শিশুর মুত্রনালীর প্রদাহ | ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন

Spread the love

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মুত্রনালীর প্রদাহ কি?

আমাদের শরীরে কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ও পানি শুঁষে নিয়ে ইউরিন তৈরি করে। প্রতিদিন এই ইউরিন আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়ে শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

কিডনি থেকে বেরিয়ে ইউরিন এক সরু টিউবের মধ্য দিয়ে গিয়ে ইউরিনারি ব্লাডারে জমা হয়। বাচ্চার বয়সের ওপর নির্ভর করে, কতটা ইউরিন ব্লাডারে জমা থাকবে। এরপর ব্লাডার থেকে জমা ইউরিন ইউরেথ্রার মধ্য দিয়ে গিয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপণ

ইউরিনারি ট্র্যাক্টে এমনিতে কোনো ব্যাকটেরিয়া থাকে না। কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া ব্লাডারে ঢুকে গেলে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশন হতে পারে। ব্লাডার ফুলে যায়, পেটের নিম্নাংশে যন্ত্রণা হতে পারে। যদি ব্যাকটেরিয়া কোনোভাবে কিডনি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তা হলে কিডনিতেও ইনফেকশন হতে পারে।

সাধারণত মলদ্বার বা যোনির আশপাশে এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। কোনো কারণবশত যদি ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ঠিকমতো কাজ না করতে পারে তা হলে ব্যাকটেরিয়া ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ঢুকে যায়। ফলে ইনফেকশন হতে পারে।

বাচ্চার বয়স একবছর হওয়ার আগে শতকরা ৮ ভাগ মেয়ে বাচ্চার এবং ২ ভাগ ছেলে বাচ্চার এ ধরনের ইনফেকশন হতে পারে। যদি এ ধরনের ইনফেকশনের সন্দেহ হয় তবে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন সাধারনত সহজে ভালো হয়ে যায় তবে এর চিকিৎসা করা না হলে তা থেকে কিডনি পুরপুরি অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মুত্রনালীর প্রদাহ কেন হয়?

কিছু বাচ্চার মধ্যে জন্ম থেকেই ভেসিকোইউরেটেরাল রিফ্লাক্স বলে এক ধরনের সমস্যা দেখা যায়। এই সমস্যায় ইউরিন ব্লাডার থেকে বেরিয়ে ইউরেটার হয়ে আবার কিডনিতে পৌঁছে যায়। ফলে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকটেড হয়ে পড়ে।

মায়েলোমেনিঙ্গোসিল, হাইড্রোসেফালসের মতো ব্রেন বা নার্ভাস সিস্টেমের অসুখ থাকলে ব্লাডার পুরোপুরি খালি হতে পারে না। স্পাইনাল কর্ডে চোট লাগলেও এই ধরনের সমস্যা হতে পারে। এর থেকে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশন হয়।

জন্ম থেকেই যদি ইউরিনারি ট্র্যাক্টের গঠনে কোনো ত্রুটি থাকে, তা হলে ব্যাকটেরিয়া সহজেই ইউরিনারি ট্র্যাক্টকে ইনফেক্টেড করে দিতে পারে।

বাচ্চার যদি বাথরুম যেতে অনীহা থাকে, বাথরুম যাওয়ার পর যদি কেউ নিজেকে ঠিকমতো পরিষ্কার না করে, তা হলে ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।ঘন ঘন বাবল বাথ নিলে ইনফেকশন হতে পারে। খুব বেশি টাইট জামাকাপড় পরলেও এই ধরনের সমস্যা দেখা যেতে পারে।

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের লক্ষণ

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রস্রাবে সংক্রমণ হলে কিছু বোঝা যায় না, প্রস্রাবে সংক্রমণ মানেই কিডনিতে ইনফেকশনের সম্ভাবনা থেকে যায়। আমাদের দেশে শতকরা দুই শতাংশ শিশু এ অসুখে ভোগে।

কোনো রকম লক্ষণ ছাড়াই শিশু প্রস্রাবের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। শিশু একটু বড় হলে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে। এতে লক্ষণ বুঝতে সুবিধা হয়। ফলে বাবা-মা বুঝতে পারেন। কিন্তু সমস্যা ছোট শিশুদের বেলায়। তারা কিছু বলতে পারে না। তাই বাবা-মায়ের লক্ষণ বুঝতে খুব অসুবিধা হয়।

ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশন হলে ব্লাডার ইউরেথ্রা, ইউরেটার ও কিডনিতে অস্বস্তি (ইরিটেশন) হয়। ঠিক যেমন ঠাণ্ডা লাগার পর নাক ও গলায় ইরিটেশন হয়। যেহেতু বাচ্চারা সব সময় বলে বোঝাতে পারে না, তাই বাচ্চার ব্যবহারে যদি হঠাৎ পরিবর্তন দেখেন, তা হলে বুঝবেন যে বাচ্চার শরীরে কোনো অস্বস্তি হয়ে থাকতে পারে। ইউটিআই হলে সাধারণত কিছু বিশেষ উপসর্গ দেখা যায়-

বিজ্ঞাপণ
  • জ্বর হতে পারে
  • বাচ্চা অকারণে বিরক্তি প্রকাশ করে
  • খেতে চায় না, বমি করে
  • ইউরিনে দুর্গন্ধ হতে পারে।
  • বাথরুম করার সময় ব্যথা হতে পারে বা জ্বালা করতে পারে।
  • তলপেটে বা পিঠের নিম্নাংশে ব্যথা হয়
  • অনেক সময় ইউরিনে রক্ত বেরোতে পারে।
  • টয়লেট ট্রেনিং থাকলেও বাচ্চা ইউরিন কন্ট্রোল করতে পারে না, অনেক সময়ই বিছানা ভিজিয়ে ফেলে।

যদি কোনোভাবে কিডনিতে ইনফেকশন ছড়িয়ে যায় তা হলে-

  • বাচ্চার কাঁপুনি হতে পারে।
  • খুব বেশি জ্বর আসে।
  • ত্বক লাল হয়ে যায়।
  • মাথা ঘোরে, বমি হয়।
  • পাঁজরে ব্যথা হতে পারে।

রোগ নির্ণয়

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন নির্ণয় করার জন্য ইউরিনের স্যাম্পল টেস্ট করা হয়। কেন ইনফেকশন হয়েছে বা কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা দেখার জন্য কিডনির আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়। এছাড়া ইউরিনেশনের সময় বিশেষ পদ্ধতি দ্বারা এক্স-রে করা হয়।

বাচ্চার মেডিকেল হিস্ট্রি নেয়া হয়। ডাক্তাররা জানতে চান বাচ্চার বয়স কত, আগে কখনও ইনফেকশন হয়েছে কিনা, ইনফেকশন কতটা জটিল, বাচ্চার আর কোনো অসুখ আছে কিনা, স্পাইনাল কর্ড বা ইউরিনারি ট্র্যাক্টে কোনো সমস্যা আছে কিনা। এর ওপর নির্ভর করে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেন যে, চিকিৎসার ধরন ঠিক কী রকম হবে।

চিকিৎসা

প্রথমেই বাচ্চাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় যাতে ইনফেকশন কিডনি পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে। একদম ছোট বাচ্চাদের হসপিটালে ভর্তি করে ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। বড় বাচ্চাদের অবশ্য ওষুধ খেতে দেয়া হয়।

ইনফেকশন কতটা জটিল তার ওপর নির্ভর করে অ্যান্টিবায়োটিক কত দিন খেতে হবে। মনে রাখতে হবে বাচ্চার অবস্থার যদি উন্নতি হয় তারপরও অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করতে হবে। নয়ত ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হবেনা এবং পরবর্তীতে আর শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ইউটিআই হলে বাচ্চাকে প্রচুর পানীয় পান করার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা।

মূত্রনালির প্রদাহ প্রতিরোধ

কিছু কিছু বাচ্চারা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ঝুঁকিতে বেশী থাকতে পারে। তবে কিছু কিছু উপায় অবলম্বন করে আপনি এর ঝুঁকি কিছুটা কমাতে পারেন

বাচ্চা যাতে প্রচুর পরিমাণ পানি পান করে, সে দিকে নজর দেবেন। বাচ্চা ছয় মাসের কম হলে বুকের দুধ যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। বেশী তরল পান করলে প্রস্রাব ও বেশী হবে এবং এর ফলে বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি ও কম থাকবে যার ফলে ইনফেকশনের ঝুঁকিও কমবে।

বাচ্চা যদি সলিড খাবার খাওয়া শুরু করে তাহলে তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি, ফলমূল খাওয়াবেন যাতে তার কোষ্ঠকাঠিন্য কম হয়।বাচ্চা যদি বুকের দুধ খায় তবে তাকে অন্তত ৭ মাস বুকের দুধ খাওয়ান। গবেষণায় দেখা গেছে বুকের দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের এসব ইনফেকশন কম হয়।

বাচ্চা যদি মেয়ে হয় তবে তার ক্ষারযুক্ত সাবান এবং বাবল বাথ পরিহার করুন। এবং তার যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করার সময় সামনে থেকে পেছনের দিকে পরিষ্কার করুন যাতে মলদ্বারের ব্যাক্টেরিয়া যোনি পর্যন্ত আসতে না পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্য, মলত্যাগের পর মলদ্বার ঠিকমতো পরিষ্কার না করা, সংক্রমণের অসম্পূর্ণ চিকিৎসা ইত্যাদি কারণে বারবার প্রস্রাবে সংক্রমণ হতে পারে। অতএব প্রস্রাবে সংক্রমণ এড়াতে হলে ওপরের বিষয়ের যথাযথ চিকিৎসা এবং শিশুকে মলমূত্র ত্যাগ সম্পর্কে স্বাস্থ্যসম্মত শিক্ষা দেয়া দরকার।

যেসব শিশুর প্রস্রাবে সংক্রমণ হয়, তাদের প্রস্রাব অন্তত প্রতি তিন মাসে একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত। যদি বারবার সংক্রমণ হয়, তা হলে স্বল্পমাত্রার উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত প্রয়োগ করতে হয়। এর ফলে শিশু ভবিষ্যতে কিডনির মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। মনে রাখা দরকার, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের সঠিক চিকিৎসার অভাবেই কিডনির কার্যকারিতার ব্যাঘাত ঘটে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment