের বেশী বয়স হয়ে গেলে বিশেষ করে ৩৫ বছরের ওপরের মায়েরা গর্ভধারণ করলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। তবে এছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে, যেমন-
জরায়ুর গঠন বিকৃতি
জন্মগত জরায়ু অপগঠন যেমন বাইকরনুয়েট জরায়ু গর্ভপাত ঘটাতে পারে আবার জরায়ুর মদ্ধে বড়সড় টিউমার থাকলে তার কারণেও গর্ভপাত হতে পারে।
মেডিকেল রোগ
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমটোসাস বা অ্যান্টি ফস্ফোলিড সিনড্রোম- এসবেও গর্ভপাত হতে পারে।
অপুষ্টি
অতিরিক্ত স্থূলতা যেমন গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায় তেমনি খুব কম ওজন হলেও এই সম্ভাবনা বাড়ে।
[ আরও পড়ুনঃ গর্ভপাতের কারণ ও প্রতিকার ]
কি করে গর্ভপাত ঠেকাবেন?
যেহেতু গর্ভপাতের মুল কারণ কোষের ভেতর ক্রোমোজোমের ত্রুটি, তাই একে আটকানো খুব মুশকিল। গর্ভধারণ করার আগে ও গর্ভাবস্থায় মা যতটা সুস্থ থাকতে পারবেন, গর্ভপাতের সম্ভাবনা তত কমবে।
গর্ভধারণের আগে মা যদি সুস্থ থাকেন, ভ্রূণটিও সুস্থ বাঁচার পরিবেশ পাবে। নিয়মিত ব্যায়াম, সুস্ত খাদ্যাভ্যাস, শরীরের ওজন ঠিক সীমার মধ্যে রাখা, এবং অবশ্যই ধূমপান থেকে দুরে থাকতে হবে।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং থায়রয়েডের রোগ ইত্যাদি থাকলে সেগুলি সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। আবার ওষুধগুলো এমন করে বাছতে হবে যাতে সেগুলো গর্ভস্থ ভ্রূণের জন্য নিরাপদ হয়। গর্ভধারণ করার পরও এই সব নিয়ম মেনে চলতে হবেঃ সুস্থ থাকা, নেশামুক্ত থাকা, সঠিক ওজন বজায় রাখা ও কোন রোগ থাকলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা।
কিছু বিষয় মাথায় রাখবেন
- আপনার যদি গর্ভপাত হয়, জেনে রাখুন সেটা আপনার কৃতকর্মের জন্য হয়েছে এমনটা মোটেই নয়।
- গর্ভপাত আটকানোর জন্য আপনি ( নিজেকে সাধারণভাবে সুস্থ ও নেশা মুক্ত রাখা ছাড়া) কিছুই করতে পারতেন না বা পারবেন না।
- ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে সন্তান মারাত্মক ব্যাধি বা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারত, গর্ভপাত হবার ফলে প্রকৃতি স্বয়ং সে সম্ভাবনা রোধ করল।
- একবার গর্ভপাত হওয়ার পর আপনি যদি আবার গর্ভবতী হন, তার জন্য আপনাকে আলাদা যত্ন বা অতিরিক্ত বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন নেই।
সবার জন্য শুভকামনা।