নবজাতকের নাভি সংক্রান্ত কিছু জরুরী বিষয়

Spread the love

সন্তানের সাথে মায়ের থাকে নাড়ির সম্পর্ক। এই নাড়িকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয়ে থাকে আম্বিলিকাল কর্ড (Umbilical Cord)। এটি আসলে মা এবং বাচ্চার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে।

মায়ের দিকের অংশটি লাগানো থাকে জরায়ুতে (গর্ভফুলে) এবং বাচ্চার অংশটি থাকে বাচ্চার নাভিতে। এই পথে মায়ের কাছে থেকে বাচ্চা গর্ভকালীন সময়ে পুষ্টি পেয়ে থাকে। জন্মের পর বাচ্চার দিকের অংশটি কিছু রেখে এটি কেটে ফেলা হয় এবং এই সময় প্রয়োজন সঠিক যত্নের। অনেক সময় অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায় থাকেন নাভির যত্ন কিভাবে নিবেন?

বিজ্ঞাপণ

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাভির যত্ন নিয়ে অনেকে চিন্তিত থাকেন। কেউ ভাবেন তেল লাগিয়ে রাখলে ভালো, আবার কেউ বারবার অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগাতে চান। নবজাতকের নাভি কাঁচা থাকে। এর মাধ্যমে সদ্যোজাত শিশুর সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই নবজাতকের নাভির সঠিক যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নবজাতকের নাভি কখন পড়ে যায়?

জন্মের এক থেকে তিন সপ্তাহের মাঝে এই নাভি শুকিয়ে ঝরে পড়ে। এই সময়ের মাঝে নবজাতকের নাভির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিৎ। স্বাভাবিকভাবে নাভি ঝরে পড়লে এটি শিশুর দেহে খুবই সামান্য ক্ষত সৃষ্টি করে যা অতি অল্প সময়ের মাঝেই ভাল হয়ে যায়।

মনে রাখবেন নাভি সময়ের সাথে সাথে শুকনো, বিবর্ণ দেখানোই স্বাভাবিক। নাভি পড়ে যাবার পর জায়গায় রক্ত থাকতে পারে অথবা জায়গাটি লাল থাকতে পারে। এটি স্বাভাবিক এবং এর জন্য আলাদা কিছুর প্রয়োজন নেই।

নবজাতকের নাভির যত্নে করণীয়

জন্মের পর ডাক্তাররা শিশুর নাভিকে ক্ল্যাম্প করে বা পেঁচিয়ে ক্লিপের মত প্লাস্টিক বা মেটালের কর্ড ক্ল্যাম্প বা টেইপ লাগিয়ে দেন। এতে নাভিতে রক্ত প্রবাহ দ্রুত বন্ধ হয়ে যায় এবং নাভিতে ইনফেকশান হওয়ার সম্ভাবনাও কমে।

নাড়ি কাটার পর ৭ দশমিক ১ শতাংশ ক্লোরহেক্সিডিন লাগাতে হয়। প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীরাই এটি লাগিয়ে দেন। তবে ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে নাভিতে কোনো ড্রেসিং, ব্যান্ডেজ বা অ্যান্টিসেপটিক মলম কিছুই লাগানোর প্রয়োজন নেই। নাভি সব সময় শুকনো, পরিষ্কার ও খোলা রাখতে হবে। অহেতুক নাভিতে হাত দেবেন না।

আগে নবজাতকের নাভীর যত্নে অ্যান্টিসেপটিক পাউডার বা অ্যালকোহলে ভিজানো তুলা ব্যবহার করা হত। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষনায় বলা হয়েছে নাভী যত শুস্ক রাখা যাবে তত ইনফেকশন কম হবে।

কুসুম গরম পানিতে দিয়ে ধুইয়ে একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে জায়গাটি মুছে দিতে পারেন রোজ ১ বার করে। অনেকে গরম সেঁক দিয়ে থাকেন যা একদম ঠিক নয়। অনেকে আবার অ্যালকোহল দিয়ে পরিষ্কার করে থাকেন, এতে অনেক সময় জ্বালা-পোড়া হতে পারে।

বিজ্ঞাপণ

শিশুর নাভি যথাসম্ভব পরিষ্কার এবং শুকনো রাখতে হবে।শিশুকে ডায়পার পরানোর সময় খেয়াল রাখুন ডায়পার যেন নাভিকে কোন অবস্থাতেই ঢেকে না রাখে। নাভি যেন বেশিরভাগ সময় বাতাসে উন্মুক্ত থাকে।

নাভি ঝরে না যাওয়া পর্যন্ত শিশুকে টাবে বা সরাসরি গায়ে পানি ঢেলে গোসল করানো উচিৎ নয়। জন্মের পর প্রথম ৩ সপ্তাহ স্পঞ্জের সাহায্যে শিশুর গা আস্তে আস্তে মুছে মুছে পরিষ্কার করা উচিৎ।নাভি ঝরার সময় এমন হতে পারে নাভির কিছুটা অংশ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার কিছু অংশ সুতার মত শরীরের সাথে যুক্ত থাকতে পারে। এই সময় কোন অবস্থাতেই নাভি ধরে টানা উচিৎ নয়।

জন্মের পর পরই নাভির যত্ন নিলে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে ইনফেকশন প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে শিশুর জন্মদানের ব্যবস্থা করা; তার মলমূত্র নাভিতে যেন না লাগে, এদিকে খেয়াল রাখা; নাভির জায়গা শুকনো রাখা, এসব সাবধানতা অবলম্বন করলে নাভিতে ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

কখন ডাক্তার এর শরণাপন্ন হবেন/ বিপদ সংকেত

নবজাতকের নাভি দিয়ে অনেক সময় দুর্গন্ধযুক্ত সাদা পুঁজজাতীয় পদার্থ নিঃসরণ হতে পারে। এ অবস্থার নাম শিশুর নাভির ইনফেকশন বা আমবিলিক্যাল সেপসিস। নাভির ইনফেকশনে নাভির চারপাশ লালচে হয়ে যায় এবং নাভি দিয়ে ক্রমাগতভাবে বিশেষ পদার্থ নিঃসরণ হতে থাকে। এসব ক্ষেত্রে আপনি বাচ্চার নাভিতে হাত দিলে সে কান্না করবে।

স্টেফাইলোকক্কাস নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে সাধারণত এমনটি হয়ে থাকে। নাভির স্রাবের রুটিন ও কালচার পরীক্ষা করে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়। অনেক সময় নাভি থেকে এটি লিভারে গিয়ে রক্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন জন্ডিস, লিভারের ফোড়াসহ ভয়াবহ অবস্থার উদ্ভব হতে পারে। কখনো কখনো এ ইনফেকশন হাড় অথবা অন্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি নবজাতকের জটিল ও ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা। তাকে তখন নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাচ্চার নাভি ফুলে উঠছে এবং কাঁদলে আরও বেশি ফোলে। শিশুর নাভির চারপাশের মাংসপেশির দুর্বলতার কারণে এমনটি হয়। একে নাভির হার্নিয়া বলে। কান্নাকাটি করলে, কোষ্ঠকাঠিন্য বা অন্য কোনো কারণে পেটের ভেতরে চাপ বেড়ে গেলে নাভি আরও ফুলে ওঠে। পরে আবার আগের মতো হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক বছরের মধ্যে এটি ভালো হয়ে যায়।

বড় হার্নিয়ার ক্ষেত্রে চার-পাঁচ বছরও লাগতে পারে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। তবে হার্নিয়ার ভেতরে নাড়ি আটকে গেলে, লাল হয়ে গেলে বা অনেক কান্নাকাটি করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

নাভি থেকে যদি নিয়মিত রক্তপাত হয় তাহলে এটি রক্ত জমাট বাধা প্রক্রিয়া এর সমস্যা এর লক্ষণ হতে পারে। নবজাতককে যদি নিস্তেজ দেখায়, সে দুধ চুষে খাওয়া বন্ধ করে দেয়, সঠিকভাবে না তাকায়, জেগে উঠছে না বা শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হচ্ছে, তাহলে মনে করতে হবে, এ হলো নবজাতকের গুরুতর ইনফেকশন। তখন শিশুকে তড়িৎ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment