শিশুর শরীর মাসাজ বা মালিশ কেন করবেন, কিভাবে করবেন?

Spread the love

শরীর মাসাজ শিশুর নিয়মিত পরিচর্যার অংশ। স্বাস্থ্যকর মাসাজ  শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশেও ভালো ভূমিকা রাখে। আর নিয়মিত মাসাজ করলে শিশু হবে প্র্রাণবন্ত ও ফুরফুরে।০-৩ বছরের শিশুদের মালিশ করার নিয়মটা বেশ আগে থেকেই রয়েছে। শিশুর পুরো শরীরে মালিশ করা হয়ে থাকে যা তার দেহের অভ্যন্তরীন গঠন এবং রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করে।

শিশুর দেহ গঠনে এই মালিশ করার কাজটি আসলেই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তবে আফসোসের ব্যাপার এই যে আমরা অনেকেই এর সঠিক নিয়ম জানিনা।তাই জেনে নিন শিশুকে কিভাবে মাসাজ  করাবেন এবং এর খুঁটিনাটি।

বিজ্ঞাপণ

মাসাজ এর উপকারিতা

মাসাজ এর ফলে শুধু বাচ্চা নয়, বাবা মাও বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। মাসাজের ফলে বাচ্চার যেসব উপকার হতে পারে তা হলো-

  • শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ঠান্ডা ,জ্বর ও পেটের অসুখের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
  • শিশুর মস্তিস্ক গঠনে সহায়তা করে।
  • শিশুর জড়তা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে সাহায্য করে এবং শিশুর হাড় মজবুত করে।
  • বাচ্চার মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
  • বাচ্চা শান্ত থাকে এবং খুব সহজে আপসেট হয়না।
  • কান্নাকাটি কম করে।
  • ঘুম ভালো হয়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে মাসাজের ফলে নবজাতকের জন্ডিস তাড়াতাড়ি ভালো হয়। বাচ্চাকে যখন মাসাজ করা হয় তখন তার সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম উদ্দীপিত হয়। এ সময় বেশ কিছু চেইন রিঅ্যাকশন হয়, যেমন- এ সময় বাচ্চা ব্রেইন সেরোটোনিন উৎপন্ন করে যা বাচ্চার মেজাজ ভালো রাখে এবং কম করটিসল উৎপন্ন হয় যা সাধারানত স্ট্রেস এর সময় ব্রেইন উৎপন্ন করে।

এর ফলে বাচ্চার শ্বাসপ্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন কমে আসে এবং বাচ্চা অনেক শান্ত থাকে। কলিক বাচ্চাদের জন্য ও মাসাজ অনেক উপকারি। এছারাও এর ফলে বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্যের এর উপকার হয়।

আপনি হয়ত দেখবেন বাচ্চাকে মাসাজ করার ফলে আপনার নিজের মুড অনেক ভালো থাকবে এবং মা হিসেবে নিজেকে অনেক পরিপূর্ণ মনে হবে। মাসাজের এ সময়টা হয়ে উঠবে আপনাদের বিশেষ সময় কারন যখন বাচ্চাকে মাসাজ করাবেন তখনই বাচ্চার সাথে অনেক বেশী কথা বলা হয় এবং আই কন্টাক্ট করা হয় যাতে দুজনের মদ্ধে বন্ডিং অনেক জোরালো হয়ে ওঠে।

যে সব মায়েরা প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতায় ভোগেন বা এর ঝুঁকির ভেতর থাকেন, তাদের জন্যও বাচ্চাকে মালিশ করানো উপকারি। বাচ্চাকে মাসাজ করানোর মাধ্যমে বাচ্চার সাথে মায়ের সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে যেটা মায়ের বিষণ্ণতা কাটাতেও সাহায্য করে।

শুধু মায়েদের জন্য নয়, বাবাদের জন্য বাচ্চাকে মাসাজ করাটা অনেক সুফল আনতে পারে। অনেক বাবা ব্যাস্ততার কারনে হয়ত বাচ্চাকে সময় দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বাবার হাতে নিয়মিত মাসাজ হয়ে উঠতে পারে বাবা ও বাচ্চার বন্ডিং এর মাধ্যম। বাবাদের অফিসের কাজের স্ট্রেস ও এটা কাটিয়ে দেবে।

মাসাজ প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের জন্য ও অনেক উপকারি-

এটি প্রি-ম্যাচিউর শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মাসাজ এর ফলে বাচ্চার “ভেগাস নার্ভ” উদ্দীপিত হয় যা বাচ্চার পাকস্থলী সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে ব্রেইনের সাথে সংযুক্ত করে। এই নার্ভকে উদ্দীপিত করার মাধ্যমে বাচ্চার মলমুত্র ত্যাগ এবং হজম প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটে, যার ফলে বাচ্চার ওজন ও বাড়তে থাকে।

মাসাজ এর ফলে আমাদের নার্ভাস সিস্টেম উন্নত হয় যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রন করে। এর ফলে প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চার হার্ট-রেট স্থিতিশীল থাকে। এছাড়াও যেসব প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চাকে নিয়মিত মাসাজ করা হয় তাদের ব্রেইনের উন্নতি স্বাভাবিক ভাবে হতে দেখা গেছে।

বাচ্চার মাসাজের সঠিক সময়

শিশুর  মাসাজ  যেন কখনই ভরা পেটে না হয়। তাই বলে শিশুর খালি পেটেও যেন না হয়। কারণ আমরা সবাই জানি শিশুরা ক্ষুধা পেটে ও ঘুমের সময় একটু খিটখিটে হয়ে যায়। তাই সব চেয়ে ভালো হয় যদি শিশুর খাওয়ার এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর শুরু করা যায়। ম্যাসাজের সবচেয়ে ভালো সময় গোসল করার আগে ১/২ ঘণ্টা আগে বা রাতের ঘুমের ১/২ ঘণ্টা আগে।

অব্যশই খেয়াল করতে হবে শিশু যেন অন্য সময়ের চেয়ে বেশি শান্ত থাকে কারণ শিশুর শান্ত থাকাটা খুবই জরুরী তাহলে শিশুর মাসাজ  পরিপূর্ণ উপভোগ করতে পারবে। তাই সম্ভব হলে টিভি বন্ধ রাখুন এবং শিশু গান শুনতে ভালোবাসলে অল্প ভলিউমে গান চালিয়ে রাখতে পারেন।

সব সময় চেষ্টা করুন রুমের পরিবেশ শান্ত রাখার। আপনি চাইলে বেবির সাথে গুন গুন করে গানও গাইতে পারেন। মোট কথা বেবি যেটা বেশি উপভোগ করবে তাই করতে হবে।

মাসাজ শুরু আগে কি কি প্রয়োজন

শিশুর বডি মাসাজ  দেওয়ার স্থানটি আলো-বাতাসপূর্ণ ও আরামদায়ক হতে হবে। মাসাজ  অয়েল হিসেবে আপনি ব্যবহার করতে পারেন ভেজিটেবল অয়েল, বেবি মিনারেল অয়েল, অলিভ অয়েল বা ভালো কোনো ময়েশ্চারাইজার।

তিলের তেল, বাদাম তেল, সরিষার তেল কিংবা ক্রিম দিয়ে শিশুর শরীর মাসাজ  করা উচিত না। কারণ এগুলো চামড়ার ক্ষতি ছাড়াও অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে খোলা তেল ব্যবহার না করে ভালো কোনো কোম্পানির বোতলজাত তেল ব্যবহার করা উচিত। এসব তেল রিফাইন্ড থাকে বলে অ্যালার্জির ঝুঁকি কম থাকে।

সরিষার তেল খুব ঘন বলে লোমকূপ বন্ধ করে দিয়ে ত্বকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে, তাই অলিভ অয়েল হতে পারে ভালো সমাধান। অবশ্য যেকোনো তেল দিলেই ত্বক আঠালো হয়ে যায়, এতে সহজেই ধূলিকণা জমে। তাই বাইরে গেলে তেল লাগানো উচিত নয়। তেল লাগানোর ভালো সময় হচ্ছে গোসলের পর। এ সময় ত্বকে সবচেয়ে বেশি জলীয় অংশ থাকে। আর এই জলীয় অংশকে অনেকক্ষণ ধরে রাখে তেল।

মাসাজ করার জন্য এমন জায়গা বাছুন যেখানে আপনি এবং বাচ্চা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। রুম যেন ঠাণ্ডা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চাকে নরম টাওয়েল বা চাদরের উপর শুইয়ে দিন। চাদরের নিচে ইউরিন ম্যাট দিতে পারেন। যদি শীতকাল হয় তবে বাচ্চার গায়ে হালকা কাপড় রাখতে পারেন।

যেহেতু এটা আপনার এবং বাচ্চার একটি বিশেষ সময় তাই রুম থেকে সব ধরনের ডিস্ট্রাকশন সরিয়ে রাখুন। মোবাইল বন্ধ রাখুন। ম্যাসাজের সময় শিশুর সঙ্গে মজার মজার কথা বলুন বা হালকা মিউজিক চালিয়ে রাখুন। এতে তার ভালো লাগবে এবং আপনার সঙ্গে বাচ্চার সম্পর্কের উন্নতিও হবে। মিউজিক এর শব্দ ছোট রাখুন যাতে বাচ্চা আপনার কথা শুনতে পায়।

মাসাজের সময় নরম কাপড় সাথে রাখুন যাতে তেল বা লোশন পড়লে তা মুছে নিতে পারেন। মাসাজের পর বাচ্চাকে পরানোর কাপড় এবং ডায়াপার হাতের কাছেই রাখুন।

বাচ্চার জন্য তেল বা লোশন যা ই ব্যবহার করুন না কেন, প্রথমে অল্প একটু বাচ্চার ত্বকে লাগিয়ে দেখুন তাতে বাচ্চার ত্বকে কোন রি-অ্যাকশন হচ্ছে কিনা। বাচ্চাকে মাসাজ শুরু করার আগের দিন এই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিন।

বিজ্ঞাপণ

বাচ্চার যদি একজিমা থাকে তবে ডাক্তারের দেয়া ক্রীমই ব্যাবহার করুন।

যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে

প্রথমেই নিজের হাতটি ভাল করে ধুয়ে নিন। খেয়াল রাখবেন আপনার হাতে থাকা জীবাণু কোনও ভাবেই যেন শিশুর ত্বকের সংস্পর্শে না আসে। বেবি অয়েল আগে নিজের হাতে নিয়ে একটু ঘষে নিন। আপনার শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে তেলের তাপমাত্রা মেলানো খুবই জরুরি।

বাচ্চার শরীর মাসাজ তার পা থেকে শুরু করুন যাতে সে মানিয়ে নেয়ার সময় পায়। পায়ে স্পর্শ বাচ্চার জন্য স্বস্তিদায়ক কারণ তার ডায়াপার পরিবর্তনের সময় পায়ে স্পর্শ পেতে সে অভ্যস্ত।মাসাজের সময় নিয়ম মেনে করার চেষ্টা করুন, যেমন প্রথমে পা, তারপর পেট, বুক হাত এভাবে। এতে বাচ্চা বুঝতে পারবে কোনটার পর কোনটা আসবে এবং সে এতে আরামবোধ করবে।

বাচ্চার প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করুন। বাচ্চা নিজেই আপনাকে বুঝিয়ে দিবে কখন মাসাজ বন্ধ করতে হবে। বাচ্চা যদি মাসাজের সময় কান্না শুরু করে তবে মাসাজ বন্ধ করে দিন।

শিশুদের সম্পুর্ন দেহই হয়ে থাকে খুব বেশি নমনীয়। আর তাই যে কোন কাজই করতে হয় সতর্কতার সাথে। অধিকাংশ মায়েরা যে সাধারণ ভুল করে থাকেন তা হচ্ছে হাতের তালু দিয়ে মালিশ করা। আপনার হাতের তালুর ঘর্ষণ সহ্য ক্ষমতা আপনার ছোট্ট শিশুর নেই।

হাতের তালুর বদলে আপনার আঙুলের অগ্রভাগের নমনীয় অংশ ব্যাবহার করুন। মনে রাখবেন শিশুর দেহে যত আলতো ভাবে মালিশ করতে পারেন ততই ওর জন্য ভালো। তাই তাড়াহুড়া করা বা জোরে মালিশ করা থেকে সম্পুর্ন বিরত থাকুন।

কিভাবে মাসাজ করবেন?

ছয়টি ধাপে শিশুকে ভালোভাবে মাসাজ করান যায়। এগুলো হলো-

ধাপ একঃ

প্রথমে শিশুর পা থেকে মাসাজ  করা শুরু করতে হবে। দুই হাত দিয়ে ভালোভাবে আলতো করে শিশুর দুই পায়ের পাতা থেকে হাটু পর্যন্ত মাসাজ  করতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে হাটুর উপরে উরুর অংশে মাসাজ  করতে হবে। দুই হাত দিয়ে আলতো করে চাপ দিলে শিশু আরাম পাবে। পায়ের আঙ্গুলগুলো আলতো করে মাসাজ করতে হবে।

ধাপ দুইঃ

পায়ের দিক থেকে পেটের নিচের অংশে মাসাজ  করতে হবে। ঘড়ির কাঁটার মতো করে পেটের উপর ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে মাসাজ  করতে হবে।

ধাপ তিনঃ

পেটের পর বুকের দিকে মাসাজ  শুরু করতে হবে। আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে চাপ দিয়ে শিশুর কাধ পর্যন্ত মাসাজ  করতে হবে।

ধাপ চারঃ

বিজ্ঞাপণ

তারপর শিশুর দুই হাত হালকা টেনে টেনে মাসাজ  করতে হবে। আঙ্গুল দিয়ে শিশুর হাত দুদিকে ছড়িয়ে নিয়ে মাসাজ  করাতে হবে।

ধাপ পাঁচঃ

তারপর শিশুর মুখমন্ডলে ধীরে ধীরে মাসাজ  করিয়ে দিতে হবে। শিশুর মুখের চারপাশে ছোট ছোট চাপ দিয়ে শিশুকে আরাম দিতে হবে।

ধাপ ছয়ঃ

সবশেষে শিশুর পেছন দিকে ভালোভাবে মালিশ করে দিতে হবে। মেরুদন্ডের দিক সোজা রেখে ঘাড় পর্যন্ত মালিশ করতে হবে যাতে শিশুর মেরুদণ্ড সোজা ও শক্ত হতে পারে।

শিশুকে মাসাজ করানোর সঠিক পদ্ধতি জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুন-


Spread the love

Related posts

Leave a Comment