অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা (Anterior Placenta) কি ? এর ফলে কি কি সমস্যা হতে পারে ?

Spread the love

গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল তৈরি হয়, যা জরায়ুর ভেতরের দেয়ালে লেগে থাকে। মা ও ভ্রূনের যোগাযোগ এই গর্ভফুলের মাধ্যমেই হয়। প্লাসেন্টা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা ভ্রুনকে অক্সিজেন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান সরবরাহ করে এবং শিশুর রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা

সাধারণত নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর দেয়ালের যে অংশে গেঁথে যায় ঠিক সে জায়গাতেই প্লাসেন্টার গঠন শুরু হয়। বেশিরভাগ গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা জরায়ুর শীর্ষভাগে অথবা পেছনে অবস্থান করে । তবে প্লাসেন্টার গঠন সব মায়েদের একই   স্থানে হয় না।

বিজ্ঞাপণ

গর্ভাবস্থার ১৮-২০ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ডে প্লাসেন্টার অবস্থান জানা যায়। প্লাসেন্টার গঠন জরায়ুর ভিন্ন ভিন্ন অংশে হতে পারে, যেমন-

  • অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা (Anterior placenta)- প্লাসেন্টা যখন জরায়ুর দেয়ালের সামনের অংশে থাকে।
  • পোস্টেরিয়র প্লাসেন্টা (Posterior placenta)- প্লাসেন্টা যখন জরায়ুর দেয়ালের পেছনের অংশে থাকে।
  • ফান্ডাল পজিশন (Fundal position)- প্লাসেন্টা যখন জরায়ুর দেয়ালের উপরের অংশে থাকে।
  • Right or left lateral position – প্লাসেন্টা যখন জরায়ুর দেয়ালের বাম বা ডান পাশে থাকে।
  •  Low lying placenta: প্লাসেন্টা জরায়ুমুখ ঢেকে রাখেনি কিন্তু জরায়ু মুখের ২ সেমি এর ভেতর অবস্থিত।
  • Away from OS: প্লাসেন্টা যখন জরায়ুমুখ থেকে দুরে অবস্থান করে।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা কি?

সাধারণত প্লাসেন্টা জরায়ুর দেয়ালের পেছনের দিকে উপরের অংশে মেরুদণ্ডের (spine) কাছাকাছি থাকে। তবে কখনো কখনো তা জরায়ুর সামনের দেয়ালে লাগানো থাকতে পারে। এ অবস্থাকে বলা হয় অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা। এক্ষেত্রে প্লাসেন্টা জরায়ুর সামনের দিকে অর্থাৎ মায়ের পেটের দিকে থাকে এবং গর্ভের ভ্রুন প্লাসেন্টার পেছনে থাকে।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা
অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা

শুরুতে অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা থাকলেও বেশীরভাগ সময় জরায়ুর আকার বাড়ার সাথে সাথে প্লাসেন্টা উপরের দিকে উঠে যায় এমনকি তা পোস্টেরিয়র পজিশনেও চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা কেন হয়?

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা কেন হয় তার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যাদের রক্তের গ্রুপ O+ তাদের ক্ষেত্রে অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে কন্সেপশনের সময় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর দেয়ালের সামনের দিকে আটকে যেতে পারে যার কারণে সেখানেই প্লাসেন্টার গঠন শুরু হতে পারে।

তবে এই দুটো কারণ নিয়ে খুব বেশি একটা গবেষণা হয়নি এবং এর স্বপক্ষে তেমন কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে কি কোন সমস্যা হতে পারে?

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে মায়ের বা গর্ভের শিশুর তেমন কোন সমস্যা হয়না। প্লাসেন্টার অবস্থানের কারণে ভ্রুনের প্রয়োজনীয় পুষ্টিরও  কোন ঘাটতি হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর কোন উপসর্গ আপনি অনুভব করবেন না। তবে এ ধরনের অবস্থানের কারণে মায়ের কিছু কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন-

ভ্রুনের নড়াচড়া বুঝতে সমস্যা হয়

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা মায়ের পেটের এবং ভ্রুনের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এটি ভ্রুনের সামনে কুশনের মত অবস্থান করে ফলে বাচ্চার নড়াচড়া এবং লাথি তেমন একটা টের পাওয়া যায়না।

যাদের অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা থাকে তারা সাধারণত অন্যদের তুলনায় দেরীতে নড়াচড়া টের পান বা টের পেলেও অন্যদের মতো অতটা তীব্রভাবে অনুভব করতে পারেন না।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারেও নড়াচড়া বুঝতে না পারা বা কম অনুভব করা স্বাভাবিক। তবে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে কোন নড়াচড়া টের না পেলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।

আরও পড়ুনঃ গর্ভের শিশুর নড়াচড়া সংক্রান্ত কিছু জরুরি বিষয়।

বাচ্চার হার্টবিট বুঝতে সমস্যা হয়

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা যেহেতু মায়ের পেট এবং ভ্রুনের মাঝখানে অবস্থান করে তাই এ ধরনের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পক্ষে ভ্রুনের হার্টবিট পরীক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে আল্ট্রাসাউন্ডে কোন সমস্যা হয়না।

বিজ্ঞাপণ

আরও পড়ুনঃ  গর্ভের শিশুর হার্টবিট কখন শুরু হয়?

অ্যামনিওসিন্টেসিস করা কঠিন হয়

এছাড়াও অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে amniocentesis ( এমনিওটিক ফ্লুইড পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চার ডাউন সিন্ড্রোম এবং অন্যান্য জন্মগত ত্রুটি নির্ণয়ের পরীক্ষা) করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

অ্যামনিসিন্টেসিসের মাধ্যমে মায়ের অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড পরীক্ষা করা হয়। এটি করার জন্য মায়ের পেটের ভেতর সুঁই প্রবেশ করিয়ে এর মাধ্যমে জরায়ু থেকে অ্যাম্নিওটিক ফ্লুয়িড সংগ্রহ করা হয়। অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা যেহেতু সামনের দিকে থাকে তাই সুঁই প্রবেশ করানো কঠিন হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বিকল্প ব্যাবস্থায় এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। 

লেবার পেইন দীর্ঘতর এবং তীব্র হতে পারে

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে গর্ভের শিশু অক্সিপুট পোস্টেরিয়র  (occiput posterior) অবস্থানে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ভ্রূণ এই অবস্থানে থাকলে মায়ের প্রসব যন্ত্রণা দীর্ঘক্ষণ থাকতে পারে এবং তীব্রতর হতে পারে।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে কখন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে?

দুটি ক্ষেত্রে অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমত যদি সি-সেকশন ডেলিভারি করতে হয় এবং যদি প্লাসেন্টা লো-লায়িং হয়।

সিসেকশনে জটিলতাঃ

সি সেকশানের সময় সাধারণত যে অংশে সার্জারী করতে হয় অর্থাৎ পেটের ভেতর যে অংশগুলো ছেদ করতে হয়,  অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার অবস্থান সেই জায়গা বরাবর হতে পারে। এক্ষেত্রে রক্তপাতের ঝুঁকি কমানোর জন্য জরায়ুর উপরের দিকে কাটা হয়। এ জন্য আলট্রাসাউন্ড করে দেখে নেয়া হয় কোন স্থান কাটার জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ।

এছাড়াও যদি আগে সি-সেকশন করা হয়ে থাকে তবে অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা আগের যে স্থানে জরায়ু কাটা হয়েছিল তার উপর গঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে প্লাসেন্টা জরায়ুর কাটার ভেতরে গেঁথে যেতে পারে বা জরায়ুর দেয়াল ভেদ করে যেতে পারে যাকে প্লাসেন্টা অ্যাকরিটা বলে। তবে এর সম্ভাবনা খুব কম।

প্লাসেন্টা লোলায়িং হলেঃ

প্লাসেন্টা যদি লো- লায়িং হয় এবং ৩৪ সপ্তাহের পরও তা যদি নিচের দিকেই থাকে এবং জরায়ু মুখ আংশিক বা পুরোপুরি ব্লক করে রাখে তবে তাকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বলে। প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার কারণে সময়ের আগেই সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা থাকে। প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে সিজারিয়ানই একমাত্র অপশন।

বিজ্ঞাপণ

তবে মনে রাখবেন, অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার কারণে যেসব জটিলতা হতে পারে তার সবই অনেক আগে থেকেই আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় এবং সবগুলো জটিলতাই  সমাধানযোগ্য। আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে এবং দুশ্চিন্তা এবং স্ট্রেস থেকে দূরে থাকতে হবে।

অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টার ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারিতে কি কোন সমস্যা হয়?

মায়ের অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা থাকলে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব। নরমাল ডেলিভারিতে অ্যান্টেরিয়র প্লাসেন্টা কোন সমস্যা করেনা। তবে যদি প্লাসেন্টা নীচের দিকে থাকে অর্থাৎ প্লাসেন্টা প্রিভিয়া থাকে তবে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হয়না।

কখন ডাক্তারকে জানতে হবে

যদি নীচের লক্ষণগুলো দেখেন তবে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে-

  • যদি রক্তক্ষরণ (vaginal bleeding) হয়।
  • যদি জরায়ুতে ঘন ঘন কট্রাকশন অনুভব করেন।
  • যদি ব্যাক পেইন এবং পেটে ব্যথা তীব্র হয়।
  • যদি ভ্রুনের নড়াচড়া কমে যায়।

সবার জন্য শুভকামনা


Spread the love

Related posts

Leave a Comment