শিশুর জ্বরজনিত খিঁচুনি (Febrile Convulsion)

Spread the love

অনেক সময় শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বরের পর খিঁচুনি হয়। এটি কখনো কখনো জটিল হতে পারে। আবার কখনো সাধারণ হতে পারে।  জ্বরের পড়ে খিঁচুনি হলে তিনটি রোগ হতে পারে। এর মধ্যে একটি রোগকে বলা হয় ফিব্রাইল কনভালশন Febrile seizure (febrile convulsion) । যেটা জ্বরজনিত খিঁচুনি।

আর দুটি রোগ আছে। ম্যানিনজাইটিস ও অ্যানগেফেলাইটিস। এই দুটি রোগ খুব খারাপ। যদি ফ্যাবরাইল কনভালশন হয়, তাহলে আসলে অতটা ভয়ের কিছু নেই।                                                              

বিজ্ঞাপণ

বাচ্চার জ্বরজনিত খিঁচুনি Febrile seizures

বাচ্চার জ্বরজনিত খিঁচুনি এক ধরণের মূর্ছা যাওয়া যা বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলে অর্থাৎ জ্বরের কারণে হয়। জ্বরজনিত খিঁচুনি সচরাচর ৬ মাস থেকে ৩ বছরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে।

বাচ্চার হঠাৎ খিচুনি হওয়া অনেক সময় অভিভাবকদের জন্য এক ধরণের ভিতিকর অবস্থা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ায়, বিশেষ করে তা যদি বাচ্চার প্রথমবার হয়ে থাকে।

তবে এই ধরণের পরিস্থিতি বাচ্চার সাধারণত তেমন কোন ক্ষতি করেনা এমন কি প্রায় সব বাচ্চাই একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সুস্থ হয়ে যায়।

তারপরেও এই ধরণের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সতর্কতা সরূপ বাচ্চাকে নিকটস্থ কোন ক্লিনিকে অথবা জরুরী মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ভালো কোন হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত।

জ্বর সংক্রান্ত খিচুনির লক্ষন সমূহ

শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারনে যেই খিচুনি হয় তা সচরাচর ৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে থাকেনা এবং খিচুনির সময় বাচ্চার মধ্যে নিচের লক্ষন সমূহ দেখা যাবে-

  • বাচ্চার শরীর শক্ত হয় যাবে এবং হাত পা ঝাঁকি দিতে পারে।
  • জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে এমন কি কখনো প্রসাব পায়খানা করে দিতে পারে।

এছাড়াও বাচ্চা বমি অথবা মুখে ফেনা তুলতে পারে এমন কি চোখও উলটাতে পারে। খিচুনির পর বাচ্চার ঘণ্টা খানেকের মতো ঘুম ঘুম ভাব থাকতে পারে। এই ধরণের খিঁচুনি বাচ্চার অসুস্থতার সময়জুরে শুধুমাত্র একবারই হতে পারে।

মাঝে মাঝে খিঁচুনি ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরেও থাকতে পারে এবং তা বাচ্চার শরীরের যেকোনো অংশে আক্রমণ করতে পারে। এই ধরণের খিঁচুনিকে কে complex febrile seizures বা ‘জটিল জ্বর আক্রান্ত খিঁচুনি’ ও বলা হয়। Complex Febrile Seizures অনেক সময় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবার অথবা বাচ্চা অসুস্থ থাকাকালীন যেকোনো সময় হতে পারে।

বাচ্চার জ্বর সংক্রান্ত খিঁচুনি হলে কি করবেন?

জ্বরের পরে যদি খিঁচুনি হয়, কিছু জিনিস খেয়াল রাখতে হবে । যদি খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের কম হয়, যদি খিঁচুনির পরে সে অজ্ঞান না হয়ে যায়, তাহলে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। এই ধরনের ইতিহাস যদি আগেও থাকে যে তার জ্বরের পর খিঁচুনি হয়েছে, তাহলে এটা ফ্যাবরাইল কনভালশন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।

সে ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন না হয়ে, বাম কাত বা ডান কাত করে তার ঘাড়কে একটু উঠিয়ে শুইয়ে দিতে হবে। মুখ দিয়ে কোনো ধরনের নিঃসরণ বের হলে পরিষ্কার করে দিতে হবে। তার শ্বাসনালিটা পরিষ্কার রাখতে হবে। । যদি সম্ভব হয় বাচ্চার খিঁচুনি এর স্থায়িত্বকাল কোন খাতায় বা নোটবুকে নোট করে রাখুন।

খিঁচুনির সময় বাচ্চার মুখে কোন কিছুই দেয়া যাবেনা, এমনকি ওষুধও না। এতে করে বাচ্চা জিহ্বাতে কামড় দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পরিস্থিতি ভালোর দিকে না গেলে বাচ্চাকে নিকটস্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে অর্থাৎ –

  • যদি এই ধরনের পরিস্থিতি আপনার বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রথমবার হয়ে থাকে।
  • যদি দেখেন বাচ্চার খিঁচুনি ৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে আছে অথচ থামার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা।
  • যদি মনে করেন যে বড় ধরণের কোন রোগের কারণে খিঁচুনি হচ্ছে।
  • যদি দেখেন যে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

যদিও খিঁচুনি হওয়া মানেই এমন না যে বাচ্চার গুরুত্বর কোন সমস্যা হয়েছে। তারপরেও এই ধরণের পরিস্থিতিতে বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে চেক করে নেওয়া উচিত।

বাচ্চার আগেও এই ধরণের খিঁচুনি হয়ে থাকলে এবং তার স্থায়িত্বকাল ৫ মিনিটের বেশি না হলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে এই ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারেন।

এছাড়াও বাচ্চার ডিহাইড্রেশন অথবা শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষন দেখা দিলে জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারকে কল করতে হবে। এইসব লক্ষণগুলোর মধ্যে আরও কিছু রয়েছে যেমন-

  • মুখ শুকিয়ে যাওয়া
  • চোখ ছোট হয়ে আসা
  • বাচ্চা কান্না করলে চোখ থেকে পর্যাপ্ত পানি না আসা
  • বাচ্চার মাথার নরম অংশ দেবে যাওয়া।

বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানো

খিঁচুনির সময় বাচ্চা কেমন আচরণ করেছিল, খিঁচুনির স্থায়িত্বকাল ডাক্তারকে এইসব কিছু বিস্তারিত বলার মাধ্যমে ডাক্তার বুঝতে পারবেন যে আসলে তা জ্বরের কারণে হয়েছিল কিনা। যেহেতু খিচুনির সময় ডাক্তার উপস্থিত না থাকায় বাচ্চার কেমন করছে তা ডাক্তার নিজে থেকে দেখতে পাননা তাই বাচ্চার খিঁচুনির সময় তার বিস্তারিত নোট করে রাখতে হবে। যেমন-

  • খিঁচুনির স্থায়িত্তকাল কত ছিল।
  • খিঁচুনির সময় বাচ্চার আচরণ কেমন ছিল। (যেমন- জ্ঞান হারানো, হাত পা বা মুখমণ্ডল ঝাঁকি দেয়া, শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, শরীর শক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।)
  • খিঁচুনির পর ১ ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চা সুস্থ হয়েছে কি না?
  • বাচ্চার আগে কখনো এই ধরণের খিঁচুনি হয়েছিল কি না।

বাচ্চার অসুস্থতার কারণ নির্দিষ্ট করা না গেলে রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হতে পারে। ৩-৫ বছরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য প্রসাবের নমুনা পাওয়াটা কখনো কষ্টকর হয়ে দাড়ায়। তাই হাসপাতালেই সব ধরণের নমুনা সংগ্রহ ও পরিক্ষার যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করে নেওয়া উচিত।

বিজ্ঞাপণ

বাচ্চার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখা দিলে ডাক্তার আরও বেশ কিছু পরীক্ষা করার জন্য বলবেন বিশেষ করে বাচ্চার বয়স যদি ১২মাসের কম হয় সেক্ষেত্রে তাকে হাপাতালে রেখে সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখার পরামর্শ দিবেন।

এক্ষেত্রে ডাক্তার যে সকল পরীক্ষার জন্য বলতে পারেন তার মধ্যে অন্যতম হল-

  • Electroencephalogram (EEG) এই পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চার বাচ্চার মাথায় ইলেক্ট্রোড বসিয়ে তার ব্রেইনের তৎক্ষণাৎ কার্যকলাপ পরিমাপ করা হয়ে থাকে। অনেক সময় ব্রেইনের অস্বাভাবিক আচরণ বাচ্চার মৃগী রোগের ইঙ্গিত দেয়।
  • Lumbar puncture এই পরিক্ষায় নমুনা হিসেবে সামান্য Cerebrospinal fluid (CSF)  নেওয়া হয়। Cerebrospinal fluid (CSF) হল এক ধরণের তরল পদার্থ, যা আমাদের মস্তিস্ক এবং স্পাইনাল কর্ডকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখে প্রতিরক্ষা দেয়। বাচ্চার মস্তিস্কে অথবা নার্ভে কোন ধরনে ইনফেকশন হয়েছে কিনা এই পরিক্ষার মাধ্যমে তা বোঝা যায়।

খিঁচুনি কেন হয়?

খিঁচুনির সঠিক কারণ আজ পর্যন্ত অজানা। যদিও জ্বর হওয়ার সাথে খিঁচুনির একটা সম্পর্ক রয়েছে অর্থাৎ বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা 100.4F এর বেশি হলে।

আবার বংশগত কারনেও খিঁচুনি হতে পারে। অর্থাৎ পরিবারের ঘনিষ্ঠ কারো পূর্বে এই ধরণের খিঁচুনি হয়ে থাকলে তা বাচ্চার হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইনফেকশনের কারণে শরীরের তাপমাত্রা অধিক মাত্রায় বেড়ে যায়। যেমন- চিকেন পক্স, ফ্লু, টনসিল, কানের ভেতরে ইনফেকশন ইত্যাদি।

খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে টিকা দেয়ার পর বাচ্চার খিঁচুনি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, MMR ভ্যাক্সিন দেয়ার পর প্রতি ৩০০০ থেকে ৪০০০ জনের মধ্যে ১ জন বাচ্চার এই ধরণের খিঁচুনি হতে পারে। আবার DTaP/IPV/Hib টিকা দেয়ার পর এই ঝুঁকি আরও কম।  যারা DTaP/IPV/Hib ভ্যাক্সিন নিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে প্রতি ১১০০০-১৬০০০ বাচ্চার মধ্যে একজনের খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

খিঁচুনির পুনরাবৃত্তি

পূর্বে খিঁচুনি হয়েছিল এমন প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ বাচ্চার পরবর্তী কোন ইনফেকশন হলে আবার খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তার বেশির ভাগই প্রথমবার খিঁচুনি হওয়ার ১ বছরের মধ্যেই হয়ে থাকে।

এই ধরণের খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে যদি-

  • বাচ্চার ১৮ মাস বয়সের আগেই প্রথম খিঁচুনি হয়
  • পরিবারের কারো খিঁচুনি অথবা মৃগীরোগ থাকলে
  • প্রথম বার খিঁচুনি হওয়ার আগে বাচ্চার জ্বরের স্থায়িত্বকাল ১ ঘণ্টার কম হলে এবং জ্বরের মাত্রা ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইটের এর কম থাকলে।
  • আগেও অসুস্থ থাকা কালীন বাচ্চার একের অধিক খিঁচুনি হয়ে থাকলে।
  • বাচ্চাকে ডে-কেয়ার নার্সারি তে রাখলে (এতে করে বাচ্চার সাধারণ ইনফেকশন গুলো যেমন- ফ্লু, চিকেনপক্স হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে)

ভবিষ্যতে খিঁচুনি প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত কোন ওষুধ খাওয়ানো যাবেনা কেননা অনেক ওষুধের কারণে বাচ্চার বিভিন্ন ধরণের সাইড ইফেক্ট দেখা যার ঝুঁকি খিঁচুনির ঝুঁকির চাইতে বেশী হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখতে কোন ওষুধের ব্যাবহার বাচ্চার খিঁচুনি প্রতিরোধে তেমন কোন কাজ করেনা।

তবে বিশেষ পরিপেক্ষিতে বাচ্চার খিঁচুনির পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার জন্য চিকিৎসা নিতে হবে। উদাহারন সরূপ, যেসব বাচ্চার হালকা অসুস্থতায় খিঁচুনি হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে এবং যাদের খিঁচুনির স্থায়িত্বকাল বেশী হয়।  

এই সকল বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ডাক্তার হয়তো বেশ কিছু ওষুধ লিখে দিতে পারেন যেমন- Diazepam অথবা Lorazepam যা বাচ্চার জ্বর আসার প্রথম দিকে বাচ্চাকে দিতে হয়।

তবে যেসব বাচ্চার টিকা নেয়ার পর খিঁচুনি হয়েছে তাদের আর পরবর্তীতে খিঁচুনি হওয়ার তেমন কোন ঝুঁকি থাকেনা।

জ্বর সংক্রান্ত খিঁচুনির জটিলতা

গবেষকেরা সাম্প্রতি খিঁচুনি ও বাচ্চার আকস্মিক মৃত্যুর মধ্যেকার সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারনা করছেন। তবে এই তথ্যটি এখনো প্রমাণিত হয়নি এমন কি বর্তমানে শিশুর আকস্মিক মৃত্যুর হার খুবই কম যা প্রায় ০.০০১% ।

বড় ধরণের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ১.৫ লক্ষেরও বেশি বাচ্চার ক্ষেত্রে পূর্বে খিঁচুনি হওয়া সত্ত্বেও তা পরবর্তীতে আকস্মিক মৃত্যুর কোন ধরণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেনা।

খিঁচুনি ও মৃগী রোগ

অনেক অভিভাবকেই শঙ্কায় থাকেন যে জ্বরের কারণে বার বার খিঁচুনি হলে পরবর্তীতে তার মৃগীরোগে হতে পারে। আসলে মৃগীরোগের ক্ষেত্রে জ্বর না আসলেও বার বার খিঁচুনি হতে পারে।

যদিও এটা সত্যি যে, যাদের পূর্বে জ্বরের কারনে খিঁচুনি হয়েছে তাদের মধ্যে মৃগীরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে তারপরও এই সম্ভাবনাটাও অনেক কম।  

ধরা হয়ে থাকে যে, যেসব বাচ্চার পূর্বে জ্বরের কারনে খিঁচুনি হয়েছিল তাদের প্রতি ৫০ জনের একজন প্রাপ্ত বয়সে মৃগীরোগ হতে পারে। আবার যাদের একাধিক বার খিঁচুনি আসতো তাদের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি। তাদের মধ্যে প্রতি ২০ জনের ১ জনের পরবর্তীতে মৃগীরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

তবে যাদের কখনই এই ধরণের খিঁচুনি হয়নি তাদের ক্ষেত্রেও প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১ জনের মৃগীরোগ হতে পারে।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment