অ্যানোমালি স্ক্যান কি? গর্ভাবস্থায় অ্যানোমালি স্ক্যান কখন এবং কেন করতে হয় ?

Spread the love

সাম্প্রতিককালে প্রেগন্যান্সি সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাগুলোর মধ্যে একটি হল অ্যানোমালি স্ক্যান কি, কেন এবং কখন করতে হয়। অনেকেই আবার জানতে চান সাধারণ আলট্রাসাউন্ডের সাথে অ্যানোমালি স্ক্যানের পার্থক্য আছে কিনা। এসবের খুঁটিনাটি নিয়েই আজকের আলোচনা।

অ্যানোমালি স্ক্যান

অ্যানোমালি স্ক্যান কি?

অ্যানোমালি স্ক্যান এক ধরণের আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান যার মাধ্যমে গর্ভস্থ ভ্রূণ, প্লাসেন্টা এবং মায়ের পেলভিক অঙ্গগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই স্ক্যান রুটিন প্রিন্যাটাল কেয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বিজ্ঞাপণ

অ্যানোমালি স্ক্যানকে Level 2 Ultrasound, Anatomy scan, Mid-Pregnancy scan এবং Morphology scan নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।

অ্যানোমালি স্ক্যান এবং সাধারণ আলট্রাসাউন্ড একই পদ্ধতিতে এবং একই মেশিনের সাহায্যে করা হয় কিন্তু এই দুটোর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো অ্যানোমালি স্ক্যানে জরায়ু এবং ভ্রূণের বৃদ্ধি বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়।

অ্যানোমালি স্ক্যানে সাধারণত 2D আলট্রাসাউন্ড মেশিন ব্যবহার করা হয়। তবে ভ্রূণের বৃদ্ধির কোন অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে তা আরও ভালোভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরবর্তীতে 3D আলট্রাসাউন্ডের পরামর্শ দেয়া হতে পারে।

অ্যানোমালি স্ক্যান কি কারণে করা হয়

অ্যানোমালি স্ক্যান-এর মাধ্যমে সাধারণত যে বিষয়গুলো পরীক্ষা করা হয় সেগুলো হলো-

গর্ভাশয়ে কয়টি ভ্রূণ আছে, তার সংখ্যা। কখনো  কখনো  গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহের আগ পর্যন্ত যমজ সন্তান আছে কিনা তা বোঝা যায়না, কিন্তু অ্যানোমালি স্ক্যানে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়।

ভ্রূণের মাথার গঠন ও আকৃতি। শিশুর মস্তিস্কে ত্রুটি থাকলে এই স্ক্যানে বুঝতে পারার সম্ভবনা থাকে, যদিও এরকম ঘটনা খুবই কম ঘটে।

ভ্রূণের হৃদপিণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হয়। হৃদপিণ্ডের চারটি প্রকোষ্ঠ পরিমাপ করা হয়। উপরের দুটি প্রকোষ্ঠ বা অলিন্দ (ATRIA) এবং নীচের দুটি প্রকোষ্ঠ বা নিলয় (VENTRICLES) আয়তনে সমান আছে কিনা তা দেখা হয়। প্রতিটি হৃদস্পন্দনের সাথে সাথে কপাটিকাগুলি খোলা এবং বন্ধ হচ্ছে কিনা সেটাও পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও প্রধান ধমনী এবং শিরাগুলো দেখে নেয়া হয় যেগুলো রক্ত প্রবাহকে হৃদপিন্ডে নিয়ে আসে বা হৃদপিন্ড থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়।

ভ্রূণের পাকস্থলীও পরীক্ষা করা হয়। কখনো কখনো শিশু জরায়ুর মধ্যে যে তরলে (AMNIOTIC FLUID)-ভেসে থাকে তার কিছু অংশ গিলে ফেলে, যা স্ক্যানে তার পাকস্থলীতে কালো বুদবুদের মত দেখায়।

ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে নেন যে শিশুর দুটি বৃক্ক (KIDNEY) আছে কিনা এবং তার মূত্রথলীতে (KIDNEY BLADDER) মূত্র বিনা বাধায় পৌঁছতে পারছে কিনা। যদি শিশুর ব্লাডার খালি থাকে তবে এই  স্ক্যান করার সময়ের মধ্যেই তার ব্লাডার পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে কারণ ভ্রূণ সধারনত প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর মূত্রত্যাগ করে।

শিশুর মুখও পরীক্ষা করা হয়, দেখা হয় তার ঠোঁট কাটা (Cleft  Lip) কিনা।তবে কখনো  কখনো  শিশুর মুখের মধ্যের তালু (টাকরা) কাটা (Cleft Palate) থাকলে তা সহজে বোঝা যায়না।

শিশুর মেরুদন্ড পরীক্ষা করা হয় উল্লম্ব ভাবে ও তির্যক ভাবে যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সব হাঁড়গুলি স্বাভাবিক আছে এবং তার পিঠের চামড়া মেরুদণ্ড পুরোপুরি ঢেকে রেখেছে। অর্থাৎ স্পাইনা বিফিডা সংক্রান্ত কোন সমস্যা থাকলে তা নির্ণয় করা যায়।

শিশুর তলপেটের উপরের আবরণ পরীক্ষা করে দেখা হয় যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এই দেওয়াল ভিতরের সব প্রত্যঙ্গকে সামনের দিকে ঢেকে রেখেছে।

কোন বিকলাঙ্গতা আছে কিনা দেখার জন্য ডাক্তার ভ্রূণের হাত, পা, বাহু, পায়ের পাতা পরীক্ষা করে দেখেন। এছাড়াও ভ্রূণের হাত ও পায়ের আঙ্গুলও পরীক্ষা করা হয়।

এসব পরীক্ষা করা ছাড়াও অ্যানোমালি স্ক্যানে আরও কিছু বিষয় দেখা হয়, যেমন-

  • গর্ভফুল (Placenta)
  • নাভিরজ্জু (Umbilical Cord)
  • গর্ভাশয় মধ্যস্থ তরল (AMNIOTIC FLUID)

গর্ভফুল (প্ল্যাসেন্টা) জরায়ুর সামনে (অ্যান্টেরিয়র) বা পেছনে (পোস্টেরিয়র) থাকতে পারে। এটা সাধারনতঃ জরায়ুর দেওয়ালের উপরের অংশে (Fundal) থাকে। তবে কখনো কখনো প্লাসেন্টা জরায়ুর নীচের দিকে জরায়ুমুখ ঢেকে রাখতে পারে যাকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বলা হয়। অ্যানোমালি স্ক্যানে প্লাসেন্টার এসব বিষয় খুঁটিয়ে দেখা হয়।

ডাক্তার নাভিরজ্জুর তিনটি রক্তনালিকাও  (দুটি শিরা এবং একটি একক ধমনী)  পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এছাড়া জরায়ুতে অ্যামনিওটিক ফ্লুইডের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা তা দেখা হয়। অ্যাম্নিওটিক ফ্লুইড পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে ভ্রূণ স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করতে পারে।

অ্যানোমালি স্ক্যান করার সময় শিশুর অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি মেপে দেখা হয় এবং তার শারীরিক বৃদ্ধিও পরীক্ষা করা হয়। ভ্রূণের যেসব অঙ্গের পরিমাপ নেয়া হয় সেগুলো হলো-

বিজ্ঞাপণ
  • মাথার পরিধি বা HC (Head circumference)
  • মাথার ব্যাস বা BPD (Biparietal diameter)
  • তলপেটের পরিধি বা AC (Abdominal circumference)
  • ফিমার বা উরুর হাড়ের দৈর্ঘ্য বা FL (Femur length)

অ্যানোমালি স্ক্যানের মাধ্যমে বাচ্চার লিঙ্গ বা জেন্ডার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে মনে রাখতে হবে এ স্ক্যানটি করার মূল কারণ হলো- গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা বা কোন শারীরিক অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখা।

বেশীরভাগ ভ্রুনের বৃদ্ধি স্বাভাবিকই পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে যদি কোন সমস্যা চিহ্নিত হয় তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে অতি দ্রুত পরামর্শ করা জরুরী। যেমন ডাক্তার যদি হার্ট-এ কোন বড় সমস্যা আছে বলে ধারণা করেন তবে ভ্রুনের ইকো স্ক্যান করার প্রয়োজন হতে পারে।

তবে এ ধরণের বড় শারীরিক সমস্যা খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কোন সমস্যা চিহ্নিত হলে নিরাশ না হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে হবে।

অ্যানোমালি স্ক্যানে ভ্রূণের কোন জন্মগত ত্রুটিগুলো বোঝা যায়

অ্যানোমালি স্ক্যানে ভ্রূণের কোন জন্মগত ত্রুটি আছে কি না তা নিড়িরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে এই স্ক্যান একজন এক্সপার্ট সনোলজিস্ট দিয়ে করানো উচিত যার ভ্রূণের কোথায় কোন ধরনের ত্রুটি থাকতে পারে সে সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকে। তা না হলে অনেক কিছুই মিস হয়ে যেতে পারে।

অ্যানোমালি স্ক্যানের মাধ্যমে ভ্রূণের বেশ কিছু জন্মগত ত্রুটি নির্ণয় করা যায়। এই স্ক্যানের ফলাফল মোটামুটি নির্ভুল হলেও এর মাধ্যমে ১০০ ভাগ নিশ্চিতভাবে ভ্রূণের সব অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করা যায়না।

গবেষণায় দেখা গেছে অ্যানোমালি স্ক্যানের মাধ্যমে ৯৫% স্পাইনা বিফিডা, ৮০% ক্লেফট লিপ বা প্যালেট এবং ৬০-৭০% জন্মগত হৃদরোগ নির্ণয় করা সম্ভব।

এছাড়াও এর মাধ্যমে ৫০-৭০% ডাউন সিন্ড্রোম সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়, তবে এটি নির্ভুলভাবে বলা যাবে একমাত্র অ্যামনিওসিন্টেসিসের মাধ্যমে।

অ্যানোমালি স্ক্যান কখন করা হয়

অ্যানোমালি স্ক্যান করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় গর্ভাবস্থার ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহ (পঞ্চম মাস)।

১৮ সপ্তাহের আগে এটি করা হয়না কারণ সে সময় ভ্রূণের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুরোপুরি বিকশিত না থাকার সম্ভাবনা বেশি যার কারণে স্ক্যানে সঠিক পরিমাপ পাওয়া কঠিন হতে পারে।

আবার ২২ সপ্তাহের পরে এই স্ক্যান না করার দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত ২২ সপ্তাহের পর ভ্রূণের আকার বেড়ে যাওয়ার কারণে তার শরীরের চারপাশ আলট্রাসাউন্ডে ভালোভাবে বোঝা নাও যেতে পারে। দ্বিতীয়ত এই সময়ের পরে অনেক দেশের আইন অনুযায়ী প্রেগন্যান্সি টারমিনেট করা বৈধ নয়। তাই এই সময়ের পরে করা আলট্রাসাউন্ডে যদি প্রেগন্যান্সি টারমিনেট করার মত কোন জটিলতা পাওয়া যায় তবে সে সময় তা করা সম্ভব নাও হতে পারে।

এইসব কারণেই মূলত ১৮-২২ সপ্তাহের মধ্যেই অ্যানোমালি স্ক্যান করিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।

অ্যানোমালি স্ক্যান কীভাবে করা হয়

অ্যানোমালি স্ক্যান করার পদ্ধতি আলট্রাসাউন্ডের মতই। মাকে শুইয়ে প্রথমে পেটে একধরণের জেল লাগানো হয়। এরপর পেটের উপর হ্যান্ডহেল্ড প্রোবের সাহায্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলট্রাসাউন্ড স্ক্রিনে গর্ভস্থ ভ্রূণের প্রতিচ্ছবি তৈরি করা হয়।

মায়ের ব্লাডার ভর্তি থাকলে আলট্রাসাউন্ডে আরও ভালো বোঝা যায়। তাই স্ক্যান করতে যাওয়ার আগে এসব বিষয় মাথায় রাখবেন।স্ক্যান করার সময় মায়ের কিছুটা অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে কারণ ভ্রূণকে  ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য বেশ কিছুটা সময় নিয়ে মায়ের পেটে একটু চাপ দিয়ে স্ক্যান করা হয়।  

অ্যানোমালি স্ক্যান করতে সাধারণত ৩০ মিনিটের মত সময় লাগতে পারে। এটাও বলে রাখা ভালো যে সনোগ্রাফির মাধ্যমে তথ্য পাওয়ায় ক্ষেত্রে একটা ভালো যন্ত্র থাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিভাবে যিনি পরীক্ষাটি করছেন তাঁর দক্ষতাও রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

অ্যানোমালি স্ক্যান এর কোন ক্ষতিকর দিক আছে কি?

এক্স-রে, সিটিস্ক্যান ইত্যাদি পরীক্ষায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রশ্মি ব্যবহার করা হয়, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আলট্রাসনোগ্রাফিতে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। এই তরঙ্গের উল্লেখ করার মতো ক্ষতিকর দিক এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

বিগত ৫০ বছরে দশ কোটিরও বেশি নারীর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করে এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করে শিশুর ওপর এর কোনো ক্ষতিকর  প্রভাব এখনও পাওয়া যায়নি।

অ্যানোমালি স্ক্যান এর খরচ কেমন?

বাংলাদেশে অ্যানোমালি স্ক্যানের আনুমানিক ব্যয় ১৫০০-৫০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে। এই খরচের ভিন্নতা বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন-  ডাক্তারের ফি, রোগীর সামগ্রিক চিকিত্সা পরিস্থিতি, হাসপাতালের ধরণ ইত্যাদি।

অ্যানোমালি স্ক্যান করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে এ প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে জানার পর কেউ যদি চিকিৎসক এর পরামর্শক্রমে এ স্ক্যানটি করাতে চান সেক্ষেত্রে করিয়ে নেয়াই ভালো ।

সবার জন্য শুভকামনা।


Spread the love

Related posts

Leave a Comment